জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে যেভাবে এগিয়ে নিয়েছিলেন, তার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়ন, পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল চালু করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বেড়েছে।
সরকার নাগরিক চাহিদা পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। একটি জনবান্ধব সরকার রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার আলোকে নাগরিকসেবা প্রদানে সর্বদা তৎপর। সরকারের প্রতি সর্বসাধারণের আস্থা নির্ভর করে কল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে একটি কল্যাণমূলক উদ্যোগ। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় একটি মাইলফলক। সম্পদের সুষম বণ্টন কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলমন্ত্র। প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিধবাসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষায় সরকার ভাতা কর্মসূচি চালু করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ দেশের সর্বসাধারণের সামাজিক সুরক্ষার অনন্য এক উদ্যোগ।
বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি এই ইশতেহারে জাতীয়ভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি জাতির কাছে পেশ করেন। দেশে অনেক রাজনৈতিক দল আছে। প্রতিটি দল পৃথকভাবে একটি বৃহৎ সামাজিক সংগঠন হিসেবে বিবেচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর আছে পৃথক ভাবধারা, দর্শন ও পরিকল্পনা। দলগুলো নিজ নিজ কর্মসূচি ও পরিকল্পনা জনসমক্ষে উপস্থাপন করে। গণতান্ত্রিক রীতি মতে, জনমত নিয়ে দলগুলো সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এ ধারাবাহিকতায় বয়স্কদের জন্য ব্যাপকভিত্তিক পেনশন ব্যবস্থা চালু করার বিষয় জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সমন্বিত ‘পেনশন কার্যক্রম’ চালুর আওতায় বয়স্ক ভাতা প্রদানের পাশাপাশি ‘জাতীয় সামাজিক বীমা কর্মসূচি’ এবং ‘বেসরকারি ভলান্টারি পেনশন’ চালুর প্রস্তাবনা রাখা হয়।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্য অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ, কর্তৃপক্ষের কার্যাবলি, পেনশন গভর্নিং বোর্ড, সর্বজনীন পেনশন তহবিল ও পেনশন বিতরণ পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ রয়েছে।
জীবনচক্রের বিভিন্ন স্তরে মানুষ নানা ঝুঁকি, অভিঘাত, বিপদ-আপদ ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে থাকে। ঝুঁকির মাত্রায় স্তরভেদে পার্থক্য রয়েছে। যেমন একজন ষাটোর্ধ্ব মানুষের ঝুঁকি কর্মক্ষম মানুষের ঝুঁকি থেকে চ্যালেঞ্জিং। এই সময়ে একজন ব্যক্তি ক্রমাগত ভেঙে পড়ে, কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, আয়-উপার্জন হ্রাস পায়, যত্নের অভাব, শক্তি কমে যাওয়াসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় পতিত হয়। জীবনচক্রের শেষ ধাপ বা বার্ধক্য বয়সে প্রত্যেকের সামাজিক সুরক্ষা একান্ত আবশ্যক। সরকার ষাটোর্ধ্ব নাগরিকের সামাজিক সুরক্ষায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে, যা জাতির জন্য এক শুভ সংবাদ। জনমিতিকভাবে দেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ ভোগ করছে।
২০৩০ সালের মধ্যে এ দেশ বয়স্ক জাতির পর্যায়ে প্রবেশের অপেক্ষায়। সমগ্র দেশে বর্তমানে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা ১.১৩ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। ২০২৫ সালে মোট প্রবীণের সংখ্যা হবে ২.৮০ কোটি। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা হবে ৪.৫০ কোটি এবং ২০৬০ সালে হবে ৫.৬১ কোটি। ২০৫০ সালে দেশে প্রবীণ জনসংখ্যার হার হবে ২০ শতাংশ। দেশের বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর। এই হার ২০৫০ সালে ৮০ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৫ বছর হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। প্রবীণ সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের চাহিদা নিরূপণ করতে হবে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেনশন স্কিম উদ্বোধন করেছেন। উদ্বোধনের পর দেশে-বিদেশে বসবাসরত ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কোনো বাংলাদেশি সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থার আওতায় আসতে পারছেন। এ স্কিমের আওতায় সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া দেশের সব নাগরিক পেনশন সুবিধার অন্তর্ভুক্ত হলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পর এটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। স্কিম অনুযায়ী ব্যক্তির বয়স ৬০ বছর হলেই তিনি সরকার থেকে পেনশন পেতে শুরু করবেন। তাকে আর চাঁদা দিতে হবে না। কিন্তু কেউ যদি ৫৫ বছর বয়সে এসে স্কিমে অংশ নেন, তা হলে ৬৫ বছর বয়স থেকে তিনি পেনশন পেতে শুরু করবেন। সরকার মোট ৬টি স্কিমের কথা ঘোষণা করেছে। তবে আপাতত চালু হয়েছে চারটি স্কিম।
এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা। প্রবাস এটি শুধু বিদেশে কর্মরত বা অবস্থানকারী বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য। এর মাসিক চাঁদার হার ধরা হয়েছে ৫ হাজার, সাড়ে ৭ হাজার ও ১০ হাজার টাকা করে। ব্যক্তি চাইলে এই চাঁদার সমপরিমাণ অর্থ তিনি যে দেশে আছেন, সে দেশের মুদ্রায় দিতে পারবেন। আবার দেশে এসে দেশীয় মুদ্রাতেও দিতে পারবেন। এ ছাড়া প্রয়োজনে প্রবাস স্কিম পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকছে। প্রগতি এই স্কিম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য। এ ক্ষেত্রেও তিন ভাগে চাঁদার হার ভাগ করা হয়েছে। কেউ চাইলে মাসে ২ হাজার, ৩ হাজার বা ৫ হাজার টাকা করে দিয়ে এই স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। আবার প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের মালিকও প্রগতি স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে মোট চাঁদার অর্ধেক কর্মচারী ও বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বহন করবে। সুরক্ষা এ স্কিমটি স্বনির্ভর ব্যক্তির জন্য। অর্থাৎ কেউ কোথাও চাকরি করছেন না; কিন্তু নিজে উপার্জন করতে পারেন, তারা সুরক্ষা স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। এর আওতায় পড়েন ফ্রিল্যান্সার, কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদি পেশার লোকজন। এই স্কিমে চাঁদার হার চার রকম মাসে এক হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা করে। সমতা এই স্কিমে চাঁদার হার একটিই, এক হাজার টাকা। তবে এ ক্ষেত্রে প্রতিমাসে ব্যক্তি দেবে পাঁচশ টাকা আর বাকি পাঁচশ দেবে সরকার। মূলত দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসরত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই স্কিম। এ ক্ষেত্রে দারিদ্রসীমা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। বর্তমানে বছরে যাদের আয় ৬০ হাজার টাকার মধ্যে, তারাই কেবল এই স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হবেন। পেনশনব্যবস্থার আওতায় আসতে গেলে অবশ্যই জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) থাকতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশি যাদের এনআইডি নেই, তারা পাসপোর্টের ভিত্তিতে পারবেন। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এনআইডি সংগ্রহ করে পেনশন কর্তৃপক্ষের কাছে তা জমা দিতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় বৃদ্ধকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয়ভাবে একটি সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে সরকার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। এতে দেশে একটি ব্যাপকভিত্তিক সমন্বিত অংশগ্রহণমূলক পেনশনব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। ২০১৫ সালে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেন। ২০১৬ সালে ভারত ঘুরে এসে অর্থ বিভাগের একটি দল একটি ধারণাপত্র তৈরি করে। ২০২২ সালে সর্বশেষ আরেকটি ধারণাপত্র তৈরি করে অর্থ বিভাগ। এর পর এ বছরের ৩১ জানুয়ারি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন এবং আইনের আওতায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে গেলে পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। প্রথমেই একটি পাতা আসবে যেখানে লেখা থাকবে এ কথাগুলো, ‘প্রত্যয়ন করছি যে আমি সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নই। সর্বজনীন পেনশন স্কিমবহির্ভূত কোনো ধরনের সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা গ্রহণ করি না। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে পেনশনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রত্যেক চাঁদাদাতার জন্য একটি আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে। চাঁদাদাতা ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ হওয়ার বাকি সময় মাসিক ভিত্তিতে পেনশন পাবেন। ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে কেউ মারা গেলে জমা হওয়া অর্থ মুনাফাসহ ফেরত পাবেন নমিনি। পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে এবং মাসিক পেনশনের অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। চাঁদা পরিশোধের ধরনের মধ্যে মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক এ তিন অপশন রয়েছে। চারটি স্কিমের জন্য আলাদা চারটি হিসাব খোলা হয়েছে সোনালী ব্যাংকে। এ হিসাবগুলোয় চাঁদা জমা হবে। সোনালী ব্যাংক দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরে অন্য ব্যাংকও যুক্ত হবে। নির্ধারিত ফরম পূরণ করে এ ব্যাংকের মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কেউ পেনশন স্কিমের চাঁদা দিতে পারবেন। নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। পেনশন তহবিলে জমা দেওয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেওয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন, যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার পর আমৃত্যু আর্থিক সুবিধা পান প্রতিমাসে। সেই চাকরিজীবী মারা গেলে তার স্ত্রী ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে তাকেও আমৃত্যু পেনশন দেওয়া হবে। কিন্তু বেসরকারি খাতে কর্মরতদের জন্য অবসরজীবনে ও তাদের সন্তানদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সুবিধা নেই। সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি প্রতিবন্ধিতাজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতা-পিতৃহীনতা অথবা বার্ধক্যজনিত বা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকারের কথা সংবিধানে বলা রয়েছে। এই আইনের আওতায় অর্থ বিভাগের অধীন একটি ‘সর্বজনীন পেনশন অথরিটি’ গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। ২০৩১ সালের মধ্যে দেশে দুই কোটির বেশি মানুষের বয়স হবে ৬০ এর উপরে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫ বছরের উপরে দরিদ্র বয়স্কদের ৫০০ টাকা করে মাসিক ভাতা দেয় সরকার। তবে ৬৫ বছরের উপরে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ কোন ধরনের পেনশন ও বয়স্ক ভাতা কিছুই পান না। ব্যতিক্রমী উদ্যোগের মত সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম চালু হলে ভবিষ্যতে জনগণের মধ্যে এক ধরণের নিরাপত্তাবোধ জন্ম নিবে। আজ বয়স্ক মানুষরা যেভাবে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে, সেই ভাবনা তাদের মধ্যে আর থাকবে না। আর এই কারণেই শেখ হাসিনাকে জনবান্ধব রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আখ্যা প্রদান করা যেতেই পারে।
