ঢাকা, শনিবার, ৪ মাঘ ১৪৩১, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

পাঁচটি মরদেহের দুটির দাবিদার কেউ নয়!

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০২১
পাঁচটি মরদেহের দুটির দাবিদার কেউ নয়!

ঢাকা: কামালবাগে ‘রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’ জুতার কারখানায় ভয়াবহ আগুনে দগ্ধ হয়ে পাঁচজন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। কারখানার ভেতরে তারা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন।

কারখানার একটি ছোট কক্ষ থেকেই মরদেহগুলো উদ্ধারের পর পাঠানো হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড) মর্গে। এদিকে, খবর পেয়ে নিহতদের স্বজনরা ছুটে এসেছেন মিটফোর্ড মর্গে। প্রতিটি মরদেহ দেখে শনাক্ত করেছেন স্বজনরা। কিন্তু বিপত্তি শেষ হয়নি।

মর্গে বারান্দায় পাঁচটি মরদেহ রাখা আছে। এদিকে বাইরে অপেক্ষা করছেন পাঁচটি পরিবারও। আগুনে মুখের অবয়ব ঝলসে গেছে। শরীরের চামড়া ঘুচিয়ে গেছে। প্রচণ্ড তাপে কেমন কুচকে ছোট হয়েছে গেছে শরীর। তবে তিনটি মরদেহ দেখে পাঁচটি পরিবারই নিজেদের স্বজন বলে দাবি করছেন। কিন্তু বাকি দুটি মরদেহের দাবিদার কেউ নেই।  

শুক্রবার (০৫ নভেম্বর) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিটফোর্ড মর্গে পাঁচ পরিবারই অবস্থান করে আছে। পরিবারগুলো বাংলানিউজকে জানিয়েছেন পাঁচটি নাম। নিহতরা হলেন, মনির হোসেন (৩৫), আব্দুর রহমান রুবেল (৪০), কামরুল হাসান কামিরুল (২৬), আমিনুল ইসলাম (৩৫) ও শামীম মিয়ার (৩৫)। তারা পাঁচজনই ‘রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ’ জুতার কারখানায় কাজ করতেন।

মর্গে থাকা একটি মরদেহের হাতের আঙুলে পিতলের আংটি দেখে শনাক্ত করেন নিহত কামরুল হাসান কামিরুলের (২৬) ফুফাতো ভাই দেলোয়ার হোসেন দুলাল। আবার একই মরদেহের উচু দাঁত দেখে নিজের স্বজন বলে দাবি করেন নিহত আমিনুল ইসলামের (৩৫) বড় বোন বিলকিস বেগম। এদিকে, একটি মরদেহের ডান গালে ফুলা টিউমার স্বাদৃশ্য দেখে নিজের স্বজন বলে দাবি করেন নিহত মনির হোসেনের (৩৫) শ্যালক মোহাম্মদ আলী। আবার একই মরদেহের গায়ে পোশাক দেখে নিজের স্বজন বলছেন নিহত আব্দুর রহমান রুবেলের (৩৫) ভাই সালাউদ্দিন। এদিকে নিহত মো. শামীমের (৩৫) বড় ভাই জসীম উদ্দিনও এই মরদেহ দেখে নিজের ভাই বলে দাবি করছেন। কিন্তু বাকি দুটি মরদেহের দাবিদার কেউ নেই।

সব মিলিয়ে তালগোল হয়ে গেলে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে আসা কর্মকর্তা ও চকবাজার থানা পুলিশের সদস্যরা এবং নিহতের পরিবারের স্বজনরা কোনো কুলকিনারা করতে পারছেন না। পুলিশ বলছে, মরদেহগুলোর দাবিদার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ডিএনএ টেস্ট করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় ২১ দিন পরে জানা যাবে কোনটি কার মরদেহ। সেই অনুযায়ী পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।

পুলিশর অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের পরিদর্শক সাইফুর রহমান ভুইয়া বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া পাঁচটি মরদেহ দেখে শনাক্ত করার মতো পরিস্থিতি নেই। আগুনে মুখমণ্ডল ও শরীর ঝলসে গেছে। পরিচয় শনাক্ত করতে আমরা হাসপাতালে গিয়েছিলাম, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এখন ডিএনএ পরীক্ষার ছাড়া মরদেহগুলো শনাক্ত করা যাবে না। ডিএনএ টেস্ট করলে পরে শনাক্ত করা যাবে কার মরদেহ কোনটি। এই প্রক্রিয়ায় কিছুটা সময় লাগবে।

