বাগেরহাট: স্বাধীনতার ৪৯ বছরে অরক্ষিত ও অবহেলিত রয়েছে বাগেরহাটের শাখারীকাঠি বধ্যভূমি। অরক্ষিত থাকায় স্বাধীনতার ২৮ বছর পরে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটিও বিবর্ণ হয়ে গেছে।
তাই জায়গাটি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে শহীদদের স্মৃতি অম্লান করে রাখার দাবি স্থানীয়দের। এছাড়া সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো শহীদ পরিবারগুলোকে সম্মানিত করার দাবি জানিয়েছেন নিহতের স্বজনরা।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ০৫ নভেম্বর বিকেলে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার শাখারীকাঠি বাজারে হানা দেয় রাজাকার বাহিনী। তখন ৪৫ জনের মতো মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে রাজাকাররা। তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক গবেষকের মতে- এই সংখ্যা ছিল ১২৫ জনের ওপরে। পরের দিন ০৬ নভেম্বর সকালে পার্শ্ববর্তী বিষখালী নদীর তীরে মরদেহগুলো পুঁতে রাখা হয়। স্থানীয়রা এতই ভীত সন্ত্রস্ত ছিল যে, স্বজনদের মরদেহগুলোর সৎকার করারও সাহস পায়নি।
স্বাধীনতার পর দেশ স্বাভাবিক হলেও, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাটিকে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ ছিল না। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে ৩১ জন শহীদের নাম সম্বলিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয় শাখারীকাঠিতে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্নের অভাবে স্মৃতিস্তম্ভটির নামগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেছে। নিচ থেকে পলেস্তারাও খুলে যাওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে। স্থানীয়রা যত্রতত্র স্মৃতিস্তম্ভটির গা ঘেঁষে মোটরসাইকেল রাখছে। এছাড়াও জায়গাটি ব্যবহৃত হচ্ছে আনুসঙ্গিক বিভিন্ন কাজে। তাই এখনই এই বধ্যভূমিকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা হলে, এক সময় শহীদদের এই স্মৃতি চিহ্নটুকুও হারিয়ে যাবে। কালের গহব্বরে ভুলে যাবে শহীদদের আত্মহুতির কথা।
গণহত্যায় নিহত মনিলাল দাসের ছেলে বৃদ্ধ আনন্দ লাল দাস বাংলানিউজকে বলেন, বাবাসহ এলাকার ৪৫ জন মানুষকে এক সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে রাজাকাররা। আমাকেও পিটিয়ে ছিল তারা। পরের দিন মরদেহগুলো বিষখালী নদীর তীরে নিয়ে পুঁতে ফেলে তারা।
১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর অনেক কষ্টে বড় হয়েছি। কখনও সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি। এখন মরার সময় হয়ে গেছে। মরার আগে শাখারীকাঠি বদ্ধভূমিকে স্থায়ীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ এবং সরকারিভাবে শহীদ পরিবার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
শহীদ মহাদেব চন্দ্র দাসের মেয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) কর্মকর্তা অলোকা দাস বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনার দিন ছিল আমাদের এখানের শাখারীকাঠি বাজার। আমার বাবা ছিলেন বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বিকেলে আমি বাবার কাছে এসেছিলাম খাবার খেতে। বয়সে অনেক ছোট থাকলেও যতদূর মনে পড়ে, বন্ধুকধারী অনেক লোকজন এসে আমার বাবাসহ বাজারে থাকা সবাইকে বেঁধে ফেলে। পরে নির্বিচারে গুলি করে সবাইকে হত্যা করে। বয়সে ছোট থাকায় হয়তো সেই দিন বেঁচে গেছি। কিন্তু বাবাকে হত্যা করায় আমাদের সংসারে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। মা ও চার ভাই-বোন নিয়ে শুরু হয় মানবেতর জীবন-যাপন। একইসঙ্গে আমাদের চার ভাই-বোনের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াও একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে মায়ের অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে আমরা সবাই মোটামুটি জীবন-যাপন ও লেখাপড়া শিখে কর্মজীবনে পা রাখি। বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এত কষ্ট হতো না। আমাদের ছাত্র জীবনেই জীবিকার তাগিদে কাজও করতে হতো না। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে বাবার মৃত্যু হয়। সারা জীবনের জন্য বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমরা। এখন আমাদের বয়সও প্রায় শেষ পর্যায়ে। বেঁচে থাকতে থাকতে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই। আশা করি, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতদের শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করবেন।
শুধু এরা নয় অন্যান্য নিহতের স্বজনদেরও একই দাবি- সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে শহীদের মর্যাদা দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হোক।
স্থানীয় বৃদ্ধ দেলোয়ার শিকদার বাংলানিউজকে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শাখারীকাঠি বাজারে লাইন দিয়ে এত লোক হত্যা করা হলো। কিন্তু ৯০ এর দশকে শাখারীকাঠি বধ্যভূমি তৈরি করা হলেও জায়গাটি এখনও অরক্ষিত রয়েছে। জায়গাটিকে সংরক্ষণ করে শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই।
স্থানীয় আরও কয়েকজন বাংলানিউজকে জানান, ১৯৯৮ সালের দিকে তৈরি করা শাখারীকাঠি স্মৃতিস্তম্ভটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন ধ্বংসের দারপ্রান্তে। তাই সবার দাবি- যত দ্রুত সম্ভব স্মৃতিস্তম্ভটি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হোক।
গণহত্যায় নিহত নকুল দাসের ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা নিমাই দাস বাংলানিউজকে বলেন, সরকার আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করেছেন, আমরা এজন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে অনেক মানুষ শহীদ হয়েছেন। অনেক পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিকেও হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে শহীদ পরিবারগুলো অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সরকারের কাছে দাবি জানাই- সরকার যেন শহীদ পরিবারগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে সম্মানিত করেন।
কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুজিত দেবনাথ বাংলানিউজকে বলেন, শাখারীকাঠির যেখানে বদ্ধভূমি রয়েছে। শহীদদের স্মরণে সেখানে ২০ শতাংশ জমির ওপর একটি মনুমেন্ট করার প্রক্রিয়া রয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা জমির স্কেচ ও আনুসঙ্গিক কাগজপত্র প্রস্তুত করে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। আশা রাখছি খুব দ্রুতই কাজ শুরু করতে পারবো।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০২০
এসআরএস