ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

নেপাল ট্র্যাজেডি: শিক্ষকতায় ফিরতে চান সেই হাসি 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩০ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৯
নেপাল ট্র্যাজেডি: শিক্ষকতায় ফিরতে চান সেই হাসি  নেপালে প্লেন দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ইমরানা কবির হাসি। ছবি: বাংলানিউজ

টাঙ্গাইল: নেপালে প্লেন দুর্ঘটনায় আঘাতের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা টাঙ্গাইল পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ডের এনায়েতপুর দক্ষিণ পারায় সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা হুমায়ূন কবিরের মেয়ে ইমরানা কবির হাসি। তিনি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। 

গত বছর ১২ মার্চ ইমরানা কবির হাসি ও তার স্বামী মো. রকিবুল হাসান নেপালে ঘুরতে যাওয়ার সময় ইউএস বাংলার একটি প্লেন দুর্ঘটনার শিকার হন। দুর্ঘটনার সময় ঘটনাস্থলেই তার স্বামী রকিবুলের মৃত্যু হলেও বেঁচে যান হাসি।

কিন্তু আজো তিনি সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি ভুলতে পারছেন না।

হাসি জানিয়েছেন যতদিন বেঁচে থাকবেন এই দুঃসহ স্মৃতি নিয়েই থাকবেন। দীর্ঘ ১১ মাস পর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি নিজ বাড়ি টাঙ্গাইলে এসেছেন। আরও কয়েকটি অপারেশন বাকি আছে তার। এখনো তিনি চিকিৎসাধীন আছেন ইউএস বাংলার তত্ত্বাবধানে।  

সোমবার দুপুরে এনায়েতপুর দক্ষিণ পাড়ার বাড়িতে গিয়ে বাবা, মা, ভাই, বোন ও হাসিকে পাওয়া যায়। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেকেই অঝোরে কেঁদে ফেলেন।

হুমায়ন কবির বলেন, গত বছরের ১২ মার্চ হাসি ও তার স্বামী রকিবুল সাত দিনের ভ্রমণে ঢাকা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউএস বাংলার একটি ফ্লাইটে নেপালের উদ্দেশে রওনা হয়। তাদের বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বাড়ির পথে রওনা হই আমি। ট্রেনে আসার সময় হাসির মামাতো ভাই আমাকে ফোন করে জানতে চায় হাসি ও তার স্বামী নেপালের উদ্দেশে রওনা হয়েছে কিনা। রওনা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করলে সে জানায় হাসিদের বহনকারী প্লেনটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। টেলিভিশনের খবরে প্লেন দুর্ঘটনার ছবি দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।  

দুর্ঘটনার শিকার যাত্রীদের আত্মীয়-স্বজনদের নেপালে নেওয়া হবে এমন সংবাদ পেয়ে আবার বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হই। রাত ১২টায় ইউএস বাংলার অফিসে গিয়ে পৌঁছাই। আমার পাসপোর্ট না থাকায় হাসির এক বান্ধবীর স্বামীকে নেপাল পাঠানো হয়।  

তিনি আরো বলেন, নেপাল থেকে হাসিকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হবে এমন খবর পাওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট করে ১৫ মার্চ নেপাল গিয়ে পৌঁছাই। নেপালের হাসপাতালে সমস্ত শরীরে ব্যান্ডেজ থাকায় নিজের মেয়েকে চিনতে পারছিলাম না। কম্পিউটারে মুখ দেখে নিশ্চিত হই। এসময় কোনো কথা বলতে পারছিলো না আমার হাসি। আব্বু বলে ডাকলে শুধু ‘অ্যাঁ’ শব্দ করেছিল। সকাল-বিকেল হাসপাতালে গেলেও হাসির সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারিনি। শুধু মৃতদেহের মতো হাসিকে পড়ে থাকতে দেখেছি।