মর্গে অবস্থানরত দেলোয়ার হোসেন দুলাল বাংলানিউজকে জানান, তার ফুফাতো ভাই কামরুল হাসান কামিরুল রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজার পদে দেড় বছর ধরে কাজ করেন। আমার ফুফু আমাকে বলেছিলেন কামিরুলের বাম হাতে মাঝখানের (মধ্যমা) আগুলে একটি আংটি পড়তেন। সেখানে একটি মরদেহের হাতের আঙুলেও একটি পিতলের আংটি রয়েছে। এছাড়াও শরীরের গঠন আকৃতি আর মরদেহের গঠন আকৃতির সঙ্গে মিল রয়েছে।

এদিকে, মোহাম্মদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, আমার দুলাভাইয়ের (মনির হোসেন) ডান গালে একটি টিউমার রয়েছে। সেই টিউমার দেখে আমি তাকে শনাক্ত করেছি। কারণ দুলাভাই মনির কামালবাগে রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের মেশিন ম্যান ছিলেন। আর আমি একই এলাকার অন্য একটি জুতার কারখানায় কাজ করতাম। প্রায় প্রতিদিনই আমরা বাইরে দেখা করতাম। কিন্তু সমস্যা হয়েছে আরও দুই পরিবার এই মরদেহ দেখে তাদের স্বজন দাবি করছেন।

এদিকে, অন্যা স্বজনরাও বিভিন্ন চিহ্ন ও শরীদের গঠন আকৃতি দেখে একই মরদেহ নিজেরে স্বজন বলে দাবি করছেন। মিটফোর্ড মর্গে নিহতদের স্বজনদের এমন পাল্টাপাল্টি দাবি করা দেখে ঢাকা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশ সদস্য ও মিটফোর্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাঁচটি মরদেহের ডিএনএ টেস্ট করার বিষয়ে সিন্ধান্ত নেন। মরদেহগুলোর প্রকৃত পরিচয় শনাক্ত করে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে বলেও জানান তারা।

এ বিষয়ে মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে উপস্থিতরত ঢাকা জেলা প্রশাসনের তেজগাঁও সার্কেলের অফিস সহকারী মোহা. জালাল উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আগুনের ঘটনায় নিহতদের মরদেহ ও তাদের স্বজনদের শনাক্ত করতে এসেছিলাম। তবে মর্গে পাঁচটি মরদেহ ও পাঁচটি পরিবার ঠিক পেয়েছি। কিন্তু মরদেহ শনাক্ত করতে গিয়ে তারা গোলমাল করে ফেলেছেন। এক মরদেহ একাধিক পরিবার নিজেদের বলে দাবি করছেন। সেই সঙ্গে নিহতের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার বিষয়টিও শনাক্তের উপর নির্ভর করে।

কিন্তু দেখা গেছে, তিনটি মরদেহের দাবিদার ৫ পরিবার। বাকি দুটি মরদেহের কোনো দাবিদার নেই। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি ডিএনএ টেস্ট ছাড়া এই বিষয়টির সুরাহা করা যাবে না। তাই আমরা প্রকৃত পরিচয় শনাক্ত করেই মরদেহ হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় যেতে চাই।

এর আগে, বৃহস্পতিবার (০৪ নভেম্বর) পুরান ঢাকার সোয়াড়িঘাট এলাকার কামালবাগে অবস্থিত জুতার কারখানা রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ এ আগুনের ঘটনা ঘটে। রাত ১টা ১৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ফায়ার সার্ভিসের ৮ ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে রাত ৩টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এ ঘটনায় আগুনে পুরে কারখানার ৫ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তবে কারও পরিচয় শনাক্ত হয়নি। এছাড়াও আগুন থেকে বাঁচতে কারখানা থেকে লাফিয়ে পড়ে দুই শ্রমিক আহত হন।  কারখানার আগুনে পাশের মদিনা কাঁচা বাজারের ১০টি দোকান পুড়ে গেছে।

>>> সোয়ারীঘাটের অগ্নিকাণ্ডে ৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার
>>> পুড়ে ছাই সোয়ারীঘাটের কাঁচাবাজার
>>>দাহ্য পদার্থে ভয়াবহ রূপ নেয় আগুন

বাংলাদেশ সময়: ২২১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০২১
এসজেএ/এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।