এ দেশের মানুষ ভবিষ্যৎ নিরাপত্তায় ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী ছিল। যেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স য়, গবাদি পশু লালন-পালন, কৃষিজমি ক্রয়, কৃষিজমি বন্ধক গ্রহণসহ ইত্যাদি পদ্ধতিতে মানুষ ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রচেষ্টা চালাত, যা ছিল দেশের সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রথাগত পন্থা। দেশে সর্বসাধারণের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য পেনশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন ব্যবস্থার প্রচলন আছে। চলতি অর্থবছরে ‘পেনশন ও গ্র্যাচুইটি’ খাতে সরকারের মোট ব্যয় ২৮ হাজার ২০৯ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৪.৭ শতাংশ। দেশের ১৪ লাখ গণ-কর্মচারীদের অবসরকালীন সামাজিক সুরক্ষার লক্ষ্যে এ পেনশন ব্যবস্থা। রাষ্ট্র কি শুধু স্বল্পসংখ্যক সরকারি চাকরিজীবীর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে! নাকি সব নাগরিকের সুরক্ষার বিষয় বিবেচনা করবে! দেশের ভেতরে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাষ্টমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ২২৯টি শাখাই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। পেনশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের চুক্তি হয়েছে। সোনালী ব্যাংকে কারও হিসাব থাকুক বা না থাকুক, নির্ধারিত ফরম পূরণ করে এ ব্যাংকের মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি বয়সি যে কেউ পেনশন স্কিমের চাঁদা দিতে পারবেন।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন জাতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি অনন্য উপহার সন্দেহ নেই। জনকল্যাণমুখী সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি হিসেবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা সর্বাত্মকভাবে বাংলাদেমকে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ভালো। বৈশ্বিক সংকটকালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং দেশকে খুব ভালোভাবে পরিচালনা করছেন। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে ও আংশিক উদ্বোধন হবে আগামী মাসে। উদ্বোধনের অপেক্ষায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল। মহাকাশেও বাংলাদেশ তার অবস্থান ঘোষণা করেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতু উদ্বোধন দু’টিই উন্নয়নের মাইলফলক। সফলভাবে কারোনা মহামারি মোকাবেলা, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম বিশ্বে ৫ম। শিক্ষা, যোগাযোগ অবকাঠামো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সামাজিক কর্মসূচির আওতায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, অসহায়, বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তালাকপ্রাপ্ত ও নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তা, অটিজম, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান উল্লেখযোগ্য। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে মোট ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৭টি পরিবারকে ঠিকানা গড়ে দেওয়া হয়েছে আগস্ট মাস পর্যন্ত। যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ৮৫ জনের এবং পুনর্বাসিত পরিবারগুলিকে তিন মাসের জন্য ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, নারীর ক্ষমতায়নসহ ও বিভিন্ন সেক্টরের সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে সরকার। প্রায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন, রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আনয়ন, দারিদ্র্যের হার হ্রাস ৪০ থেকে ১৮ তে নেমেছে। সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতিদান, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়ন। এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য চারটি ভিত্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এগুলো হলো-স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। এর পাশাপাশি হাতে নেওয়া হয়েছে ২১০০ সালের বদ্বীপ কেমন হবে- সেই পরিকল্পনা। স্মার্ট বাংলাদেশে সব কাজ, সম্পাদন করা হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে হবে দক্ষ। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক এবং উদ্ভাবনী বাংলাদেশ। স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট ট্রান্সপোর্টেশন, স্মার্ট ইউটিলিটিজ, নগর প্রশাসন, জননিরাপত্তা, কৃষি, ইন্টারনেট কানেকটিভিটি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত ১৫ বছরে দেশকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন ও বাংলাদেশ বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটেও অন্য দেশগুলোর মতো বড় ধরনের কোনো অর্থনৈতিক সংকটে না পড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তিনি এই সময়ে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্ত অবস্থানে নিতে পেরেছেন। তা না হলে ১৭ কোটি মানুষের দেশটাকে এই সংকটকালেও বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা বেশ কঠিন হতো। শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, আগামী দিনেও আমার প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা অব্যাহত রাখার জন্য আমি বাংলাদেশের জনগণকে অনুরোধ জানাই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশবাসীকে একটি উন্নত জীবন উপহার দেওয়া, যার জন্য তিনি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমরা শোকের মাসে সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা চালু করেছি। জনগণকে একটি সুন্দর ও উন্নত জীবন দেওয়ার আমাদের প্রচেষ্টা দেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গমাতার আত্মা শান্তি পাবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক