ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কেরানীগঞ্জে দেশের প্রথম উড ওয়ার্কিং টেকনোলজি ট্রেনিং সেন্টার

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫২ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০২২
কেরানীগঞ্জে দেশের প্রথম উড ওয়ার্কিং টেকনোলজি ট্রেনিং সেন্টার

মো. নইমুল হোসেন খান। উড ওয়ার্কিং শিল্পের ব্যতিক্রমী এক উদ্যোক্তা।

যিনি ২১ বছর ধরে এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। ফার্নিচার শিল্পকে প্রযুক্তিনির্ভর করা, এই খাতের মানুষদের প্রশিক্ষিত করা ও সর্বোপরি এই শিল্পটাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় থেকে তিনি কাজ শুরু করেন।  

তিনি সারা পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় উড টেকনোলোজি প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে পার্টনার হিসেবে কাজ করছেন এবং বাংলাদেশে আধুনিক টেকনোলোজিগুলো নিয়ে এসেছেন। তার হাত ধরে বাংলাদেশের অনেক ব্র্যান্ড ফার্নিচার কারখানা গড়ে উঠেছে।  

শুধু তাই নয়, কেরানীগঞ্জে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশের প্রথম উড ওয়াকিং টেকনোলজি সেন্টার। এখান রয়েছে ১০০ এর ওপর ফার্নিচার ও দরজা তৈরির আধুনিক মেশিন যেখানে বিনামূল্যে ফার্নিচার শিল্পের মানুষেররা ট্রেনিং এবং টেকনোলজি সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন।  

তিনি বাংলাদেশে বসে পুরো পৃথিবীতে বিস্তার করেছেন তার জ্ঞান। বর্তমানে তিনি পৃথিবীর শীর্ষ উড ওয়ার্কিং কনসালটেন্টদের একজন। ফ্যাক্টরি সেটআপ থেকে শুরু করে এই বিষয়ে যা যা পরামর্শ প্রয়োজন তারা সব সেবাই দিচ্ছেন তিনি।  

তার সাথে ফার্নিচার শিল্প, তার প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য বিষয়ে কথা হয়। যার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো:

শুরুটা কিভাবে করলেন?
নইমুল হোসেন খান: বাংলাদেশে যখন থেকে ফার্নিচার শিল্পের উন্নয়ন শুরু হয় তখন থেকে আমাদেরও শুরু। সালটা ছিল ১৯৯৯। বিদেশি একটি এনজিও দেশের ফার্নিচার শিল্প উন্নয়নে প্রজেক্ট শুরু করে। সেটার সাথে তারা আমাকে পার্টনার হিসেবে যুক্ত করেন। বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতিও এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তখন থেকেই আমার কাজের শুরু। নেশাটা তখন থেকেই হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে গিয়ে শত শত ফ্যাক্টরিতে আমি বছরের পর বছর কাজ করেছি, হাতে কলমে প্রোডাক্শনের ওপর ট্রেনিং দিয়েছি, পরিবেশ রক্ষা ও সেফটি ইস্যুতে ট্রেনিং দিয়েছি। এ কাজগুলো অনেক বছর ধরে করছি। এটা করতে করতেই প্যাশনটা ডেভলপ করে।

