সুন্দরবন (দুবলার চর) থেকে ফিরে: সুন্দরবনের কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে বিচ্ছিন্ন শুটকি পল্লী দুবলার চর। আলোরকোল, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া এবং মেহেরআলির চর জুড়ে এই জেলে গ্রাম।
মনের ভেতরে স্বপ্ন বুনে জেলেরা দুবলার চরে আসেন। জীবনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরেন। সেই সঙ্গে শুঁটকি শোকানোর কাজও চলে। রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যেই কেটে যায় দুবলার মৌসুমী এই পাঁচ মাস। চওড়া সুদে ঋণ ও দাদন নিয়ে জেলারা দুবলায় মাছ-শুটকি কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। মৌসুম শেষে কেউ কেউ লাভের মুখ দেখলেও অধিকাংশই লোকসান বোঝা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। সুদের টাকা পরিশোধ করলেও ঋণের আসলটুকু বছরে পর বছর জেলেদের ঘাড়ে চেপে থাকে। মনে চাপা কষ্ট থাকলেও হাসি মুখে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন দুবলার জেলেরা। এদিকে, কাঁচা মাছ, শুটকি ও রাবিশসহ ঋণ-লগ্নি ও দাদনের ফাঁদে ফেলে জেলেদের জিম্মি করে আখের গুছিয়ে নেয় বনবাসীর মত রক্তচোষা সাহেবরা।
একটা সময় জলদস্যু-বনদস্যু আতঙ্কে দিন কাটিয়েছেন সুন্দরবনের দুবলার জেলে সম্প্রদায়। সময়ের বিবর্তনে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হলেও সাহেবদের সুদের ফাঁদ কেঁটে বের হতে পারেননি জেলেরা। এখনও জিম্মি দশায় থেকেই চলছে জেলে জীবন। তবুও মনে স্বপ্নের প্রদীপ জ্বালিয়ে ফিরে ফিরে দুবলার চরে আসছেন তারা।
সাহেবদের লগ্নি ও ঋণের ফাঁদ আর মহাজনদের দাদন প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন জেলেরা। এর জন্য সরকারের বন বিভাগকে রাজস্ব-ভ্যাট দিয়ে দুবলায় মাছ ধরতে আসা জেলেরা সুদমুক্ত ব্যাংক ঋণের সুবিধা চাইছেন। সেই সঙ্গে জেলেদের মাছ ধরার জন্য বন বিভাগের নতুন কার্ড সঠিক বিতরণের দাবিও জানিয়েছেন তার।
সম্প্রতি সুন্দরবনের দুবলার চরে সরেজমিনে ঘুরে ও জেলে সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলে এমটাই জানা যায়।
আলাপচারিতায় জেলেরা জানান, প্রতিবছর দুবলার চরে এক একটি শুটকির সাবারে ব্যবসা করতে আসা জেলেরা ৩-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে থাকেন। এক মৌসুমের জন্য লাখে ২৫-৪০ হাজার টাকা সুদ গুণতে হয় জেলেদের। টানা পাঁচ মাস হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও আসল তুলতে পারেন না জেলেরা। সুদের টাকা পরিশোধ করলেও সাহেবদের ঋণ জেলেদের ঘাড়ে অশুরের মত ভর করে থাকছেই। এখনও ক্রীতদাস প্রথার মতই চলছে তাদের জীবন। সাহেবদের কাছ থেকে চওড়া সুদে ঋণ নিয়ে কাঁচা মাছ ও শুটকির ব্যবসা করতে আসেন। তবে সাহেবদের নির্ধারিত মহাজনের কাছেই তাদের মাছ বিক্রি করতে হয়। মাছ ভেদে ভালো দাম পাওয়ার আশা থাকলেও সাহেব-বদ্দারা (মহাজন) জেলেদের সঠিক দাম দেয় না। দাদন ব্যবসায়ীরা জেলেদের ধরা মাছের মধ্যে ১৫ শতাংশ আলাদা রেখে দেন। বাকি মাছগুলো তারা নিলামে জেলেদের কাছ থেকে কিনে নেন। এতে করে দাদন নেওয়া জেলেদের দিন শেষে লোকসান গুনতে হয়। অন্য মহাজনের কাছে দাম বেশি পেলেও মাছ বিক্রি করতে পারেন না জিম্মি জেলেরা।
