ঢাকা: ইউরোপে ধারাবাহিক মানবপাচারের কারণে কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা আশিকের নাম হয়ে যায় ইউরো আশিক। যিনি নৌপথে ইউরোপে মানবপাচারকারী ‘রুবেল সিন্ডিকেটের’ প্রধান সমন্বয়ক।
চক্রটি ইউরোপ যেতে ইচ্ছুকদের নির্বাচিত করে ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই হয়ে লিবিয়া পাঠায়। এ যাত্রায় একটি এয়ারলাইন্সের যোগসাজশের তথ্য পাওয়া গেছে। নির্ধারিত টাকা পরিশোধ হলে সুবিধামতো সময়ে ভূমধ্যসাগর হয়ে নৌকাযোগে বিপজ্জনক ইউরোপযাত্রা শুরু হয়।
শনিবার (১০ জুলাই) রাত থেকে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৮ এর সমন্বিত অভিযানে মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী এলকা থেকে ইউরো আশিকসহ (২৫) এই চক্রের সাত সদস্যকে আটক করা হয়।
আটক অন্যরা হলেন- আজিজুল হক (৩৫), মিজানুর রহমান মিজান (৪৩), নাজমুল হুমা (৩১), সিমা আক্তার (২৩), হেলেনা বেগম (৪২) ও পলি আক্তার (৪৩)।
এসময় তাদের কাছ থেকে ১৭টি পাসপোর্ট, ১৪টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ২টি এটিএম, ১৫টি ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার বই, ২টি হিসাবের নথি, ২টি এনআইডি কার্ড, ১০টি মোবাইল ফোন ও নগদ ৫৬ হাজার ৬৭০ টাকা উদ্ধার করা হয়।
রোববার (১১ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, আটক আশিক ২০১৭ সালে এইচএসসিতে অকৃতকার্য হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যান। সেখানে দুই বছর অবস্থান করে মামা রুবেলসহ চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে মানবপাচারের কৌশল রপ্ত করে দেশে ফেরেন। এরপর ২০১৯ সাল থেকে দেশে অবস্থান করে রুবেল সিন্ডিকেটের মূল সমন্বয়ক হিসেবে মানবপাচারের কাজ চালিয়ে আসছেন।
আটক চক্রটি দেশের মাদানীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর এলাকায় বেশ সক্রিয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার টালি খাতা অনুযায়ী এই অঞ্চলের অন্তত ৭০-৮০ জনকে ইউরোপে পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে সিলেট-সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায়ও তাদের এজেন্ট রয়েছে বলে জানা যায়।
ইউরোপযাত্রা সমাপ্ত হলে ভিকটিমদের নামের পাশে টিক চিহ্ন দেওয়া হতো, কিন্তু খাতায় ১১ জনের নামের পাশে টিক চিহ্ন দেওয়া নেই। এই ১১ জনের কোনো তথ্যও তারা দিতে পারেননি। সবশেষ গত ১৯ তারিখেও ১৩ জনকে পাচার করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়।
দুবাই বসেই মানবপাচার নিয়ন্ত্রণ রুবেলের, দেশে তার পারিবারিক সিন্ডিকেট
রুবেল ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত লিবিয়ায় অবস্থানকালে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ হয়। পরে লিবিয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসে রুবেলের বিরুদ্ধে মানবপাচার সংক্রান্ত অভিযোগ থাকায় দুবাইয়ে অবস্থান করে সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন। দেশ থেকে আশিকের নির্ধারিত লোকদের নামে অনলাইনে ভিসা ইস্যু করে দুবাই নিয়ে যান রুবেল। এরপর তাদের লিবিয়ার বেনগাজীতে পাঠান, সেখান থেকে চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে ত্রিপোলিতে নিয়ে নৌযাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হয়।
আর দেশে রুবেলের ভাগিনা আশিক, স্ত্রী সীমা, দুই বোন হেলেনা ও পলি দেশ থেকে ইউরোপ যেতে ইচ্ছুকদের নির্বাচনসহ সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। সব ধরনের অর্থিক লেনদেনও হয় তাদের অ্যাকাউন্টে।
তিন ধাপে ইউরোপ পাচার
প্রথমে চক্রের এজেন্টরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে স্বল্প আয় ও স্বল্প শিক্ষিতদের নির্বাচিত করে। এরপর তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও অন্য নথি নিয়ে নেয়। ইউরোপযাত্রার জন্য প্রত্যেকের সঙ্গে ৭-৮ লাখ টাকার চুক্তি হয়। প্রথমে ৪-৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়, আর লিবিয়া পৌঁছানোর পর বাকি টাকা নেওয়া হয় স্বজনদের কাছ থেকে।
ভিসা পাওয়া, টিকিট কাটা থেকে সার্বিক প্রক্রিয়া চক্রের সদস্যরা করেন। এয়ারপোর্টে পৌঁছার আগে পাসপোর্টসহ সব নথি চক্রের হাতেই থাকে।
পরের ধাপে ট্যুরিস্ট ভিসায়, ক্ষেত্র বিশেষে বিজনেস ভিসায় তাদের প্রথমে দুবাই নেওয়া হয়। সেখান থেকে ‘মারাকাপা’ ডকুমেন্টস সংগ্রহ করে ভিকটিমদের লিবিয়া পাঠান রুবেল। আর এই ট্রানজিটে একটি এয়ারলাইন্সের যোগসাজশের তথ্য পাওয়া গেছে। এয়ারলাইন্স এজন্য বাড়তি অর্থ না নিলেও ট্রানজিটের মাধ্যমে ভিকটিমদের পৌঁছে দিতো লিবিয়ায়।
লিবিয়ার বেনগাজী থেকে চক্রের সদস্য গাজী, কাজী ও বাবুল ভিকটিমদের রিসিভ করে ত্রিপোলি নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে শুধু বাংলাদেশ না অন্য দেশ থেকে পাচারের জন্য আনা লোকদেরও রাখা হতো। সেখানে অবস্থানকালীন পুরো টাকা পরিশোধ করলে সুবিধামতো সময়ে রাতের বেলা ভূমধ্যসাগর হয়ে ৫-৬টি নৌকা একসঙ্গে ভিকটিমদের নিয়ে রওয়ানা দিতো।
একেকটি নৌকায় ধারনক্ষমতা ৪০-৫০ জন হলেও ১০০-১২০ জন নিয়ে নৌকাগুলো বিপজ্জনক যাত্রা করতো। এর ফলে পথিমধ্যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতো প্রতিনিয়তই।
দুই বছরে কোটি টাকার লেনদেন
স্বল্প সময়ে আটকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আটক সীমার ব্যাংক চেক অনুযায়ী দেড় কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। হেলেনার ব্যাংক চেকেও কোটি টাকার লেনদেনের হয়েছে। এছাড়া, তাদের টালি খাতা অনুযায়ী প্রায় এক কোটি টাকা লেনদেন দেখা যায়।
মূলহোতা রুবেল বর্তমানে দুবাই রয়েছেন। চক্রে বিদেশি কোনো সদস্য রয়েছে কিনা বিষয়টি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। আটকদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০২১
পিএম/এএ