১৬ মার্চ ইউএস বাংলার কর্মকর্তা, বাংলাদেশের মেডিকেল টিমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করে হাসিকে সিঙ্গাপুরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭ তারিখ রাত ১২টার ফ্লাইটে আমিসহ হাসিকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। পরদিন সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে হাসিকে ভর্তি করা হয়। ভর্তি করার তিন ঘণ্টা পর ডাক্তার জানান, হাসিকে বাঁচানো সম্ভব, তবে তার বাম হাতের কব্জি পর্যন্ত কেটে ফেলতে হবে। ওই হাসপাতালের হাতের চিকিৎসক বাংলাদেশি তাকে জানানো হয় তার দেশের রোগী এসেছে। খবরটি শুনে তিনি ওয়ার্ডে এসে হাত দেখে জানালেন কব্জি পর্যন্ত কাটতে হবে না হাতের পাঁচটি আঙ্গুল কাটতে হবে। বাবার অনুমতি পাওয়ার পর হাসির পাঁচটি আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়। হাসির শরীরের এক জায়গার চামড়া কেটে আরেক জায়গায় লাগানো হয়েছে। নয় দিন চিকিৎসার পর মোটমুটি সুস্থ হয় হাসি।
  
ইমরানা কবির হাসি বাংলানিউজকে বলেন, ১২ মার্চ সব কিছু স্বাভাবিক থাকায় দুপুরের দিকে তাদের বহনকৃত প্লেনটি ফ্লাই করে। ঘণ্টা খানেক যাওয়ার পরই একটি পাহাড় দেখে বুঝতে পারি আমরা নেপাল পৌঁছে গেছি। প্লেনটি ল্যান্ড করবে এমন ভেবে আমরা কথা বলতে বলতে ছবি তুলছিলাম। কিছুক্ষণ পর অস্বাভাবিক ঝাকুনি লেগে প্লেনটি মাটিতে পড়ে যায়। ঝাকুনি খুব বেশি লাগায় বুঝতে পারছিলাম প্লেনটি স্বাভাবিকভাবে ল্যান্ড করেনি। তখনও বুঝতে পারিনি প্লেনটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ততক্ষণে রকিবুল উল্টে সিটের তলায় গিয়ে পড়েছে। একাধিকবার ডাকার পরও তার কোনো সাড়া শব্দ পাচ্ছিলাম না। তখন বুঝতে পারলাম প্লেনটি দুই ভাগ হয়ে গেছে।  অনেকেই বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি সিট বেল খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। সিটবেলটি খুলতে পারলে আমার ক্ষতি কম হতো ও রকিবুলের খবর নিতে পারতাম। ততক্ষণে যে যার মতো বের হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবছিলাম প্লেন দুর্ঘটনায় কেউ বাঁচে না, আমিও হয়তো বাঁচবো না। মারা যাবো ভেবে কালেমা পড়ছিলাম। আমার সামনেও এক নারী কালেমা পড়ছিলেন। প্লেনের পেছন অংশ থেকে ভয়াবহ আগুন আসা শুরু করেছে। প্লেনের ভেতরে যারা ছিলেন তারা আগুনে পুড়তে লাগলেন। ততক্ষণে আমার পিঠ, মাথা, চুল এবং হাতেও আগুন ধরে গেছে। আগুনে পুড়তে থাকায় নিরুপায় হয়ে রকিবুলকে ডাকতে থাকি। কিন্তু তখনও সে কথা বলছিলো না। প্রচণ্ড আগুন ও ধোয়া থাকায় মুখে ওড়না দিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছিলাম। তখন বুঝতে পারি আমার পাশে কেউ একজন আছে। সেভ মি, সেভ মি বলার পর ফায়ার সার্ভিস অথবা সেনাবাহিনীর কেউ এসে আমাকে উদ্ধার করে।  

সেসময় সামনে থাকা ওই নারী ও তার স্বামীকে সেভ করতে বলি। আমি মারা যাবো এমনটাই ভাবছিলাম। পানি পান করতে চাচ্ছিলাম। তারপরের কিছু আর আমার মনে নেই।

নয় দিন পর তার জ্ঞান ফিরে রকিবুলের কথা জানতে চাইলে নেপালে আছে বলে জানায় আমার বাবা। আড়াই মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর দেশে ও ১১ মাস পর বাড়িতে ফিরেছি আমি। এখনও আরো কিছু চিকিৎসা বাকি আছে।
 
হাসি আরো বলেন, আল্লাহ পাক চেয়েছেন বলে আমি এখনো বেঁচে আছি। আইসিইউতে চিকিৎসা নেওয়া অবস্থায়ও আমার চোখে আগুন ভাসতো। শারীরিক ট্রিটমেন্ট সবাই করতে পারে, কিন্তু মানসিক ট্রিটমেন্ট কেউ করতে পারে না।  

যাই হোক পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে চাই আমি। সেখানে সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে চাই।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৪ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৯
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।