তারা জানায়, সুন্দরবনের দুবলার চরে দৈনিক কোটি টাকার বেশি কাঁচা মাছ ও শুটকির বাণিজ্য হয়। পুরো মৌসুমে দেড় শতাধিক কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। এরপরও সাহেব-মহাজনদের লাভের পাল্লা ভারি হয়, আর জেলেদের ঋণের বোঝা বাড়ে।
গত ১৮ বছর ধরে সুন্দরবনের দুবলার চরে মাছ-শুটকির ব্যবসা করতে আসেন বাদল সরকার। তিনি খুলনার পাইকগাছা থানার মঠবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা। তার নিজেরই দুটি বোট ও মাছ ধরার জাল রয়েছে। সাহেবদের মাধ্যমে বন বিভাগকে বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, ডিএফসি বা ডেইলি ফুয়েল (জ্বালানি কাঠ/তেল) কনজাম্পশন প্রক্রিয়ায় রাজস্ব-ভ্যাট দিয়ে তিনি দুবলার চরে মাছ ধরতে আসেন। কিন্তু তিনিও ঋণে জর্জরিত।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘একটি বোটের (নৌকা) জন্য তিন হাজার এবং ঘরের জন্য তিন হাজার করে মোট ছয় হাজার টাকা বন বিভাগকে রাজস্ব-ভ্যাট দিতে হয়। পুরো মৌসুমের জন্য আমরা রয়েলটি দিয়েই এই চরে মাছের ব্যবসা করতে এসেছি। ব্যবসা করার জন্য ঋণ নিতে হয়েছে। গত বছর ব্যবসা করেছি, কিন্তু লোকসান হলো। এই বছরও কেবল শুরু। এখনও ভালো মাছ পাইনি। এদিকে, ঋণের বোঝা তো আছেই। গত মৌসুমেও ঋণের টাকা দিতে না পেরে সুদের অংশটা দিয়েছি। ’
‘আশা আছে, এ মৌসুমে মাছ বিক্রি করে সব ঋণ পরিশোধ করবো। বাকিটা আল্লাহ জানে’- যোগ করেন তিনি।
দুবলার চরের জেলেদের নিয়ে সরকার ও বনবিভাগের কোনো ভাবনা নেই উল্লেখ করে মৎস্যজীবী বাদল বলেন, ‘এই ঋণ আমাদের শেষ করে দিলো। আমরা সরকারের কাছে আবেদন, দুবলার মৎস্যজীবী ও জেলে সম্প্রদায়কে বাঁচিয়ে রাখতে সুদমুক্ত ব্যাংক ঋণ দেওয়া ব্যবস্থা করুন। ’মৎস্যজীবী বেলায়েত সরদার বাংলানিউজকে বলেন, যে জেলেই ঋণ নেবে, তারই মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাবে। আর যে দাদন নিয়েছেন, মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তিনি নিজেকে বিক্রি করে দিলো। তার নিজের বলে কিছুই থাকলো না। এটাই আমাদের দুবলার চরে জেলেদের জীবন। তারা উন্নতি করবে কীভাবে, জীবন ভর মাছ ধরলেও সেই ঋণ কখনও শেষ হবার নয়। আমাদের দুবলার জেলেদের নিয়ে সরকারের কোনো ভাবনা নেই। অথচ দেশের শুটকির বড় একটা অংশ দুবলার চরের জেলেদের থেকেই যায়।
এদিকে, ঋণ-দাদনের ফাঁদে জিম্মি জেলারা জানায়, যারা সাহেবদের কছ থেকে ঋণ নিয় মাছ ধরতে ও ব্যবসা করতে এসেছেন তাদের অনেকের নামেই চেকের মামলা রয়েছে। কারণ তারা ঋণ নিয়ে বছরে সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলেই মামলা দিচ্ছে সাহেব-মহাজনরা। এই ঋণ নিতে গেলেও সাহেবরা অগ্রিম তিনটি চেকের পাতায় স্বাক্ষর রেখে দেয়। এছাড়াও স্ট্যাম্প করে পাকা কাগজ করে রাখে। অনেক সময় সুদের টাকা পরিশোধ করলেও সাহেবরা কোন রশিদ দেয় না।
জেলে রূপ কুমার বাংলানিউজকে বলেন, ব্যবসা করতে ঋণ নিলো, বছরের পর বছর ওই সুদ টানতে হয়। আসল ঠিকই থেকে যায়। যুগের পর যুগ চলে যায়, ঋণ আর কমে না। এক সময় ওই ঋণের বোঝা ছাওয়ালগের (ছেলেদের) ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। এই সুদ শেষ হবার নয়।
‘সাহেবদের’ নিয়ন্ত্রণে ঋণ-দাদন ব্যবসা: জেলেরা জানায়, দুবলার চরে কারা মাছ ধরবেন, কোন মহাজন/ব্যবসায়ীর কাছে মাছ বিক্রি করবেন, মাছের দর কেজি প্রতি কেমন হবে, রাবিশ কার কাছে বিক্রি করবে, এসব নিয়ন্ত্রণ করেন দুবলার ১৫ জন সাহেব।
