মেহেরপুর: অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন মা, আর দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে গেছেন বাবা। তারপর থেকেই এতিম হয়ে পড়েছে চারটি শিশু সন্তান।
অন্য শিশুর সঙ্গে খেলার পরিবর্তে ছোট তিনটি ভাই-বোনের দায়িত্ব মাথায় শিশু আশিকের। তাই, এখন সকাল থেকে গভীর রাত অবধি চায়ের কাপেই স্বপ্ন বুনন হয় আশিকের।
আশিকের বয়স এখন তেরো। অন্য শিশুদের মতো তারও স্বপ্ন ছিল স্কুলে যাওয়ার। অথচ, এখন তাকে স্কুলব্যাগ নয়, তুলে নিতে হয়েছে সংসারের বোঝা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চা বিক্রি করে ছয় সদস্যের সংসার চালাতে হচ্ছে তাকে। এ যেন মহাকাব্যের কোনো গল্পকেও হার মানানোর মতো।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ধানখোলা ইউনিয়নের কসবা গ্রামের স্থানীয় বাজারের ছোট্ট চা দোকানি শিশু আশিক। ১০ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছে। আর ১১ বছর বয়সে হারিয়েছে বাবাকে।
আশিক বাংলানিউজকে জানায়, তার বাবা থেকেও নেই, আর মাকে হারিয়েছে চিরতরে। বৃদ্ধ দাদা লালন হোসেন আছেন। তাও অ্যাজমা রোগী। দাদী সালমা খাতুনও অসুস্থ। তার ওপর তার তিন ভাই-বোন একেবারেই শিশু। আশিক সবার বড়। ছোট বোন কুলছুম (৯) প্রথম শ্রেণিতে, ছোট ভাই মুস্তাকিম (১০) তৃতীয় শ্রেণি ও রিয়াজ (৬) পড়ে শিশু শ্রেণিতে। সেও (আশিক) চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে ছোট ভাই-বোনসহ দাদা-দাদীর ক্ষুধার জালা মেটাতেই বই-খাতা ফেলে চায়ের কেটলির হাতল ধরেছে সে। নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে ছোট ভাই-বোনকে মানুষ করার জীবন সংগ্রামে নেমেছে। এখন নিজেকে নিয়ে নয়, স্বপ্ন দেখে ভাই-বোনদের নিয়ে।
আশিকের দাদা লালন হোসেন বাংলানিউজকে জানান, আশিকের মা মোনোয়ারা খাতুন অসুস্থ ছিল। আর তার (আশিকের) বাবা রাশেদুল ইসলাম প্রতিবেশী উম্বিকা খাতুন নামে এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে এবং উম্বিকাকে দ্বিতীয় বিয়ে করে চার সন্তান আর মোনোয়ারাকে ফেলে চলে যান রাশেদুল। এ ঘটনায় মনোয়ারা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে অবহেলা আর অনাদরেই মারা যান তিনি। কিছুদিন ছেলে-মেয়েগুলোকে ভরণ-পোষণ দিলেও পরে তাদের ফেলে দ্বিতীয় স্ত্রীর বাবার বাড়িতে চলে যান পাষণ্ড রাশেদুল।
লালন হোসেন আরও জানান, তার নিজের একটি চায়ের দোকান ছিল। যেটা বন্ধ হয়ে যায় তিনি সুস্থ থাকার কারণে। যে কারণে তার ছেলের ফেলে যাওয়া চার সন্তানকে তার পক্ষেও ভরণ-পোষণ দেওয়া অসাধ্য হয়ে পড়ে। তবে বিষয়টি জানতে পেরে সাবেক গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিলারা রহমান প্রায়ই তার বাড়িতে আসতেন। শিশুগুলোকেও মায়ের স্নেহ দিয়ে কোলে তুলে নিতেন। সব জানার পর বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই চায়ের দোকানটি চালু ও ভালো করে চালানোর জন্য নগদ টাকা, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র শুরু করে সব দিয়েছেন ইউএনও দিলারা রহমান। পরে আশিক সেই দোকান ভালোভাবে পুনরায় চালু করে।
দোকানে প্রতিদিন ৫-৭শ’ থেকে শুরু হয়ে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে ২-৩শ’ টাকা লাভ থাকে। তবে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসারের খরচ এবং ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হয়। কারণ কোনোদিন বিক্রি হয় কম, কোনোদিন মোটামুটি।
তিনি আরও জানান, মাটির একটি ঝুপড়ি স্যাঁত স্যাঁতে ঘরে সবাই মিলে বসবাস করতেন লালন হোসেন। পরে ভালোভাবে থাকার জন্য একটি ঘরও নির্মাণ করে দিয়েছেন ইউএনও দিলারা রহমান। এখন সেখানেই থাকেন। এছাড়া ভালো করে দোকান চালানোর জন্য নগদ আট হাজার টাকা দিয়েছেন সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) আতাউল গণি। এছাড়া কিছু জনপ্রতিনিধি, সামাজিক সংগঠনও করোনাকালীন সময়ে এ পরিবারটির প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন।
ধানখোলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আখের আলী বাংলানিউজকে বলেন, লালন হোসেন ও তার চার নাতি-নাতনিকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতাও করা হয়েছে পরিবারটিকে।
চেয়ারম্যান আখের আলী আরও বলেন, পাষণ্ড বাবা রাশেদুলের কারণে চারটি সন্তান ও তার বাবা-মায়ের আজ এ দুর্দশা। প্রতিবেশীরা এতিম চার শিশু আর তাদের বৃদ্ধ দাদা-দাদীর খবর নিলেও খোঁজ নেন না রাশেদুল।
বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরএম সেলিম শাহনেওয়াজ বাংলানিউজকে বলেন, অসহায় হয়ে পড়া ওই শিশুগুলো জন্য সরকারিভাবে সব সহযোগিতা দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
এসআরএস/