তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত আমার বোনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার অন্যতম সহযোগী নূর উদ্দিন। তার মোবাইল কল লিস্ট খতিয়ে দেখে তদন্ত করলে খুব সহজেই উদঘাটন হবে হত্যার রহস্য।
নুসরাত জাহান রাফির দেহে আগুন দেওয়া মুখোশধারীদের মধ্যে নুর উদ্দিনকে সন্দেহ করছেন স্থানীয়রাও। ‘অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা মুক্তি পরিষদ’র নেতৃত্ব দেওয়া এই যুবক স্থানীদের কাছে কেরোসিন তেলের বোতল ও ম্যাচবাক্স উদ্ধারের দাবি করেছিলেন।
সেই নুর উদ্দিন ভালুকায় গ্রেফতার
নুসরাত হত্যা: ঘটনাস্থল পরিদর্শনে মানবাধিকার কমিশন
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬ এপ্রিল ঘটনার দিন নুসরাতকে আগুনে ঝলসে দেওয়ার পরপরই পালানোর চেষ্টা করেছিলেন নুর উদ্দিন। মাদ্রাসার কাছেই একটি ওষুধের দোকানের সামনে এলাকাবাসী তাকে সন্দেহভাজন হিসিবে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। এ সময় তিনি বিব্রতবোধ করেন। এলাকাবাসী সেদিনই সন্দেহ করেছিলেন নুর উদ্দিনের উপস্থিতিতেই নুসরাতের শরীরে আগুন দেওয়া হয়।
আবদুল হামিদ নামে এক স্থানীয় বলেন, নুর উদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলাম—তুই তো আছিলিস ওখানে। উত্তরে নুর উদ্দিন বলছে—আমি ছিলাম, কেরাসিন আর ম্যাচ ছাদ থেকে আনছি।
সোনাগাজী বাজারে ওষুধ বিক্রেতা মো. জহির উদ্দিন বলেন, ভাব-ভঙ্গিমা দেখে মনে হয়েছে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার সময় নুর উদ্দিন ঘটনাস্থলেই ছিলো। পরে জানতে পারছি সে সেখানে ছিলো।
আরেক এলাকাবাসী জানান, ঘটনার পরদিন নুর উদ্দিনকে ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে সে বিব্রতবোধ করে এবং এক পর্যায়ে পালিয়ে যায়।
আরিফ হোসেন নামে আরেক এলাকাবাসী জানান, নুর উদ্দিন বিভিন্ন লোকের ফেসবুক মেসেঞ্জারে সিরাজ উদ দৌলার মুক্তি আন্দোলনে আসার জন্য মেসেজ দিতো। সেই মূলত সিরাজের প্রধান সহযোগী। সে নুসরাত হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত থাকতে পারে।
নুর উদ্দিনের বাড়ি সোনাগাজী চরচান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে গিয়ে স্থানীয় একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার দিন নুর উদ্দিন তার মাকে বলেছিলেন নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার কথা। পরে তার মা তাকে পালিয়ে যেতে বলেন। সেই থেকেই পলাতক ছিলেন নুর উদ্দিন।
শুক্রবার (১২ এপ্রিল) বেলা ১১টার দিকে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে নুর উদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ময়মনসিংহ ব্রাঞ্চ।
গত ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার কেন্দ্রে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায় মুখোশধারীরা।
পরিবারের অভিযোগ, ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা তার কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে স্বজনদের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের চাপ দিয়েও প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় নুসরাতকে আগুনে পোড়ানো হয়। আগুনে ঝলসে যাওয়া নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়।
নুসরাতের শ্লীলতাহানির মামলায় ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা গ্রেফতার হলে তার মুক্তির দাবিতে ‘মুক্তি পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক হন নুর উদ্দিন এবং যুগ্ম-আহ্বায়ক হন শাহাদাত। তাদের নেতৃত্বেই সিরাজ উদদৌলার মুক্তির দাবিতে ২৮ ও ৩০ মার্চ উপজেলা সদরে দুই দফা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি হয়। অভিযোগ পাওয়া যায়, শ্লীলতাহানির মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এরাই নুসরাত ও তার স্বজন-সঙ্গীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিলেন।
নুসরাতের শরীরের আগুন দেয়ার সময় বোরখা পরিহিত ৪ জনসহ নেপথ্যের সব হোতাদের নাম পরিচয় বেরিয়ে আসবে নুর উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই, এমনটাই মনে করছেন নুসরাতে বাবা-ভাই ও অন্যান্য স্বজনরা।
এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই নোমানের দায়ের করা মামলার আসামিরা হলেন—
অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলা, পৌর কাউন্সিলর মকসুদুল আলম, প্রভাষক আবছার উদ্দিন, মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক ছাত্র নুর উদ্দিন, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহম্মদ ও হাফেজ আবদুল কাদের।
এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা সাতদিনের রিমান্ডে আছেন। এছাড়া ওই মাদরাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আবছার উদ্দিন এবং নুসরাতের সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নুর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ জনি, নুসরাতের সহপাঠী ও মামলার প্রধান আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার ভাগনি উম্মে সুলতানা পপি ও আরেক মাদ্রাসার শিক্ষার্থী জোবায়ের আহমেদের ৫ দিন করে রিমান্ড চলছে।
এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে এখনো পলাতক রয়েছেন, সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের শাহাদাত হোসেন শামিম, হাফেজ আবদুল কাদের।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৯
এসএইচডি/এমজেএফ