আপনার হাত ধরে বাংলাদেশের কোন কোন কোম্পানি গড়ে উঠেছে? 
নইমুল হোসেন খান: সেই সময় একমাত্র প্রফেশনাল কোম্পানি ছিল অটবি। ২০০০ সালে নাভানা আগ্রহ দেখায় ফার্নিচার ফ্যাক্টরি করার জন্য। ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাঠের কাজের মেশিন সম্পর্কে সেই সময় কারও ভালো ধারনা ছিল না। বোধ হয় আমারই মোটামুটি ধারনা ছিল। কারণ এনজিওর সঙ্গে প্রজেক্ট করার সময় এই বিষয়ে ব্যাপক পড়াশুনা করি, পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় মেশিন প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে অনেক ক্যাটালগ এনে প্রচুর পড়াশোনা করতাম। অটবির কয়েকজন এসে যোগ দেয়। নাভানার ফ্যাক্টরিটা দাঁড়িয়ে যায়। এর মেশিনারিজ সিলেকশন ও পরিকল্পনা আমার হাত ধরেই হয়েছিল। এর পরপরই পারটেক্সও ফার্নিচার ফ্যাক্টরি করার আগ্রহ দেখায়। ২০০১ সালে আমার হাত ধরে পারটেক্স ফার্নিচারের যাত্রা শুরু হয়। এরপর গত ২০ বছর ধরে বাংলাদেশের সব ব্র্যান্ডেড ফার্নিচারের ফ্যাক্টরি আধূনিকায়নের কাজ আমাদের হাত ধরে হয়েছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। তাদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন কাজ সবসময় চলছেই। এছাড়া ছোট ও মাঝারি শত শত ফ্যাক্টরি গড়ে তোলার জন্য আমরা কাজ করেছি। শুধু ফার্নিচার ও দরজা নয়, বাংলাদেশের অনেক শীর্ষস্থানীর প্লাইবোর্ড, পার্টিকেল বোর্ড ও এমডিএফ বোর্ড ফ্যাক্টরি স্থাপনে আমরা সহায়তা করেছি। এই মূহূর্তে আমরা একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সম্পূর্ণ অটোমেটিক একটি দরজার ফ্যাক্টরি করছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্লাইবোর্ড ফ্যাক্টরির কাজ করছি। এছাড়া ১০০% রপ্তানির জন্য একটি কম্প্লায়েন্স ফ্যাক্টরীর কাজও শেষ পর্যায়ে। আরও কয়েকটি নতুন প্রজেক্ট নিয়েও কাজ করছি। আমাদের পরামর্শ ও সার্বিক সহায়তায় বাংলাদেশ আর্মির ২ লাখ স্কয়ার ফিটের ওপর একটি অত্যাধুনিক ফার্নিচার ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয়েছে। দেশের বাইরেও বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট নিয়েও এখন আমাদের ব্যস্ততা আছে।

উড টেক সউিলশন মূলত কি কাজ করে? 
নইমুল হোসেন খান: যারা ফার্নিচার তৈরি করছে, দরজা তৈরি করছে কিংবা কাঠ সর্ম্পকিত প্রোডাক্টশনে জড়িত আছে তাদের সহায়তা করার জন্য এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। বিশেষ করে টেকনোলজিকাল সাপোর্ট অর্থাৎ বিভিন্ন প্রকার টেকনোলজিকাল মেশিনারীজ সম্পর্কিত সমাধান দিতে আমরা কাজ করে থাকি। একটি ফ্যাক্টরীর ডিজাইন, মেশিনারীজের লে আউট প্ল্যান, মেশিন সিলেকশন ও সাপ্লাই, অপারেশন ট্রেনিং, আফটার সেলস সার্ভিস দেয়া সহ পূর্ণাঙ্গ সহায়তা করে আমাদের কম্পানী। আরো খোলাখুলি ভাবে যদি বলি তাহলে বলা যায়, আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে দক্ষ লোকবল তৈরী করে কাঁচামাল ও লোকবলের দক্ষ ও সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে কিভাবে ভাল পন্য তৈরী করা যায় ও উৎপাদন বাড়ানো যায় তার জন্য সহায়তা করাই আমাদের প্রতিষ্ঠানের কাজ।

