শেষ পর্যন্ত দেখাও গেলো তাই। সামনাসামনি বসে সমানতালে তাঁতালো লোহা পেটাচ্ছেন দুজন।
কামাররা তার নাম দিয়েছেন ‘বুলার’। একটি মোটা পাইপের মধ্যে দিয়ে বিরামহীনভাবে বাতাস ঢুকছে কয়লার অগ্নিকুণ্ডে। আর সেখানে পুড়িয়ে লাল করা হচ্ছে মোটা মোটা লোহার পাত। সেখান থেকে টিনের চিমনি বেয়ে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরে।
লোহা পুড়ে লাল হতেই সাঁড়াশি দিয়ে ধরে তোলা হচ্ছে রেললাইনের কাটা খণ্ডের ওপর। এর পর পরই শুরু হচ্ছে হাতুরি আর হ্যামারের বর্ষণ। চোখের পলক ফেলতেই লোহার পাতটি ধারালো চাপাতি হয়ে যাচ্ছে। হাতুরের বাড়ি আর হাতের জাদুতে আগুনে পোড়া লালাভ কাঁচা লৌহখণ্ড ছুরি-চাকু বা ধারালো বটির আকার নিচ্ছে।
অনেকক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও তা বেমালুম ভুলে যান কামারশিল্পী রেজাউল ইসলাম ভেদু। যেন হাতের কাজ ফেলে কথা বলার কোনো ফুরসতই নেই তার। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকেই ভেদুর সঙ্গে কথা চলে প্রতিবেদকের। ক্ষণিকের আলাপচারিতায় উঠে আসে কোরবানির ঈদের বাড়তি কাজ আর ব্যস্ততার হালচাল।
রেজাউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, চার পুরুষ থেকে কামারের কাজ করেন তারা। তাই নিজের ছেলে সোহাগকেও কাছে রেখে কাজ শেখাচ্ছেন। এ পেশায় আর আগের মতো আয় না থাকলেও পৈত্রিক পেশা কখনও ছাড়বেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন ভেদু।
ভেদুর ভাষ্যমতে সারা বছর তেমন কাজ থাকেনা। আর এমন ব্যস্ততাও থাকেনা। তাই কোরবানির ঈদের এ বাড়তি কাজ তাদের পেশাকে সারা বছর টিকিয়ে রাখে। মোটামুটি ঈদের দুই মাস আগে থেকেই কোরবানির কাজ শুরু হয়। চলে চাঁদ রাত পর্যন্ত।
প্রথম মাস তারা বিক্রির জন্য নিজেরাই ছুরি, চাকু, চাপাতি, বটি তৈরি করে রাখেন। পরের মাস কেবল অর্ডারে কাজ করেন। শেষ সপ্তাহ রাখেন ছুরি-চাকু শান দেওয়ার জন্য। এজন্য শেষ সপ্তাহে তাদের কথা বলা তো দূরের কথা যেন দম ফেলারও সময় নেই!
আধুনিক যন্ত্রাংশের প্রভাবে কামার শিল্পের দুর্দিন চললেও বছর ঘুরে আবারও ব্যস্ততা বেড়েছে কামার শিল্পীদের। কাজের চাপে নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের। আগের কাজ শেষ না হওয়ায় অর্ডার নেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন অনেকে-জানান রেজাউল ইসলাম ভেদু।
জানতে চাইলে স্টেডিয়াম পাড়ার কর্মকার পলক বাংলানিউজকে বলেন, সারা বছর তাদের তেমন খোঁজ-খবর রাখেন না কেউই। কেবল ওয়েল্ডিংয়ের কারখানারই বেশি কাজ থাকে। এছাড়া সব সময়ের জন্য কিছু কোদাল, কাঠ কাটার কুড়াল, ছুরি, চাপ্পর প্রভৃতি তৈরি করে কোনোভাবে জীবিকা চালান তারা। কিন্তু কোরবানির আগে কাজ বেড়ে যায়।
গত বছরের তুলনায় লোহার দাম কিছুটা বেশি। বর্তমানে চাপাতি বা চাপ্পর সাড়ে ৩শ’ টাকা কেজি, ছুরি ৪শ’ টাকা কেজি এবং বটি সাড়ে ৩শ’ টাকা কেজি হিসাবে বিক্রি করছেন তারা। চাহিদা থাকায় ক্রেতাদের জন্য নিত্যনতুন হাতিয়ার তৈরি করছেন। আর আকার ভেদে ১শ’ থেকে ৫শ’ টাকার মধ্যেও কোরবানির জন্য বিভিন্ন হাতিয়ার তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বড় ছুরি ৪০, চাপাতি ৬০, দা ৫০ এবং ছোট ছুরি ২০ টাকায় শান দিচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৭
এসএস/ওএইচ