ঢাকা, শুক্রবার, ২ মাঘ ১৪৩১, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

চট্টগ্রামে পাসপোর্ট অফিস কর্মকর্তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে দালালের দৌরাত্ম্য

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২১
চট্টগ্রামে পাসপোর্ট অফিস কর্মকর্তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে দালালের দৌরাত্ম্য

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি) বসিয়েছিল দালাল চক্রের এক সদস্য। এ ঘটনায় সেবা প্রত্যাশীরা ক্ষোভ প্রকাশ করলে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের নির্দেশে সিসি ক্যামেরা সরিয়ে ফেলা হয়।


সরেজমিনে দেখা গেছে, একরামুল হক জুয়েল নামের একজন দালালের ‘ইজি ব্যাংক’ নামের অবৈধ দোকান থেকে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে পাসপোর্ট অফিসে মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিলো। এতে প্রশাসনের লোকজন আসার আগেই খবর পেয়ে যান দালালরা। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত (২ সেপ্টেম্বর) সিসি ক্যামেরা লাগানো অবস্থায় দেখা গেলেও শনিবার (৪ সেপ্টেম্বর) সেটি দেখা যায়নি।  

এর আগে ৯ জুন দুপুরে নগরের পাঁচলাইশ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনে থেকে ১টি পাসপোর্ট, ৩টি ফরম ও ৫৫ হাজার টাকাসহ ১১ দালালকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন-সাইফুল, আমিনুল, রকিব, জহির, জুনাইদ, মুজিবুল, আহমদ হোসেন, জাকির হোসেন, সাকিব, জামাল ও সাইদুল।

পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রামে দুটি পাসপোর্ট অফিস মিলে শতাধিক দালাল রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫০ জনের বেশি স্বীকৃত দালাল রয়েছে। আমাদের পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের ২০-২৫ জনের তথ্য আমরা পেয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিসি ক্যামেরায় মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে অভিযুক্ত একরামুল হক জুয়েল বাংলানিউজকে বলেন, ‘এলাকায় সন্ধ্যার পর ছিনতাইকারী ও ছিঁচকে চোরের উপদ্রব বেড়ে যায়। এছাড়া ব্যাচেলরদের জন্য মেস আছে এখানে। একটি ব্যাংকের এজেন্ট হিসেবে ‘ইজি ব্যাংক’ এর মাধ্যমে পাসপোর্ট আবেদনের টাকা জমাদানের কাজ করা হয়। এখানে অবৈধ কোনো লেনদেন হয় না। সার্বিক নিরাপত্তার কথা ভেবে দোকানটির সামনে সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিলাম। কিন্তু এটি নিয়ে আপত্তি ওঠায় সেটি খুলে নিয়েছি। ’

পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে আসা একাধিক ভুক্তভোগী বলেন, দালালদের শরণাপন্ন না হয়ে সরকারি নির্ধারিত ফি জমা দিতে যাই। কাগজপত্র জমা দিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাগজপত্রে ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে রাজি না হলে কাগজপত্র নিয়ে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়। দালালদের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিতে, ইচ্ছে করেই পরিস্থিতি জটিল করে রাখা হয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। পাসপোর্ট অফিসে দালালদের সংঘবদ্ধ একটি চক্র রয়েছে। ওই দালালদের দিয়ে করলে সবকিছু ঠিকঠাকমতো হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ পাসপোর্ট অফিসে আসলে দালাল ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে পদে পদে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হতে হয়।

মো. আরিফ নামে আরেক ভুক্তভোগী বাংলানিউজকে বলেন, ‘নির্ধারিত ফি ব্যাংকে জমা দিয়ে পাসপোর্ট অফিসে কাগজপত্র জমা দিতে যাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র জমাও দেই। পুরাতন পাসপোর্টে ‘মো.’ আছে, কিন্তু এনআইডিতে ‘মোহাম্মদ’ আছে। পুরাতন পাসপোর্ট অনুযায়ী নতুন পাসপোর্টের আবেদন করা হলে এনআইডি’র নামের বানান দেখিয়ে তা তিন মাস আটকে রাখা হয়েছে। পরে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও সমাধান হয়নি। আর তারা ঠিক করে দিলে আমার কাছে তিন হাজার টাকা দাবি করে। পরে দুই হাজার টাকা দিয়ে সংশোধন করা হয়।  

তিনি আরও বলেন, পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া ভোগান্তির শেষ নেই। টাকা দিয়ে দালাল ধরে করলে ভুলভ্রান্তি থাকলেও সমস্যা হয় না। দালাল ছাড়া করলে সব সমস্যা বের হয়ে আসে। আসলে এসব দেখার কেউ নেই।

অভিযোগ রয়েছে- পাসপোর্ট করার জন্য নিজে সব কিছু করে নিয়ে গেলে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘এই ভুল’, ‘সেই ভুল’ ধরে হয়রানি করেন। তাই ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে অনেকেই দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করাচ্ছেন। আর এরই সুযোগে পাসপোর্টের জন্য ব্যাংক ড্রাফট বাবদ বাড়তি দেড় থেকে তিন হাজার টাকা নিচ্ছে দালালরা।  

তবে, এই বাড়তি টাকা থেকে পাসপোর্ট প্রতি ১২০০ টাকা চলে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে। পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বাড়তি আয়ের লোভে দালালদের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন বলেও সেবাপ্রার্থীরা অভিযোগ তুলেছেন। পাসপোর্ট অফিস ঘিরে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে দালাল চক্র গ্রাহকদের জিম্মি করে রেখেছেন। দালাল ছাড়া পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা ও পাসপোর্ট পাওয়া কঠিন। গ্রাম থেকে আসা লোকজনও ভোগান্তিতে পড়ছেন।  

পাসপোর্ট অফিস সংশ্লিষ্টরা জানান, পাসপোর্টের আবেদনপত্রে দালালদের বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন না দেখলে আবেদন জমা নিতে চান না কর্মচারীরা। নিয়ম মেনে আবেদন করতে গেলে দিনের পর দিন শুধু ঘুরতে হয়। পাসপোর্ট অফিসের সামনে প্রকাশ্যেই দালালদের ঘোরাফেরা করতে দেখা গেলেও তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো উদ্যোগ নেই।  

বর্তমানে পাসপোর্ট অফিসে জুয়েল, সোহেল, কামরুল, জামাল, নাছির, মোরশেদ, উত্তম, জহুর, রফিক, রানাসহ বেশ কয়েকজন দালাল তৎপর রয়েছে।  


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালাল বলেন, অফিসে ছোট-বড় সবাই টাকার ভাগ পায়। আবেদনকারীকে সহায়তা করার বিনিময়ে যে টাকা পাই, তা থেকে প্রতি পাসপোর্টের পরিবর্তে নিজের ভাগে থাকে মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা। আনসার সদস্যরাও এসব জানে। পাসপোর্ট অফিসের অনেক কর্মকর্তা দালালের অফিস থেকে ফরমগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যায়।  

এ প্রসঙ্গে পাঁচলাইশ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মাসুম হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২১ 
এমআই/এসআইএস/টিসি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।