ঢাকা: বাঙালির পরিচয় অর্থই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার আদর্শ ও চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠিত হয় ‘বহুমাত্রিক বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। কালের কণ্ঠ ও ডেইলি সান আয়োজিত এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিশিষ্টজনেরা।
কালের কণ্ঠ সম্পাদক ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের পরিচালক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, আগষ্ট মাস আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শোকের মাস। ১৯৭৫-এর ১৫ আগষ্ট যে অন্ধকার সকালটি আমাদের জীবনে এসেছিলো, তেমন সকাল আর বাংলাদেশে আসেনি। বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেদিন সপরিবারে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। পৃথিবী সেদিন কেঁপেছিলো, বাংলার মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। যারা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করলেন, তারা একটি ব্যাপার বুঝতেই পারেননি, বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হত্যা করা যায়, তার আদর্শকে হত্যা করা যায় না, তার চেতনাকে হত্যা করা যায় না। তার আদর্শকে নিয়ে বাঙালি জাতি এগিয়ে যাচ্ছে, তার আদর্শ ও চেতনা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ একটা উন্নত দেশ হিসেবে ধীরে ধীরে একটা জায়গায় পৌঁছাবার চেষ্টা করছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তার বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা খুব গৌরব বোধ করি যে, তার বাবার স্বপ্ন তিনি সফল করতে চলেছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষ কখনো কল্পনাও করেনি। আমরা সেটা এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। এরকম দেশের চারদিকে তাকালে উন্নয়নের যে জোয়ার চোখে পড়ে, এই বাংলাদেশে আমরা আগে কখনো দেখিনি। সেটি সম্ভব হয়েছে শুধু বঙ্গবন্ধু কন্যার কল্যাণেই। যার রক্ত আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ধমনীতে সেই মহান নেতাকে নিয়ে, আমাদের জাতির পিতাকে নিয়ে আমাদের আজকের এই অনুষ্ঠান- ‘বহুমাত্রিক বঙ্গবন্ধু’।
ডেইলি সান সম্পাদক এনামুল হক চৌধুরী বলেন, ভারতের জাতির পিতা হলেন মহাত্মা গান্ধী। তার নামে প্রত্যেকটা স্টেটে একটা করে সড়ক আছে এবং এটা প্রধান সড়ক। সবচেয়ে বড় ও লম্বা কানেকশনের যে প্রধান সড়ক সেটিই মহাত্মা গান্ধীর নামে। সেটাকে এম.জি. রোড বলা হয়, কলকাতায়ও সেটা আছে। আমাদের বাংলাদেশে জাতির পিতার নামে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ করেছি, চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু রোড আছে। কিন্তু অন্য কোথায়ও আছে বলে আমার জানা নেই। প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে আমরা জাতির পিতার নামে একটা সড়ক কী করতে পারি না? তাকে স্মরণ করার জন্য, মনে রাখার জন্য, সম্মান দেওয়ার জন্য। আমার একটা আবেদন হচ্ছে, প্রত্যেক বিভাগীয় শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণ করা হোক, তাতে মনে হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের সম্মান দেওয়াটা একটু বৃদ্ধি পাবে।
আপিল বিভাগের অবসর প্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বারট্রান্ড রাসেলের মতো একজন দার্শনিক, যিনি নির্যাতিত মানুষের কথা বলতেন। সংবিধানের বিষয়ে একটি সত্য না বললে নয়। সত্যটি হচ্ছে, ড. কামাল হোসেনকে সংবিধানের রচয়িতা বলা হয়। এর চাইতে বড় মিথ্যাচার আর হতে পারে না। কামাল সাহেব ছিলেন ৩৪ জনের একজন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই ৩৪ জনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো সংবিধান রচনা করার জন্য। তবে তিনি মন্ত্রী ছিলেন বলে পদাধিকার বলে চেয়ারম্যান ছিলেন। চেয়ারম্যানের দায়িত্বটা কি মিটিং ডাকা, মিটিং মুলতবি করা এবং যারা খসড়া নিয়ে আসে সে খসড়াগুলো কালেক্ট করা। সেই দায়িত্বগুলো পালন করতেন ড. কামাল। তিনি খসড়া তৈরি করেননি। ওনাকে যারা প্রণেতা বলছেন তারা অনেকেই অজ্ঞতাবসত বলছেন। আবার অনেকে জেনেশুনে মিথ্যা বলছেন। আমার অবাক লাগে তিনি নিজেও কখনো প্রতিবাদ করেনি। সংবিধান রচনার বিষয়ে আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেবের কাছে শুনেছি, ‘বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন দেশের সংবিধান এনে ৩৪ জনকে ভাগ করে দিয়ে দাগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন এই বিষয়গুলো আমাদের সংবিধানে রাখা হবে।
বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বহুমাত্রিক বঙ্গবন্ধু নিয়ে আলোচনার বিষয় সত্যি প্রশংসার। আমরাতো গতানুগতিক, আবেগীয়, ভাসা ভাসা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক কথা বলে যাচ্ছি। ১৫ আগস্ট আসলে সরকারও বলে আমরাও বলি। সরকার বলে আমরা শুনি। আমি বহুদিন ধরে একটা দাবি জানিয়ে আসছি, খুনিদের বিচার করে ষড়যন্ত্রকারীদেরকে আড়ালে রেখে বিচার কাজটি কখনোই সম্পূর্ণ হয়েছে বলে আমি মনে করি না। খুনিরা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু পেছনে ছিলো দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। কুশীলবদের নাম-ধাম এখন আমরা জানি। তবে একজনের নাম সামনে আসে না। সেটি আমি বলে দেই। সেটি হচ্ছে চট্টগ্রামের আলিশহরের বাসিন্দা আন্ধা হুজুর বা আন্ধা হাফিজ। আমি যতটা তথ্য পেয়েছি, এই ব্যক্তি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনের আধ্যাত্মিক সহযোগী। বর্তমান সরকার দীর্ঘ সময় থেকেও কানাডায় পলাতক নুর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে না পারা দুঃখজনক। অনেক সময় চলে গেছে এখনই কাজ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক আ. ব ম ফারুক বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ওষুধ প্রশাসন পরিদপ্তর তৈরি করলেন। তখন শিল্প কারখানা স্থাপনে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হতো। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন, যারা ওষুধ কারখানা করবে, তাদের আরো বেশি ঋণ দেওয়ার জন্য ও অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য। তিনি চাইতেন, বেশি বেশি করে ওষুধ কারখানা হোক। যাতে বাংলাদেশ ওষুধে স্বনির্ভর হয়। ওষুধ কম্পানিকে সকল প্রকার কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তার নির্দেশও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার হাত ধরেই আজ বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখন আমাদের চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধই দেশে উৎপাদন হয়।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ বলেন, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি ছিল। তিনি যৌবনকাল থেকেই সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করার চেষ্টা করেছেন। বুলবুল ললিত কলা একাডেমি, ছায়ানটকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, তাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে যে মেলাটা হতো তাতে তিনি সমর্থন দিয়ে গেছেন। বেতার, টেলিভিশন বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি কাজ করেছেন। তার একটা অনন্য কাজ হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করার জন্য তিনি শিল্পকলা একাডেমিকে বেছে নিয়েছিলেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে লন্ডন হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফেরার পথে ভারতের দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। তখন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান। সেখানে আয়োজিত এক সংক্ষিপ্ত জনসভায় বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ‘আপনি মানুষের মুক্তি ও মানবিক স্বাধীনতার জন্য কষ্ট ও আত্মত্যাগের শাশ্বত চেতনার মূর্ত প্রতীক’। এইতো ছিলেন বাঙলার আত্মা, বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহবায়ক ও একুশে টেলিভিশনের সিইও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির জায়গাটি বঙ্গবন্ধু এমনভাবেই ধারণ করেছিলেন। আজ আমাকে এভাবে কথা বলার অধিকারও দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বলতে হয়, আমারও শৈশব কেটেছে গোপালগঞ্জে মধুমতির তীরে। আমার শিক্ষা জীবনও বঙ্গবন্ধুর পড়া স্কুল থেকে শুরু হয়েছে। আমি সেখানে দেখেছি তার লড়াই। তিনি সব সময় সাধারণের মধ্য থেকে সাধারণের কথা বলতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আখতার হোসেন বলেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে যদি আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবনটা দেখি, তাহলে তা ছিল অতি ক্ষুদ্র। মাত্র সাড়ে তিন বছরে তার অর্জন যদি আমরা দেখি তাহলে আমাদের তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। যুদ্ধের ফলে আমাদের দেশটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। সেই সময় অসীম সাহসী বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশের হাল ধরলেন। তিনি আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজালেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, বঙ্গবন্ধুর লেখা বই থেকে আমরা গবেষণা করতে পারছি।
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ড. নাছিম আখতার বলেন, মুজিব মানে মুক্ত জীবনের বন্দনা। বাঙালির মুক্ত জীবনের বন্দনাই তার আরাধ্য বিষয় ছিল। সব সময়ই চেষ্টা করি তার নীতি আদর্শ ধারণ করতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার দেওয়া ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সব ধর্মের মানুষেরর সমান অধিকার দেওয়া।
কলামিস্ট ও বিশ্লেষক ইকরামউজ্জমান বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন ক্রীড়ানুরাগী ও ক্রীড়াপিপাসু ব্যক্তিত্ব।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বঙ্গবন্ধুর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু যে সাড়ে তিনবছর বেঁচে ছিলেন সে সময়ে তিনি স্বাস্থ্যখাতের মূলভিত্তি দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ২০২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০২১
এসই/এজে