দরটা বুঝি একটু বেশিই হয়ে গেছে। এক লাফে ৬০ টাকা কমিয়ে বাইশ শ’ দশ, বাইশ শ’ দশ হাঁকা শুরু করলেন হরিদাস।
মাছের মালিক তিনি নন। প্রতিদিন ভোরে তবু মাছ বিক্রি করে দিতেই কুলিয়ারচরের এই বাজারে ছুটে আসেন তিনি। এখানে গলার চড়া আওয়াজটাই পুঁজি তার। প্রতি ঝাঁকা মাছ বিক্রি হলে দশ কি বিশ টাকা বখশিস মেলে। এতেই দিনে জমে যায় কয়েকশ’ টাকা। কিন্তু সে আয়ও এখন পড়তির দিকে। মৌসুম নয় বলে মাছ কম বাজারে। মাছের গাড়ি কম এসেছে আজ। বাজার লাগোয়া জেটিতে এখনো ভেড়েনি কোনো মাছের ট্রলার। মেঘনা থেকে অশ্বক্ষুরের মতো বেরিয়ে আসা কালি নদীতে স্থানীয় জেলেদের ধরা পাঁচ মিশালীর ঝাঁকা আসছে একটা দু’টো।
জেটির পাশে মাছ রাখার সারি সারি ঝাঁকা উল্টে রাখা হয়েছে। ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে সূর্যটা। সকাল সাড়ে সাতটাতেও সেটা বেয়াড়া মেঘের আড়ালেই রইলো। বাজারে মাছ কম বলে বুঝি আজ আড়মোড়া ভাঙতে আরো দেরিই হবে তার।
কিন্তু দেখা না দিলেও মেঘের আড়াল থেকেই যেনো গরম ঢালছে সূয্যিমামা। এই সাত সকালেই ২৭ ডিগ্রিতে চড়েছে তাপমাত্রার পারদ। বাতাসে ৭৮ শতাংশ আদ্রতা জানিয়ে দিচ্ছে, জলীয় কণায় টইটুম্বুর হয়ে আছে বৈশাখের আকাশ। দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ১২ কিলোমিটার গতিতে ছুটে আসা মৌসুমী বায়ু হুট করে ২৮ কিলোমিটারে উঠে দমকা ধাক্কা মারছে কুলিয়ারচর বাজারে। উত্তরে শুটকি পল্লীও খা খা করছে।
শূন্য আড়তে চেয়ারের ওপর পা তুলে বসে আছেন আব্দুর রশিদ। বন্ধ ক্যাশ বাক্সের ওপরে হিসেবের লাল খাতা গুটিয়ে রাখা। অধিকাংশ আড়তদারই তার মতো বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন আড়তে। মাছ থাক বা না থাক, বছরের পর বছর ধরে এ সময়টা তো এখানে এভাবেই কাটে তাদের।
এই কিশোরগঞ্জেরই বাজিতপুর আর নিকলী থেকে গাড়ি গাড়ি মাছ আসে কুলিয়ারচর বাজারে। এ জেলারই আগাম বন্যা কবলিত ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর আর সুনামগঞ্জ থেকে আসে মাছ বোঝাই ট্রলার। চট্টগ্রাম থেকে আসে নোনা পানির মাছ।
কিন্তু মিঠা ও নোনা পানির মাছের অন্যতম এই আড়ত যেনো ঝিম মেরে আছে এখন। চিংড়ি, পোয়া, দাতিনা, ইলিশ বা আর কোনো মাছ নয়, কেবল কয়েক বস্তা চাপিলার চালান এসেছে চট্টগ্রাম থেকে। আর এসেছে কিছু চাষের রুই, কাতলা, তেলাপিয়া। ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে সাদা মাছের চালান এনেছেন বাদল মিয়া। আকালের বাজারে ৩৬ মণ মাছ বিক্রি করতে সময় লাগেনি তার। বাংলানিউজকে জানালেন, ত্রিশাল ছাড়াও ভালুকা থেকে সাদা মাছের নিয়মিত চালান আসে কুলিয়ার চরের এই মাছের বাজারে।
নদীর তীরে রাজ সিনেমা হলে সদ্য মুক্তি পাওয়া ধ্যাততেরিক সিনেমার ব্যানার। পাশে চাষের সাদা মাছ প্যাকেট করছেন ক’জন মাছ শ্রমিক। বরফ বিক্রেতা মিন্টু মিয়া কোমরে হাত দিয়ে অলস চোখে তাই দেখছেন। মাছ কম আসার আক্ষেপ খেলে যায় তার মুখেও।
আগে দিনে অন্তত একশ’ চাই বরফ বেচতাম। আজ বেচলাম মাত্র ২৫ চাই। মাছ নাই রে ভাই, মাছ নাই। নদী সব ভরাট হইয়া গেছে। মাছ হবে কোথায়?
পাশ থেকে গাড়ির চালক বেলাল হোসেন এসে খেই ধরেন মিন্টু মিয়ার কথার। আগে তো কুলিয়ারচর স্টেশন থেকে ওয়াগন ভর্তি মাছ যাইতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতো মাল গাড়ি। এখন আর সেদিন নাই। রেলগাড়িতে মাছও যায় না।
ফের কথার রেশ ধরে মিন্টু মিয়া বলেন, যদিও এখন মাছের মৌসুম প্রায় শেষ। তবু আশ্বিন-কার্তিকে শুরু হওয়া হাওর আর নদীর মাছের মৌসুম তো এই বৈশাখেও বাজার ভরিয়ে রাখে। সেসব মাছ গেলো কোথায়?
উদাস কণ্ঠে মিন্টু মিয়া বলতে থাকেন, একে তো এবার হাওরে অকাল বন্যা। নদীতে বাড়তি পানি। মৌসুমের একমাত্র ফসল বোরোর ক্ষেত সব পানির নিচে। তারওপর মাছ না থাকলে হাওরবাসী খাবে কী?
বাংলাদেশ সময়: ১০১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৭
জেডএম/এমএএম/এইচএ/