সিলেট: অন্ধকার কেটে গেলেও ভোরের কুয়াশা তখনও কাটেনি। রাস্তার বাম লেনে পণ্যবোঝাই একটি ট্রাক দাঁড় করিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যান চালক।
বিস্ফোরণের সময় গাড়ির একটি ধাতব অংশ ছুটে গিয়ে ৩শ ফুট দূরে কলোনির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ৭ বছরের শিশু হাসানের শরীরে আঘাত করে। প্রচুর রক্তপাত হওয়ায় হাসপাতালে নেওয়ার পরই শিশুটি মারা যায়।
বুধবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোরে সিলেট-বিয়ানীবাজার সড়কের হেতিমগঞ্জে ঘটে যাওয়া এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন বেঁচে যাওয়া তিন যাত্রী ও স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দা মনু মিয়া বলেন, ‘ভোরে আমি বাড়ির সামনে হাঁটাহাটি করছিলাম। এ সময় বিকট শব্দ পেয়ে পেছনে ফিরে দেখি দাউ দাউ করে একটি মাইক্রোবাসে পুড়ে যাচ্ছে। এর পেছনে বেঁচে যাওয়া তিনজনের আর্তনাদ। চোখের সামনে স্বজনদের পুড়ে মরতে দেখছিলেন তারা। কিন্তু কিচ্ছু করার ছিলো না তাদের। আগুনের এত উত্তাপ, আর বিস্ফোরণে কাছে যাওয়া ছিলোই দুষ্কর। খানিক পরে আহতরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। মাইক্রোবাসে আগুন লাগার ঘটনা দূর থেকে দেখছিল পার্শ্ববর্তী রফিপুর কলোনির শিশুরা। এ সময় ছুটে আসা জ্বলন্ত একটি ধাতব টুকরা আঘাত করে শিশু হাসানের (৭) উরুতে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে থাকে। শিশুটিকে বাঁচাতে প্রাণান্তর চেষ্টা করেন তার বাবা-মা। সকাল বেলায় গাড়ি না পাওয়ায় নিজের পিকআপভ্যান বের করে শিশু সন্তানকে নিয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছলেও বাঁচাতে পারেননি মঞ্জুর আহমেদ। হাসপাতালের চিকিৎসক ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেন’।
এদিকে গাড়ি থেকে বের হওয়া কিশোর অবস্থান করেন গোলাপগঞ্জ উপজেলার তার খালার বাড়িতে। অন্য দুই জন চলে যায় বিয়ানীবাজারের চারখাই গ্রামের বাড়িতে। ততক্ষণে দুর্ঘটনাস্থল লোকে লোকারণ্য। খবর পেয়ে দমকল বাহিনী এসে আগুন নেভায়। কিন্তু সবার চোখের সামনে যে দৃশ্য প্রতীয়মান হয় তা ছিলো কেবল অঙ্গার হওয়া তিন কঙ্কাল। গাড়ির অবস্থাও দেখে বোঝার উপায় নেই-কি গাড়ি, ড্রাইভিং সিট কোনো দিকে, আর কোনো দিকটা পেছন। এমন মন্তব্য প্রত্যক্ষদর্শীদেরও।
নিহতের স্বজনরা জানান, বিয়ানীবাজারের চারখাই গ্রামের কুনু মিয়ার ছেলে মদন মোহন কলেজের বিএসএস পড়ুয়া রাজন (২২) রাতে ভাতিজাকে নিয়ে হাসপাতাল যান। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে ফেরার পথে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে। রাজনের সঙ্গে দগ্ধ হয়ে মারা যান গাড়িচালক বিয়ানীবাজারের চারখাই গ্রামের সোনা মিয়া (২৪)। তবে অন্য জনের মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি। ধারণা করছেন নিহত অপর লোকটিকে হয়তো রাস্তা থেকে গাড়িতে তোলা হয়েছে।
বিয়ানীবাজার থেকে আসা আজিজুর বলেন, নিহত রাজন ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। আর নোয়াহ চালক সোনা মিয়ার এক ভাই প্রবাসে থাকেন। আহতদের মধ্যে কিশোরটি গোলাপগঞ্জ তার খালার বাসায় এবং অন্য দুইজন বাড়িতে চলে গেছেন।
গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, নিহতদের তিন জনের পরিচয় নিশ্চিত হতে পেরেছি। আরেকজনের পরিচয় জানা যায়নি। গাড়িতে মোট ৬ জন ছিল। ছয় জনের মধ্যে তিন জনই মারা গেছে। আর শিশুটি একটি কলোনির সামনে খেলা করছিল। সেখানে প্রায় ৩শ ফুট দূরে গিয়ে গাড়ির ধাতব টুকরা উড়ে গিয়ে তার ওপর পড়ে। এতে শিশুটি গুরুতর আহত হয়। পরে তাকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত্যু ঘোষণা করেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়া সিলেটের সহকারী পুলিশ সুপার (দক্ষিণ সার্কেল) রাশেদ আহমদ বলেন, ‘মাইক্রোবাসটি দাঁড়ানো ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দিলে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে ৩ জন দগ্ধ হন। চালকসহ গাড়িতে ৬ জন ছিলেন। ৩ জন পেছনের গ্লাস ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ায় বেঁচে যান। পুড়ে যাওয়া মরদেহগুলোর সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং অন্য মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ সূত্র জানায়, নিহতদের মধ্যে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এক জনের মরদেহ এসে হাসপাতালে পৌঁছেছে। তবে পুড়ে অঙ্গার দেহের কেবল কঙ্কাল অবশিষ্ট আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০২০
এনইউ/এএটি