‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি’ এ প্রবাদ বাক্যটির যেন জ্বলন্ত উদাহরণ চট্টগ্রাম-১২ পটিয়া আসনের এমপি ও হুইপ শামসুল হক চৌধুরী। নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে সমালোচিত হুইপ শামসুল হক চৌধুরী ও তার পুত্র নাজমুল হক চৌধুরী শারুনের বিরুদ্ধে এবার উঠেছে শত বছরের পুরনো পটিয়া থানা মসজিদ দখল করে বহুতল মার্কেট নির্মাণের অভিযোগ।
হুইপ ও তার পুত্রের এমন অপকর্ম নিয়ে মুখ খুলতে চান না পুলিশ প্রশাসনের কেউ। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পটিয়া থানা জামে মসজিদের ২২ গন্ডা জমি দখল করে তাতে ১০ তলা অভিজাত মার্কেট নির্মাণের পাঁয়তারা করছে স্থানীয় এমপি শামসুল হক চৌধুরী ও তার পুত্র শারুন চৌধুরী। এরই মধ্যে তাদের অনুসারী এক নেতাকে দিয়ে কথিত মসজিদ পরিচালনা কমিটি গঠন করেছে। পরিবর্তন করে দিয়েছে মসজিদের নাম। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন কথিত মসজিদ কমিটি বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডেভেলপমেন্ট চুক্তিও করেছে। এরই মধ্যে মসজিদ ভেঙে ১০ তলা মার্কেট করে তাতে ৪০০টি দোকান তৈরির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছে। একেকটি দোকান বরাদ্দ দেওয়ার জন্য ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বহুতল এ মার্কেট থেকে দেড় শ কোটি টাকা লুটপাটের পরিকল্পনা রয়েছে হুইপ পরিবারের। তাদের এমন অপকর্মের প্রতিবাদ করায় হুইপ ও তার পুত্রের রোষানলে পড়েছেন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। এ নিয়ে পুলিশে চরম অসন্তোষ চলছে। ’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পটিয়া আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘ছোটকাল থেকে এটি থানা মসজিদ হিসেবে চিনে আসছি। কয়েক বছর আগে হুইপ ও তার পুত্র নেপথ্যে থেকে দখল করে নেয় ওই মসজিদের জায়গা। গঠন করে নতুন মসজিদ কমিটি। পরিবর্তন করে ফেলে মসজিদের নামও। এর মধ্যে মসজিদ ভেঙে মার্কেট নির্মাণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছে। তাদের এমন অপকর্মে আমরা বিব্রত। ’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৮৯০ সালে ২২ গন্ডা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পটিয়া থানা জামে মসজিদ’। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পটিয়া সার্কেলের এএসপি কিংবা থানার অফিসার ইনচার্জ সভাপতি এবং মুসল্লিদের পক্ষ থেকে একজন সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়ে মসজিদ পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৪ সালে পটিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ ও এ আহমদের যৌথ স্বাক্ষরে জনতা ব্যাংকের পটিয়া শাখায় ‘থানা মসজিদের’ নামে একটি যৌথ হিসাবও খোলা হয়। সরকারি বিভিন্ন দলিলেও স্থাপনাটি ‘পটিয়া থানা জামে মসজিদ’ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। গত এক দশকে পটিয়ার প্রাণকেন্দ্রে জমির দাম বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ফলে ‘পটিয়া থানা জামে মসজিদ’-এর জায়গার ওপর কুদৃষ্টি পড়ে স্থানীয় এমপি শামসুল হক চৌধুরী ও তার পুত্রের। মসজিদের জায়গা দখল করতে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ২০১৩ সালে এমপি তার অনুসারী এবং তৎকালীন পৌর মেয়র হারুনুর রশিদকে সভাপতি করে সাত সদস্য বিশিষ্ট কথিত মসজিদ পরিচালনা কমিটি গঠন করে। মসজিদের ওই জায়গায় ১০ তলা বহুতল মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেয় হুইপ ও তাদের অনুসারীরা। ৫০:৫০ চুক্তিতে মার্কেট নির্মাণের জন্য চুক্তি করা হয় বিএনপি ও জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতাকারী প্রতিষ্ঠান ‘নুসরাত ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডে’-এর সঙ্গে। এ ডেভেলপার কোম্পানির মালিকদের একজন হচ্ছেন উপজেলা বিএনপির নেতা শফিকুল ইসলাম চেয়ারম্যান। কোম্পানির বাকি মালিকরাও বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
২০১৮ সালে পটিয়া থানা জামে মসজিদের নাম পাল্টে ‘পটিয়া থানা ছদু তালুকদার জামে মসজিদ কমপ্লেক্স’ নামকরণ করে হুইপ পরিবার ও তার অনুসারীরা। অবৈধভাবে গঠিত কথিত মসজিদ কমিটি বাতিল এবং নুসরাত ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিলের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৯ সালে পটিয়ার সিনিয়র সহকারী জজ প্রথম আদালত প্রদত্ত এক রায়ে ‘পটিয়া থানা ছদু তালুকদার জামে মসজিদ’ ও ‘নুসরাত ডেভেলপমেন্ট কোম্পানী লিমিটেডে’র সঙ্গে করা চুক্তি অবৈধ এবং কথিত সোলেহনামা সবকিছু অবৈধ ঘোষণা করেন। কিন্তু এ রায়ের তোয়াক্কা না করে হুইপ শামসুল হক চৌধুরী, তার পুত্র নাজমুল হক চৌধুরী শারুন এবং তাদের অনুসারীরা মসজিদের জায়গায় ১০ তলা মার্কেট করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। দোকান বরাদ্দের নামে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে দোকান প্রতি ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। ‘পটিয়া থানা ছদু তালুকদার জামে মসজিদ কমপ্লেক্স’ থেকে দেড় শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা চলছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর অনুসারী হারুনুর রশীদের বাড়ি পটিয়া থানা মসজিদ থেকে কমপক্ষে ৪ কিলোমিটার দূরে। তিনি কোনো সময়ই পটিয়া থানা মসজিদ কমিটির দায়িত্বে ছিলেন না। মূলত পটিয়া থানা জামে মসজিদের জমি আত্মসাৎ করতেই হঠাৎ করে তাকে সভাপতি করে কথিত মসজিদ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কথিত এ কমিটির নেপথ্যে রয়েছে হুইপ শামসুল হক চৌধুরী ও তার পুত্র শারুনের দেড় শ কোটি টাকার বাণিজ্য।
(সৌজন্য: বাংলাদেশ প্রতিদিন)
বাংলাদেশ সময়: ১০১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২১
নিউজ ডেস্ক