ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

প্রতিরোধের মার্চ-৪

বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৮ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৯
বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ

১৯৭১ | গৌরব ও প্রতিরোধের মার্চ। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন বঙ্গবন্ধু। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ময়মনসিংহ প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে। ২৭ মার্চ থেকে ২৩ এপ্রিল—ময়মনসিংহ ছিলো হানাদারমুক্ত এবং স্বাধীন। তারপর ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শত্রুসেনা মুক্ত হয়। মাঝে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ২৩১ দিন। ছোট-বড় অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয় ময়মনসিংহের রণাঙ্গনে। কোনো যুদ্ধে হানাদাররা চূড়ান্ত বিজয় পায়নি।

একাত্তরে ময়মনসিংহ ছিলো অপরাজেয়। যুদ্ধের সময়ে ময়মনসিংহের ইতিবৃত্ত নিয়ে ৫ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান।

পড়ুন ধারাবাহিক প্রতিবেদনটির চতুর্থ কিস্তি। ছবি তুলেছেন ডিস্ট্রিক্ট ফটো করেসপন্ডেন্ট অনিক খান।

“বঙ্গবন্ধু আমাকে চিনতেন। তাঁর বেশিরভাগ সমাবেশই কভারেজ করার অভিজ্ঞতা ছিলো আমার। পেশাগত কারণেই তার সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো। এই সূত্র ধরেই তার আদর-স্নেহ পেয়েছি। আমাকে ‘তুই’ বলেও সম্বোধন করতেন বঙ্গবন্ধু।

সাংবাদিকদের প্রতি তিনি অনেক আন্তরিক ছিলেন। মানুষকে সহজেই আপন করে নিতেন। আমাদের লাল সবুজ পতাকা, গর্বের আত্মপরিচয় সবকিছুই তার দৌলতেই। এমন নেতা ইতিহাসে বিরল। ” 

মহান স্বাধীনতার স্থপতি ও ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে একদমেই যেন কথাগুলো বলছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম স্নেহধন্য বর্ষীয়ান সাংবাদিক এ এস এম হাবিবুল্লাহ।  

ওই সময় তিনি ছিলেন তৎকালীন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানের (এপিপি) সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।  

বাঙালি জাতির গৌরব ও অহংকারের অগ্নিঝরা মার্চের দিনগুলোতে বলা চলে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ছায়াসঙ্গী। ঐতিহাসিক ৭ মার্চে রাজধানীর রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ কভারেজ এবং ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি জান্তাদের ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম বর্বরতার কথা বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন সাংবাদিক এ এস এম হাবিবুল্লাহ।

বর্ষীয়ান সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ ২০০২ সালের দিকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) চিফ নিউজ এডিটর পদে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।  

অবসরের পর থেকেই তিনি স্থায়ীভাবে থাকছেন নিজের নাড়িপোঁতা ভিটা ময়মনসিংহ শহরের সানকিপাড়ার আব্দুল্লাহ ভিলার বাসায়।  

৮২ বছর বয়সী এই শক্তিমান সাংবাদিক উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিকসসহ শারীরিক অসুস্থতায় কাবু হলেও এখনো খুব একটা ঝাপসা হয়নি স্মৃতিশক্তি। স্মৃতির পাতায় অনেক কথাই ভেসে ওঠে তার সামনে।  

স্মৃতির ঝাঁপি খুলে তিনি বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকেসহ ওই সময়কার প্রায় সব সংবাদকর্মীকেই ভীষণ স্নেহ করতেন। আমি বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি সমাবেশ কাভার করতাম। রাজশাহী, ঢাকার রেসকোর্স, ধোলাইখাল, বরিশাল, যশোরসহ অনেক জায়গায় অফিস অ্যাসাইনমেন্টে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গিয়েছি। বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দিন ঐতিহাসিক ৭ মার্চে রাজধানীর রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  

‘ওইদিন ১৯ মিনিটের এই ভাষণ আমি কাভার করেছিলাম তৎকালীন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানের (এপিপি) স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট হিসেবে। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলো লাখ লাখ মানুষ। জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। জয় বাংলা বলেই সেদিন তিনি বক্তব্য শেষ করেছিলেন। ’ 

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারের ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত ‘১৯৭১: ভেতরে-বাইরে’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলে বক্তব্য শেষ করেছিলেন মর্মে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিলো সেই বিতর্কেরও অবসান ঘটিয়েছিলেন ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর তেজোদীপ্ত ভাষণের এই অমর সাক্ষী সাংবাদিক এ এস এম হাবিবুল্লাহ।

২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর দেশের প্রখ্যাত এই সাংবাদিকের প্রথম সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলো বাংলানিউজ। যেখানে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, জয় বাংলা বলেই থেমেছিলেন বঙ্গবন্ধু।  

বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের মার্চেই ধোলাইখালে এক জনসভায় নিজের বক্তৃতায় গল্পের অবতারণা করে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত বার্তা দিয়েছিলেন, এমন তথ্যও উঠে আসে প্রবীণ এই সংবাদকর্মীর জবানিতে।  

সেদিনের বঙ্গবন্ধুর বলে যাওয়া গল্প নিজের কণ্ঠে ধারণ করে তিনি বলেন, ধোলাইখালে এক জনসভায় পশ্চিমারা আমাদের কীভাবে শোষণ করছে এবং অবিচার করছে সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধু।  

তিনি বলেছিলেন, ‘এক লোক মারা যাওয়ার সময় দুই ছেলেকে খেজুর গাছ ও গাভী দিয়ে গেলেন। তাদের বাবা’র মৃত্যুর পর বড় ভাই ছোট ভাইকে বলেছে, খেজুর গাছের আগাটা আমার তলাটা তোর। গাভীর বেলায় বলছে, গরুর মুখ তোর পেছনটা আমার।  

অর্থাৎ, বড় ভাই গাভীর দুধ খায়, আর ছোট ভাই শুধু গাভীকে খাবার খাওয়ায়। বড় ভাই খেজুর রস খায় আর ছোট ভাই খেজুর গাছের তলায় পানি দেয়। ছোট ভাই একদিন কুড়াল দিয়ে খেজুর গাছটা কাটছে বলছে, যেহেতু নিচেরটা আমার তাই আমি কাটছি।  

একই ঘটনা ঘটে গাভীর বেলাতেও। মূলত এই গল্পের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের চূড়ান্ত বার্তা দিয়েছিলেন। আর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার পাশাপাশি সামরিক আইন প্রত্যাহারসহ ৪ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতের কথা বলতে গিয়ে দেশবরেণ্য এই প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতে আমি বাসায় ফিরি। এরপর পাকি হানাদাররা বিশ্বের ইতিহাসে ভয়ঙ্কর গণহত্যা সংঘটিত করে। ভয়ঙ্কর চারিদিক। পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাংক আর মেশিনগানের গুলি। রাজপথে ছিলো রক্ত আর রক্ত। পাকিস্তানিদের এই বাঙালি নিধনযজ্ঞ থেকেই অসীম সাহসী বাঙালি সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। প্রতিরোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের শুরু তখন থেকেই। ’

** মুক্তিকামী জনতার দখলে ময়মনসিংহ 
**
মুক্তিযুদ্ধে প্রথম বিজয় ময়মনসিংহে
**শহর থেকে গ্রামে যুদ্ধের প্রস্তুতি

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫২ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৯ 
এমএএএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।