শুধু তাই নয়, জেলেদের কে ঋণ দেবে, ঋণের সুদ কত হবে, দাদন দেবেন কে- এসবও নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ থাকেন সাহেবরা। এদিকে, দুবলার চর নিয়ন্ত্রণকারী সাহেবদেরও একজন ‘সাহেব’ রয়েছেন। দুবলার চর ফিসারমেন গ্রুপের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন আহমেদ। তিনি যেভাবে কলকাঠি নাড়েন দুবলার চর ঠিক সেভাবেই চলে। তার উপরে কেউ কোনো কথা বলতে পারেন না। যদি বলে ফেলেন, তবেই বিপদ। প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয়ের কারণে হলেও কোনো জেলে যদি ঋণের টাকা দিতে না পারেন, তবে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের টাকা বাড়তে থাকে। আর এই দাদন বছরের পর বছর চলছেই।
টেলিটক নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনা: জানা গেছে, ২০১৪ সালে সুন্দরবনের কটকা, মোংলাসহ তিনটি এলাকায় রাষ্ট্রীয় মোবাইল অপারেটর কোম্পানি টেলিটকের টাওয়ার স্থাপন করা হয়। তবে আর কোনো নেটওয়ার্ক সেখানে পাওয়া যায় না। তরঙ্গ যোগযোগ ব্যবস্থার এই সুবিধাটি জেলেরাও পাচ্ছেন।
দুবলার চর থেকে আহরিত শুঁটকি চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের পাইকারী বাজারে মজুদ ও বিক্রি করা হয়। জেলেরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কাঁচা মাছ ও শুটকির দর-দাম ঠিক করতে পারেন। সুন্দরবনে টেলিটক নেটওয়ার্কের গুরুত্ব অনেক বেশি হলেও প্রায় সময় এর বিড়ম্বনায় পড়তে হয় জেলেদের। হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয় নেটওয়ার্ক। ঠিক তখনই বিপাকে পড়েন জেলেরা। এর কারণ মাছের সঠিক দর-দাম না পেয়ে কম দরে সাহেব ও মহাজনদের কাছে বাধ্য হয়ে যাতে বিক্রি করেন জেলেরা। তবে টেলিটকের নেটওয়ার্ক হঠাৎ করেই বন্ধ হওয়ার পেছনেও নড়ে কলকাঠি।
দুবলার চরের জেলেরা জানায়, তারা যাতে মাছের সঠিক দর জানতে না পারেন, সেজন্য অনেক সময় এই নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুবলার নিযন্ত্রণে থাকা সাহেবরা এর সঙ্গে জড়িত। কারণ জেলেরা বাজার দর না জানতে পারলে সাহেব-মহাজনরা কম মূল্যে মাছ কিনে নিতে পারেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চর নিয়ন্ত্রণকারী সাহেবদের ঘনিষ্ঠ একজন মৎস্যজীবী বাংলানিউজকে জানান, দুবলার চর নিয়ন্ত্রণকারী সাহেবদের ‘সাহেব’ কামাল উদ্দিন আহমেদের নির্দেশেই মাঝে মাঝে নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়। এতে তিনি তার দাপট খাটান। গত ৩ নভেম্বরও দুবলার চরে টেলিটক নেটওয়ার্ক ছিল না। ওই দিনের প্রথম প্রহর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত নেটওয়ার্ক বন্ধ ছিল।
এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফিসারমেন গ্রুপের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, একটি টাওয়ারের জেনারেটর তেল শেষ হয়ে গেলে নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণেই চরে টেলিটকের নেটওয়ার্ক নেই। খুলনা থেকে তেল আসছে, আশা করি দ্রুতই ঠিক হবে। ‘
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২১
এসজেএ/এমএমজেড