কথাগুলো বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠলেন মিরপুরের ঝিলপাড়া বস্তির বাসিন্দা রহিমা খাতুন। নিজের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি এ বস্তির বাসিন্দা।
কয়েকটি বাড়িতে কাজ করে সংসার চালানো রহিমা রোববার (১৮ আগস্ট) সকালে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বাংলানিউজকে বলেন, আর কিছুই নাই আমগো। না ঘর, না শোবার জায়গা! পরনের কাপড়টাও পরে আছি আজ তিন দিন ধরে। না ভাত রাধার হাড়ি আছে আর না আছে ভাত খাওয়ার প্লেট। সব চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো! শুধু দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না। শুধু রহিমা খাতুন না, তার মতো আরও একজন মাইনুদ্দিন। জন্ম থেকেই বেড়ে ওঠা এ বস্তিতে। সব মিলিয়ে ৪০ বছরের সংসার। বৃদ্ধ মাকে ঘর থেকে টেনে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় আর কিছুই নিতে পারেননি সঙ্গে করে। এক ছেলে এক মেয়ে আর স্ত্রী শান্তাকে নিয়ে তাই এখন নিজের ঘরের জায়গাটার ওপরেই বসে আছেন একটা পলিথিনের ছাউনি দিয়ে।
কথা হলে মাইনুল বলেন, আমার মা অসুস্থ। আমি মাকে নিয়েছি আর বউ ছেলে-মেয়ে দু’টোকে হাত ধরে নিয়েছে। এর বাইরে আর কিছুই নিতে পারিনি। শুধু দেখতে পেলাম আমার ৪০ বছরের সাধ-আহ্লাদ-স্বপ্ন সব পুড়ে গেলো!
একই অবস্থা বর্তমানে এ বস্তির বাসিন্দাদের। অগ্নিকাণ্ডের তিনদিন পার হলেও এখনো আগুনের আঁচ আসে ছাইয়ের ভেতর থেকে। চারিদিকে শুধু সেই পোড়া ছাইয়ের গন্ধ! আর তার মধ্যেই রাত যাপন করছেন শতশত মানুষ। তবে রাত যাপনের জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা হলেও কেন তারা এখনো বস্তিতে রাত কাটাচ্ছেন, তা জানতে চাইলে মধ্য বয়সী বাবুল হোসেন বলেন, প্রথমত মায়া। হাতের ওপর একটু একটু করে এই জায়গাটাতে নিজের সবকিছু গড়ে তুলেছি। এখন ছেড়ে যাই কী করে! যদিও আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবুও পোড়া আলমারি আর পোড়া টিন যা একটু বেঁচেছে, রাতে চোর এসে যদি সেগুলোও চুরি করে নিয়ে যায়! তাই একটু পাহারা দিতে হয়। ওটুকু ছাড়া আর তো কিছুই নেই। তাই আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকলেও যেতে পারিনি। পরিবারের একেক সদস্য এখন একেক জায়গায় হয়ে গেছে!
বস্তি ঘুরে দেখা যায়, আগুনে পোড়া টিনগুলো এখন বিক্রি হচ্ছে খুবই কম দামে। ক্ষতির পরিমাণ বুঝে তা ৫ টাকা থেকে ২০ টাকা কেজি দরে কিনছে ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা। আর এ টিন বিক্রির টাকা দিয়েই এখন নিজেদের খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করছে ঝিলপাড়া বস্তিবাসী।
এ প্রসঙ্গে বস্তির বাসিন্দা মিলন হোসেন বলেন, লোহা-লক্কর আর টিন বিক্রি করেই এখন খাবারের টাকা সংগ্রহ করতে হচ্ছে। রাতে এখানে থাকছি টিন সোজা করে তার ওপর। ৫০০ টাকার টিন এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ৫ টাকায়!তবে এত হারানোর ভিড়েও নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন বলে মনোবল যোগানোর শক্তি খুঁজছেন সবাই। তাইতো মাইনুদ্দিন, রহিমা অথবা মিলনের মতো মানুষগুলো বলতে পারেন, ‘কী করবো জানিনা! তবে কিছু একটা তো করতেই হবে। সবকিছু ভুলে আবার সব শুরু করতে হবে নতুন করে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৯
এইচএমএস/এইচএডি