রাতে ঘুম আসে না। কিছুটা সময়ের জন্য হলেও কেড়ে নেয় জীবনের স্বাভাবিক মূহুর্তগুলো।
আব্দুর রহমান পেশায় ট্রেনচালক। লোকোমোটিভ মাস্টার। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ‘আন্তঃনগর এক্সপ্রেস’ ট্রেন চালান তিনি। চলতি পথে অপঘাতে ট্রেন ট্র্যাকে অনেকের মৃত্যু আর অপমৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখে দেখে মনে এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয় বটে তবে তার কিছু ঘটনা দাগ কেটে যায় হৃদয়ের গভীরে।
রেললাইন ধরে এঁকেবেঁকে ছুটে চলা গন্তব্যে সবার আগেই থাকেন ট্রেন চালক। তাই স্বাভাবিকভাবেই যে কোনো ঘটনার প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী তিনি ও তার সহকারী। দুরন্ত গতিতে ছোটা ট্রেনের সামনে রেললাইনে অসর্তক বাস বা প্রাইভেটকারের অতিক্রমের চেষ্টা, কখনও বা আটকে থাকা, কেউ বা হুট করে ঝাঁপ দিচ্ছেন, কেউবা আত্মহত্যার জন্য শুয়ে আছেন ট্র্যাকে- আরও কত কী!
হরহামেশা দেখা দৃশ্যগুলো মনে কেমন প্রতিক্রিয়ার তৈরি করে? জানতে চাই আব্দুর রহমানের কাছে।
‘অসহ্য যন্ত্রণা হয়। বিশেষ করে যারা আত্মহত্যা করতে আসেন। শেষ সময় পর্যন্ত হুইসেল দিয়ে বিকট শব্দ তৈরি করে তাদের সরানোর চেষ্টা করি। সেই মুহুর্তটার জন্য অপেক্ষায় থাকি; ট্রেন থেকে নিরাপদ দূরত্বে কেউ লাইন থেকে তাকে সরিয়ে দিচ্ছে। তবে বেশিরভাগ সময়েই হতাশ হতে হয়,’ বলছিলেন আব্দুর রহমান।
তিনি ২০০৪ সালে সহকারী লোকোমোটিভ মাস্টার হিসেবে যোগ দেন রেলওয়েতে। তারপর চোখের সামনে এমন কত যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার হিসেবটাও ঠিকঠাক মনে রাখা মুশকিল। কয়টাই বা মনে থাকে।
‘আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস’ ৭০৯ আপ নিয়ে ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছিলেন আব্দুর রহমান। ট্রেন চালনার ফাঁকে কখনও স্টেশনে, কখনও বা আউটার সিগন্যালে কখনও বা গন্তব্যে পৌঁছে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় তার।
ভোলা সদরের দক্ষিণ চরপাতা গ্রামের আব্দুল মোতালেবের সন্তান আব্দুর রহমান। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তৃতীয়।
ঢাকার তিতুমীর কলেজ থেকে ইসলামিক স্ট্যাডিজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে একটি হাইস্কুলে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। রেলওয়েতে চাকরি করতে আসাটাও বেশ বিচিত্র। দ্বীপের বাসিন্দা হিসেবে স্টিমারের বিপ্রতীপ যেন রেলগাড়ি।
‘ভোলা থেকে আসেন বুয়েট পড়ুয়া মেঝ ভাই আব্দুস সালামের কাছে। সে সময় মালিবাগে ক্রসিংয়ে প্রথম দেখা ট্রেন। আর তখন থেকেই রেলগাড়ির প্রতি প্রথম প্রেম! তবে কখনও যে রেলগাড়ি চালাবো। তা ভাবনাতেও আসেনি সেসময়,’ বলেন তিনি।
‘রেলওয়েতে নিয়োগ পরীক্ষা দিলাম। মেধা ও যোগ্যতায় পাস করে বুঝতে পারলাম, ট্রেন চালক হতে চলেছি’।
গত এক যুগ ধরে ট্রেন চালিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন অসংখ্যবার, তেমনই এক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ট্রেন নিয়ে যাচ্ছি। সায়েদাবাদ লেভেল ক্রসিং অতিক্রম করবো। হঠাৎ দেখি লাইনে বাস উঠেছে। যাত্রীবোঝাই। দূরত্ব মাত্র
১০ হাত। সামনে নিশ্চিত বিপর্যয়; বড় ধরনের দুর্ঘটনা। ঘাম পড়া শুরু করলো। উত্তেজনায় হাত কাঁপছে। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েই অটোমেটিক ব্রেক আর জরুরি ব্রেকের হাতল টানলাম। ব্যস! ট্রেন থামলো। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলো বহুযাত্রী। এটা জীবনের ইতিবাচক স্মরণীয় ঘটনা আমার।
আব্দুর রহমান বলেন, একবার সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ৭৮৮ আপ নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছি। গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৭২ কিলোমিটার। আখাউড়া অতিক্রমের পর দেখছি, তিন চারজন নারী স্বাভাবিকভাবে লাইনের পাশে এসে গল্প করছেন। ট্রেন এগোচ্ছে হঠাৎ করে একজন পুরুষ এসে ওই নারীকে আলাদা করে তাকে টেনে নিয়ে ঝাঁপ দিলেন লাইনে! পরে জেনেছিলাম পারিবারিক কলহে ঝগড়ার পর স্ত্রী শান্ত হলেও স্বামীটি স্বাভাবিক হননি। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে স্ত্রীকে এভাবে হত্যা করে স্বামী নিজেও আত্মহত্যা করেন।
‘একদিন কিশোরগঞ্জ এগারো সিন্ধু এক্সপ্রেস ৭৫০ ডাউন নিয়ে ঢাকা যাচ্ছি। কারিকা প্রসাদ থেকে আউটার সিগন্যালের আগে দেখি লাইনে একজন শুয়ে পড়েছেন। দূর থেকেই একের পর এক হুইসেল দিতে থাকলাম। একটা সময় দেখলাম লাইন থেকে উঠে নিজেই দৌড়ে পালালেন। খুব ভালো লেগেছিলো সেদিনের এই দৃশ্যটি,’ আরও বলছিলেন তিনি।
রেললাইনজুড়ে পুরোটাই নিরাপত্তা থাকা উচিত মত দিয়ে তিনি বলেন, ১৪৪ ধারা জারি থাকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। পুরো লাইনজুড়ে যদি বেষ্টনী থাকতো তবে কেউ আর এভাবে লাইনে ঝাঁপ দিতে পারতো না। তবে এটা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি অনেকেই খোদ স্টেশনেই চলন্ত রেলের সামনে ঝাঁপ দেন। এগুলো পরিহার করা দরকার।
বাসায় ফিরে স্ত্রী শামীমা ইয়াসমিন লিজার সঙ্গে চলতি পথের নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এই ট্রেন চালক। সে নিজেও ইডেনে ইসলামিক স্ট্যাডিজে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। এসব শুনে সে নিজেও চমকে ওঠে। আমার হয় আফসোস। আহা জীবনটা কি এতো তুচ্ছ!
আব্দুর রহমানের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মৃত্যুর বিভীষিকাময় দৃশ্যপট। এসব ভেবে ভেবে হারিয়ে যায় রাতের ঘুম!
বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৭
এএটি/আইএ