আপনাদের কাজের ফলে ফার্নিচারের দাম কি হাতে নাগালে এসেছে?
নইমুল হোসেন খান: ফার্নিচারের দামের প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। যদিও দুটো সম্পর্কযুক্ত। টেকনোলজির যে  সুফল সেটা এখনো আশানুরূপ নয়। বড়রা হয়তো বড় একটা জায়গায় গিয়েছে বা জাম্প করেছে। বাংলাদেশে ফার্নিচারের মার্কেটটা শুরু হয়েছে মাত্র। এখানে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে এখনো। আমরা অনেক বছর ধরে কাজ করছি, চেষ্টা করছি। আমরা আশা করছি যে আমাদের এত বছরের কাজের যে ফলাফল বা পরিবর্তনটা আমরা দেখতে চেয়েছি তা এখন খুব দ্রুত হবে। ২৫ লাখের মতো কর্মসংস্থান এখানে তৈরি হয়েছে। রপ্তানী ও কর্মসংস্থানের অনেক বড় সুযোগ রয়েছে। দামের বিষয়টা এর সাথে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত। আমি শুরুতেই বলেছি প্রোডাক্টশন ফ্লো  এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কাঁচামাল যদি দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা না হয় তাহলে কিন্তু দাম কমানোটা একটু কঠিন। দক্ষতার সাথে উৎপাদন বাড়ানোটা এখন একটা চ্যালেঞ্জ।  

ফার্নিচার খাত আমাদের অর্থনীতিতে কি ধরনের ভুমিকা রাখছে বা রাখতে পারে?
নইমুল হোসেন খান: ফার্নিচার ইন্ডাস্ট্রি একটা দেশে মৌলিক চাহিদা পূরণে বড় ভূমিকা রাখে। এটা মৌলিক চাহিদা পুরণ করছে। এটা একটা বিশাল অবদান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি বলি, তাহলে বলতে পারি, গার্মেন্টস শিল্প হচ্ছে আমাদের প্রধান বৈদিশিক মুদ্রা অর্জনের খাত। আনস্কিল্ড এমপ্লয়মেন্টের জন্য গার্মেন্টেসের পরেই হচ্ছে ফার্নিচার খাত। এটা এখনও অবহেলিত। এটার উন্নয়নটা জরুরী। প্রাথমিক ভাবে এই যে ২৫ থেকে ৩০ লাখ কর্মসংস্থানের যোগান দিচ্ছে এটা অনেক বড় ব্যাপার। ফার্নিচারের বাজার দেশীয় ভাবে ১০ হাজার কোটি টাকার উপর। আর বিশ্বে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ বাজারে এটার প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১৫ শতাংশ। প্রতিদিনই ফার্নিচারের চাহিদা বাড়ছে। কাজেই অভ্যন্তরীন বিশাল বাজারের পাশাপাশি রপ্তানীরও বিশাল সম্ভবনা আছে।

আপনাদের এই টেকনোলজি কতোটা পরিবেশ বান্ধব?
নইমুল হোসেন খান: বিশ্বব্যাপী পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দেশে বনজ সম্পদের ঘাটতি আছে। সরকারি ভাবে বিষয়গুলোতে এখন নজর দেয়া হচ্ছে। ফার্নিচারের সাথে বিষয়গুলো ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত। বনজ সম্পদ রক্ষা করতে হবে। গাছ কাটা চলবে না। কাজেই অলটারনেটিভ মেটারিয়ালগুলো যেমন বোর্ড ব্যবহার করতে হবে এবং ফার্নিচার বানাতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের যে হাজার বছরের চাহিদা সলিড উডে ফার্নিচার লাগবে। এটা একটা চ্যালঞ্জ। এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাতে করে পরিবেশের ওপর পজেটিভ প্রভাব করবে। আমরা যখন কোন ফ্যাক্টরী নিয়ে কাজ করি পরিবেশের বিষয়গুলো মাথার নিয়ে প্ল্যানিং দেই। কিন্তু এই বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। ফ্যাক্টরী মালিকদের এই বিষয়ে ন্যুনতম চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। সরকারী ভাবেও এই বিষয়ে কঠোর নীতিমালা মেনে চলা উচিত বলে মনে করি।
 
আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি? 
নইমুল হোসেন খান: আমরা যে এত বছর ধরে কাজ করছি, সেখানে একটা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন থেকেই কেরানিগঞ্জে একটা টেকনোলজি সেন্টার গড়ে তুলেছি। এই টেকনোলজি সেন্টার হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র উড ওয়াকিং টেকনোলজি সেন্টার। শুধু বাংলাদেশেই নয় এটা সারা পৃথিবীর মধ্যেই একটা মডেল টেকনোলজি  সেন্টার। এখানে বেসিক থেকে শুরু করে হাইটেকনোলোজীর কাঠের কাজের মেশিনারিজ আছে। এটার উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা সারা বাংলাদেশে উড ওয়ার্কিং ইন্ডাষ্ট্রিজের সাথে কাজ করছে বা ফার্নিচার উৎপাদন করছে তারা যেন এখানে ট্রেনিং নিতে পারে। এখানে আমাদের এক্সপার্টরা রয়েছে। যে কোনো মালিক তাদের কর্মী পাঠিয়ে ট্রেনিং নেয়াতে পারে, মেশিন সম্পর্কে জানতে পারে। আর এই ট্রেনিং দেয়া হয় সম্পূর্ণ ফ্রি। আমরা এই সেন্টারটিকে আরও আধূনিকায়নের কাজ করছি। আমাদের পার্টনার পৃথিবীর শীর্ষ উড টেকনোলোজী প্রোভাইডরা আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা চাই ছোট ও মাঝারি আকারের ফ্যাক্টরী গুলোও তাদের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আরও উঠে আসুক এ নতুন কর্মসংস্হানের সৃষ্টি হোক।

আপনারা নতুন একটি ডিভাইস উদ্ভাবন করেছেন সেটা কি?
নইমুল হোসেন খান : এই ডিভাইস পৃথিবীতে প্রথম। ডিভাইসটি হচ্ছে ডব্লিউটিএস রিস্টার্টিং সিস্টেম। এটা আমরা সিএনসি রাউটিং মেশিনে ব্যবহার করি। সিএনসি রাউটার মেশিন কাঠের ডিজাইনের জন্য ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে লোডশেডিং এর সমস্যা আছে। যখন সিএনসি মেশিনে একটা ডিজাইন চলতে থাকে তখন আধা ঘন্টা থেকে সাত আট ঘন্টাও লাগতে পারে। তখন বিদ্যুৎ চলে গেলে ডিজাইনটা নস্ট হতে পারে। বিদ্যুৎ আসার পরে একজন অপারেটরকে সেখানে গিয়ে মেশিন চালু করতে হয় এবং পুনরায় যেখানে কাজ থেমে গিয়েছিল সেখান থেকে চালু করাতে হয়। কিন্তু আমরা যে ডিভাইসটা করেছি সেটা অটোমেটিক রিস্টাটিং সিস্টেম। এই ডিভাইস ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ ফিরে এলে মেশিনটি স্বয়ংক্রিয় ভাবে কারো উপস্থিতি ছাড়াই যেখানে কাজ থেমে গিয়েছিল সেখান থেকে কাজ শুরু করবে। এটা পৃথিবীতে প্রথম আমাদের কোম্পানী করেছে। এটা শিল্প মন্ত্রনালয়ে পেটেন্টের আবেদন করা হয়েছে।
 
এছাড়াও আফটার সেলস সার্ভিস দিতে আমরা একটা অ্যাপ ডেভেলপ করেছি। এটা ব্যবহারের মাধ্যমে কাস্টমাররা সহজেই আমাদের সাথে যোগাযোগ ও সংযুক্ত থাকতে পারবে এবং আমাদের ইঞ্জিয়ারদের মাধ্যমে সব ধরনের সহযোগিতা পাবে। আফটার সেলস সার্ভিসের জন্য বাংলাদেশে এটা হবে এ ধরনের প্রথম অ্যাপ।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২২
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।