ঢাকা, রবিবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৮ জুলাই ২০২৪, ২১ মহররম ১৪৪৬

জাতীয়

পিস ফর এশিয়ায় মো. নাজমুস সাকিব খানের নিবন্ধ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অগ্রগতির ৫০ বছর বনাম পাকিস্তানের পশ্চাৎপদতা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অগ্রগতির ৫০ বছর বনাম পাকিস্তানের পশ্চাৎপদতা

এমন এক বিশ্ব কল্পনা করুন যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা অত্যন্ত উচ্চমানের জীবন উপভোগ করছে এবং রাস্তার একেবারে বিপরীত কোণে একজন দরিদ্র বাঙালি শিশু, যার বাবা-মাকে পাকিস্তান মিলিটারি নির্মমভাবে খুন করেছে- সে একমুঠো ভাতের জন্য লড়াই করছে। ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত এমনই চিত্র ছিল পূর্ব পাকিস্তানে।

পশ্চিম পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনব্যবস্থা ব্যাপক বৈষম্য তৈরি করে বাঙালির জন্য। সম্পদের বরাদ্দ এবং বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বৈষম্য তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকরা।

আজো বাংলাদেশে বৈষম্যের উপস্থিতি দৃশ্যমান। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যা ধনী ব্যক্তিদের বৈষম্যমূলক আচরণ করতে শেখায় এবং দরিদ্ররা সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী অভিজাতদের জীবনধারার সঙ্গে মিশতে পারে না। তবে বাংলাদেশ বিশ্বকে সর্বকালের অন্যতম সেরা অর্থনৈতিক উদ্ভাবন উপহার দিয়েছে। আর সেটি হলো ক্ষুদ্র ঋণ। এটি সারা বিশ্বজুড়ে আর্থিক সক্ষমতা বাড়িয়ে লাখ লাখ পরিবারকে উন্নত জীবনের ছোঁয়া পেতে সহায়তা করেছে।

অমর্ত্য সেন তাঁর ‘দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ’ গ্রন্থে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন। ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ কিভাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল তা পাঠকদের জন্য বাস্তবিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি। বিশ্বব্যাপী সমস্যার শিকড় খুঁজে পেতে অর্থনীতিতে খাদ্যপ্রাপ্যতার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করা হয় গ্রন্থটিতে।

কিন্তু দিন বদলেছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার গর্বের সঙ্গে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জায়গা দিয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে একটি অনুকরণীয় কীর্তি উপস্থাপন করছে। বাংলাদেশে খাদ্য অভাবের অস্তিত্ব নেই। সবার জন্য শিক্ষার অধিকার জাতীয় এজেন্ডা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দক্ষতার হার এবং মাথাপিছু খাদ্য তৈরির হারে প্রসার ঘটেছে। পিপিপির ভিত্তিতে এই গ্রহের ৪৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে দেখিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

বর্তমানে গ্রামকেন্দ্রিক ঋণদান নীতি গ্রামীণ বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সহায়তা করার জন্য জরুরি। মাইক্রোক্রেডিট এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তারা এখন ছোট বা মাঝারি ধরনের ব্যবসা শুরু করার জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে পারছে। এই আর্থিক প্রকল্পগুলো প্রাথমিকভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষকে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের অনন্য দক্ষতা এবং প্রতিভা ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছে সরকার।

২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি মাথাপিছু ৩২২ ডলারে উন্নীত হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে আইএমএফ, যেখানে পাকিস্তান তার বর্তমান অবস্থা থেকে অর্ধেকেরও বেশি উন্নতি করতে পারবে। আইএমএফের এমন তথ্য বলছে, যে গড় বাংলাদেশি নাগরিকরা পাকিস্তানিদের তুলনায় বেশি ধনী। বাংলাদেশের মাথাপিছু ঋণ (৪৩৪ ডলার) পাকিস্তানের (৯৭৪ ডলার) তুলনায় অনেক কম।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরপরই পাকিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করে। তবে ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের পর থেকে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে। বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত স্বল্প প্রসারিত হয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি পাকিস্তানের তুলনায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বেড়েছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশের মোট সঞ্চয় (জিডিপির%) ছিল ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ২০১২ সালে পাকিস্তানের ছিল ২০ দশমিক চার শতাংশ। আর ২০১৩ সালে পাকিস্তানের মোট সঞ্চয় ছিল ২০ দশমিক আট শতাংশ। এটি যুক্তিসঙ্গতভাবেই প্রত্যাশা করা যেতে পারে যে ৪২তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ থেকে বাংলাদেশ ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হবে।

২০১৭ সালের মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) অনুসারে, বাংলাদেশের মান প্রায় শূন্য দশমিক ৬০৮-এর কাছাকাছি ছিল। আর ২০১৮ সালের পাকিস্তানের এইচডিআই মান ছিল শূন্য দশমিক ৫৬০, যা দেশকে মাঝারি মানব উন্নয়ন বিভাগে রেখেছে। তদনুসারে ১৮৯ দেশ ও অঞ্চলগুলোর মধ্যে ১৫২ নম্বরে অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান।

বিদেশি সহায়তার ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমেছে। ১৯৭২ সালে ৮৮ শতাংশ ছিল। সেখানে থেকে ২০১০ সালে মাত্র ২ শতাংশ কমেছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের গঠনের পর থেকে আফগানিস্তানের রাজনীতিতে এবং পার্সিয়ান উপসাগরের ঘনিষ্ঠতার কারণে বিদেশি সহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করছে দেশটি।

পদ্মা বহুমুখী সেতুর সফল অগ্রগতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বাংলাদেশ তার প্রাসঙ্গিকতার এক নতুন অর্থ জাগিয়ে তুলেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বকে দেখিয়েছে তার সক্ষমতা। বিদেশি সংস্থার সম্পূর্ণ সমর্থন ছাড়াই মেগা অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করার ক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের- সেটাও দেখিয়েছে।

বাংলাদেশের দুর্বল প্রশাসন ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিষয়টি সাধারণ। তবে পাকিস্তানে যতটা অগোছালো ততটা নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সন্ত্রাসবাদী হুমকির মূলোৎপাটন করার জন্য সরকার স্পষ্টভাবে কাজ করেছে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার ক্ষেত্রে পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। সেই সঙ্গে দেশটিতে শান্তি ও সহনশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত শোচনীয় পরিস্থিতি দেখা গেছে। বাংলাদেশ নিজেকে ধর্মীয় সহনশীলতা এবং শান্তির আদর্শ উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

জামায়াতের রাজনীতি এবং সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। এ ছাড়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের সদস্যরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, তা ছিল একেবারে নির্মম। ‘ইসলাম’ একটি শান্তিপূর্ণ ধর্ম, এবং একাত্তরে জামায়াত যে প্রচেষ্টা ও কাজ করেছিল তা ইসলামের মূল্যবোধের মধ্যে পড়ে না। বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত পাকিস্তানের।

এটা অস্বীকার করার মতো বিষয় নয় যে, ১৯৭১ সালে তৈরি করা ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য ইসলামাবাদের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা বাংলাদেশের প্রাপ্য। পরাজিত রাষ্ট্রের ক্ষতিপূরণ দেওয়াটাও বাংলাদেশের প্রাপ্য। নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষতিপূর্ণ দেওয়া এখনও সম্ভব পাকিস্তানের জন্য। আর এটি হতে পারে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে। (সংক্ষেপিত)

সূত্র : পিস ফর এশিয়া

বাংলাদেশ সময়: ২০১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০২০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।