বাড়িতে কাদের জন্য টাকা পাঠান জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়িতে আমার স্ত্রী ও একটি ছেলে রয়েছে। ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে।
সোমবার (৬ নভেম্বর) দিবাগত গভীর রাতে হাইকোর্টের সামনে নিজের ইচ্ছার কথাগুলো এভাবেই বাংলানিউজকে বলছিলেন মো.আব্দুল বরকত।
কোথায় থাকেন জানাতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিদিন যা আয় করি তা দিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকা সম্ভব না এই শহরে। বাসা ভাড়া করে থাকতে গেলে দেখা যাবে ছেলেটাকে আর স্কুলে পাঠাতে পারছি না। তাই বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় রাত কাটাই।
বরকতের মতো নিজের পরিবার ও সন্তানদের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য রাজধানীতে আসা এসব খেটে খাওয়া মানুষদের খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করতে অনেক প্রতিকূল পরিবেশেরও সম্মুখীন হতে হয়।
হাইকোর্টের গেটের সামনে সরেজমিনে দেখা যায়, সারি বদ্ধভাবে ৪০-৫০ জন মানুষ ফুটপাতে শুয়ে আছেন। যাদের ফুটপাতে জায়গায় হয়নি তারা রিকশা, ভ্যান কিংবা গাছের গোঁড়ায় একটু জায়গা করে ঘুমচ্ছেন।
রাজধানীতে রাতে শীতের আবাস থাকায় রাস্তায় ঘুমানো মানুষদের কষ্টের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। এদের অনেকের কাছেই শীত নিবারণের কিছু নেই। ফলে শীত নিবারণে অনেকেই গায়ে পড়েছেন প্ল্যাস্টিকের কাগজ। এতে যদি একটু শীত তাড়ানো যায়।
জীবন জীবিকার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা এই হতভাগ্য মানুষগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ আয় না করতে পারায় বাধ্য হয়ে রাস্তায় ঘুমান। কিন্তু রাস্তায় ঘুমিয়েও তাদের শান্তি নেই। প্রতিরাতে ঘুমানোর জন্য পুলিশের লাইন ম্যানকে দিতে হয় ২০ টাকা করে। টাকা দিতে না পারলে ঐদিন রাতে আর ঘুম কপালে জুটবে না।
কিশোরগঞ্জের রিনা আক্তার পুরাতন কাপড় বিক্রি করে নিজের জীবিকা নির্বাহ করেন। অর্থ সংকটে তিনিও হাইকোর্টের গেটের সামনে ঘুমান প্রতিরাতে।
তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, এই শহরে আমাগো কোনো থাকার জায়গা নেই। তাই রাস্তায় ঘুমাই। কিন্তু পুলিশ ও চাঁদাবাজদের অত্যাচারে রাস্তায় ঘুমাইয়াও শান্তি নেই। হেই বলে টাকা দাও হেই বলে এইডা দাও সেইডা দাও। না দিলেই লাথি মেরে তুলে দেয়। ’
এসব ছিন্নমূল মানুষ রাস্তায় শুধু কষ্টে ঘুমচ্ছেন তা না সঙ্গে বড় ধরনের বিপদ নিয়েও ঘুমাচ্ছেন। ফুটপাতের পাশ দিয়ে উচ্চগতিতে চলে যাছে যানবাহন। একটু এদিকে সেদিক হলেই ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে থাকার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রিকশা চালক হালিম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের জীবনের মায়া করলে পরিবারে মুখে ভাত তুলে দিতে পারবো না। রাস্তায় থেকে কিছু টাকা আয় করি বলেই মা, বাবা ও ছেলে-মেয়ের মুখে ভাত জুটে। না হলে তো না খেয়ে থাকবে ওরা। তাদের জন্য জীবনের এই ঝুঁকি কিছুই না।
তবে ছিন্নমূল এসব মানুষ হয়তো অনেক কষ্টে কিংবা ঝুঁকি নিয়ে ক্লান্তির ঘুম রাস্তায় ঘুমচ্ছেন। তাদের চোখ মুখ লক্ষ্য করলে দেখা যায় এতো সব সমস্যার মধ্যেও যেন কোথাও একটু প্রশান্তি লুকিয়ে রয়েছে। ঘুম যেন নিজের সার্থকতা পেয়েছে তাদের কাছে এসে। যা হয়তো কোনো বিত্তশালীর আরামদায়ক বিছানায় পাওয়া যায় না। কেননা সারা দিন অমানবিক পরিশ্রমের পরেও এই ঘুমই যে একমাত্র উপায় সকল দুঃখ কষ্ট ভুলার।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৭
এমএসি/বিএস