ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

রামুতে হামলার ৬ বছর, মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৮
রামুতে হামলার ৬ বছর, মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দুর্বৃত্তদের হামলার পর নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে বৌদ্ধ বিহার। ছবি: বাংলানিউজ

কক্সবাজার: কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধ বিহার এবং বসতিতে দুর্বৃত্তের হামলার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে শনিবার (২৯ সেপ্টেম্বর)। কিন্তু ছয় বছরেও এ সংক্রান্ত ১৮টি মামলার একটিরও বিচার কাজ শেষ হয়নি।

বরং উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে উল্টো মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।  
    
এ ঘটনার হোতাদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল গঠন করা হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিটি তদন্ত আদালতে প্রতিবেদন দিলেও ছয় বছরেও মূল মামলার চূড়ান্ত শুনানির কোনো অগ্রগতি নেই।  

ঘটনার পর বিভিন্ন মামলায় পুলিশ প্রায় ৫০০ জনকে আটক করলেও এখন সবাই জামিনে মুক্ত। আবার এখনো পলাতক ১০৬ জন।  

তাই এসব মামলার আইনি কার্যক্রম নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে বিচারকার্য নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও সম্প্রীতির জায়গায় এসে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল তা ধীরে ধীরে কেটে উঠছে বলে জানান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা।

উল্লেখ্য, উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।  

এ সময় আরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। পরদিন বিকেলে উখিয়া ও টেকনাফে আরো চারটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালানো হয়। এতে পুড়ে যায় এসব বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

এ ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রামু থানায় ৮টি, উখিয়ায় ৭টি, টেকনাফে দু’টি ও কক্সবাজার সদর থানায় দু’টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে।  
    
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের কোর্ট পরিদর্শক কাজী দিদারুল ইসলাম জানান, ১৯টি মামলার মধ্যে রামু থানায় জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দু’পক্ষের আপোস মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত। বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। এরমধ্যে ৫টি মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে দেওয়া হয়। অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে তিনটি মামলার অভিযোগপত্রও আদালতে দাখিল করে পিবিআই। দুর্বৃত্তদের হামলার পর নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে বৌদ্ধ বিহার।  ছবি: বাংলানিউজ

তিনি বলেন, ১৮টির মধ্যে বর্তমানে ১৪টি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে আছে। তবে উপযুক্ত সাক্ষী না পাওয়ায় এসব মামলার গতিও থমকে আছে। নাম-ঠিকানা ধরে পাওয়া যাচ্ছে না মামলার বেশিরভাগ সাক্ষীকে। অনেক সাক্ষী আবার আসামির পক্ষে কথা বলায় চিহ্নিত হচ্ছেন ‘বৈরি সাক্ষী’ হিসেবে।  

কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর পরিদর্শক কৈশানু মার্মা জানান, রামুর উখিয়ার ঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার, লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার ও ফতেখাঁরকুলের লালচিং, সাদাচিং ও মৈত্রী বিহার এবং চাকমারকুল ইউনিয়নের অজান্তা বৌদ্ধ বিহার এবং উখিয়ার একটি  মামলা আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই’র কাছে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, মোট ৫টি মামলা তাদের কাছে পাঠানো হলেও এর মধ্যে চারটি মামলা অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি একটি মামলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশনা ছিল আদালতের। কিন্তু ওই সময় এ পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা কক্সবাজার পিবিআই-এ না থাকায় তদন্ত কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। পরবর্তীতে জবাব দিয়ে আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তবে পিবিআইএর এ কর্মকর্তার দাবি, সাক্ষী পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে অনেককে শনাক্ত করে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আদালত চাইলে তাদের শাস্তি দিতে পারেন।

কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন বলেন, মূলত সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।  

এসব মামলায় বেশিরভাগ সাক্ষীই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তারা ভয়ে কেউ সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। আর যে কয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন, এরা বলেছেন উল্টো। তাই বেশিরভাগ সাক্ষীকে ‘বৈরি ঘোষণা’ করেছেন আদালত। তিনি বলেন, বেশিরভাগ সাক্ষী অনুপস্থিত থাকায় বিলম্বিত হচ্ছে এসব মামলার বিচার।

তিনি বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী যারা তারা যদি সাক্ষ্য না দেন, তাহলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।  

রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের আহ্বায়ক রজত বড়ুয়া রিকু বলেন, ১৮টি মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে কিছুই বৌদ্ধ সম্প্রদায় জানে না। এমনকি যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন, যারা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এরা কেউই পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। এ অবস্থায় বর্তমানে ভয়ে সাক্ষীরাও সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না।

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, এই ছয় বছরে আমরা ভাঙাগড়া, উত্থান-পতন অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছি।  

এ ঘটনায় রামুর হাজার বছরের গর্বের ধন ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে’ যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল তা আস্তে আস্তে কেটে ওঠছে। তবে পুরোটা ফিরে আসতে সময় লাগবে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ অবস্থায় সুষ্ঠু বিচারের পাশাপাশি সম্প্রীতির জায়গাটাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে হবে। সেটি হতে পারে সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে বা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।  দুর্বৃত্তদের হামলার পর নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে বৌদ্ধ বিহার।  ছবি: বাংলানিউজ
    
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, মোট ১৮টি মামলায় এ পর্যন্ত ৪২৬ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অনেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন।     

বিচার বিভাগীয় তদন্তের শুনানির কোনো অগ্রগতি নেই

চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পরপর আদালতের নির্দেশে চট্টগ্রামের দায়রা জজ আবদুল কুদ্দুস মিয়ার নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ২০৫ জন অভিযুক্ত করে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এ কমিটি জড়িতদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে সুপারিশ করে। অন্যদিকে বিচার বিভাগীয় তদন্তেও ২৯৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় প্রায় ছয় বছর আগে। কিন্তু ও মূল মামলার চূড়ান্ত শুনানির কোনো অগ্রগতি নেই।

বাংলাদেশ সময়: ০২১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৮
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।