ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

জাতিগত নিধন ও গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
জাতিগত নিধন ও গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা শরণার্থী আসছে কাঁটাতার পেরিয়ে। ছবি: সোহেল সরওয়ার।

সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা। রহম বা রহমত নয়, যাদের উপর এখন নেমে এসেছে গণহত্যার গজব। জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে প্রতিদিন পাখির মতো লুটিয়ে পড়ছে শত শত রোহিঙ্গা। শিশু, বৃদ্ধ, নারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে আসছে। বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত, নিপীড়ত, রাষ্ট্রবিহীন সংখ্যালঘু জাতির নাম এখন রোহিঙ্গা।
 

পালাক্রমে রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬-২০১৭ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমনের সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর চালানো দমন ও নির্যাতনকে জাতিগত নির্মূলতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, যেখানে গণহত্যার মত অপরাধের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে।

জাতিসংঘে নিযুক্ত মিয়ানমারের বিশেষ তদন্তকারী ইয়ংহি লি বিশ্বাস করেন, মিয়ানমার পুরোপুরি তাদের দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের বিতড়িত করতে চায়। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আঘাতের চিহ্ন, মৃতদেহগুলো প্রমাণ করে হত্যার উদ্দেশ্যেই তাদেরকে আঘাত করা হয়েছে। যারা পারছে, তারা প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়ছেন। এভাবেই মিয়ানমার চাচ্ছে আরাকান জনপদটিকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে। জাতিগত নিধনের লক্ষ্যে গণহত্যার মাধ্যমে এই নারকীয় আক্রমণ চালানো হচ্ছে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর।

রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মিয়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং, মংডু, কিয়কতাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা, কাইউকপাইউ, পুন্যাগুন ও পাউকতাউ এলাকায় এদের নিরঙ্কুশ বসবাস ছিল। এছাড়া মিনবিয়া, মাইবন ও আন এলাকায় মিশ্রভাবে বসবাস করতো, যারা বিভিন্ন সময় বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত ও রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী।

রোহিঙ্গা শরণার্থী।  ছবি: সোহেল সরওয়াররোহিঙ্গা অথবা  আরাকানি মানুষগুলো পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আরিয়ান জনগোষ্ঠী। সাম্প্রতিক ২০১৬-১৭ মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের পূর্বে অনুমানিক ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করত। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারি, যদিও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারিও রয়েছে। তাদের ভাষা রোহিঙ্গা ও বার্মিজ। কেউ কেউ আরবী ও উর্দু ভাষাও জানেন। গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে দুই-তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গাই দেশছাড়া। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, নেপাল ও ভারতে ছড়িতে গেছে এই দেশ-বিতাড়িত মানুষগুলো।

৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও, বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। এছাড়াও তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর এখন পাখির মতো হত্যা করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধরাও রেহাই পাচ্ছে না নৃশংস গণহত্যার কবল থেকে।

১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৮২ সালের আইনে “রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়। অথচ মানুষগুলো সুপ্রাচীনকাল থেকেই আরাকান অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। বর্তমান মিয়ানমারের "রোসাং" এর অপভ্রংশ "রোহাং" (আরাকানের মধ্যযুগীয় নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। আরাকানের প্রাচীন নাম রূহ্ম জনপদ।

ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশে পূর্ব ভারত হতে প্রায় খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ বছর পূর্বে অস্ট্রিক জাতির একটি শাখা "কুরুখ" (Kurukh) নৃগোষ্ঠী প্রথম বসতি স্থাপন করে, ক্রমান্বয়ে বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। এ সকল নৃগোষ্ঠীর শংকরজাত জনগোষ্ঠী হলো এই রোহিঙ্গা। অষ্টম শতাব্দীতেই আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের (বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের নিকট) চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। এ কারণেই রোহিঙ্গা কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের পাশাপাশি উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে।

১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজ্য দখলদার কট্টর বৌদ্ধ বর্মী রাজা "আনাওহতা" (Anawahta) সংখ্যালঘু মগদের রাজ্য বার্মা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে বৌদ্ধ বসতি স্থাপন করেন। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস দক্ষিণে বার্মার বংশোদ্ভুত ‘মগ’ ও উত্তরে ভারতীয় বংশোদ্ভুত ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়। অন্যদিকে, রাখাইন শব্দটি এসেছে পালী শব্দ রাক্ষাপুরা থেকে, যার সংস্কৃত প্রতিশব্দ হলো রাক্ষসপুরা। অর্থাৎ রাক্ষসদের আবাসভুমি। প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় শাস্ত্রাদিতে অস্ট্রিক (অস্ট্রোলয়েড) মহাজাতিকে রাক্ষস জাতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো- মগ জাতির কিন্তু অস্ট্রোলয়েড মহাজাতির সাথে কোন সমর্ক নেই, তারা মঙ্গোলয়েড মহাজাতি অন্তর্ভুক্ত জাতি।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মধ্যযুগে ওখানকার রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ঐ রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন। রোসাঙ্গ রাজ্যের রাজভাষা ফার্সি ভাষার সাথে বাংলা ভাষাও রাজসভায় সমাদৃত ছিল। আলাওল, মাগন ঠাকুর প্রমুখ বাঙালি কবি রাজদরবারে স্থান পেয়েছিলেন। সেখানে শিল্প ও সাহিত্যের বিকাশ লাভ করেছিল।

রোহিঙ্গা শরণার্থী।  ছবি: সোহেল সরওয়ারইতিহাস থেকে এটাও জানা যায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহাঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। আরাকানের ইতিহাসে সম্রাট নারামেখলার (১৪৩০-১৪৩৪) শাসনকালের গুরুত্ব অপরিসীম। সে সময় বাঙালিদের আরাকানে বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। ২৪ বছর বাংলায় নির্বাসিত থাকার পরে সম্রাট বাংলার সুলতানের সামরিক সহায়তায় পুনরায় আরাকানের সিংহাসনে আরোহন করতে সক্ষম হন। যে সব বাঙালি সম্রাটের সাথে এসেছিল তারা আরাকানে বসবাস করতে শুরু করে। সম্রাট নারামেখলা বাংলার সুলতানের দেওয়া কিছু অঞ্চল ও আরাকানের ওপর সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। সম্রাট নারামেখলা পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বাংলার প্রতি কৃ্তজ্ঞতা স্বরূপ আরাকানে বাংলার ইসলামী স্বর্ণমূদ্রা চালু করেন। পরবর্তীতে নারামেখলা নতুন মূদ্রা চালু করেন যার একপাশে ছিল বার্মিজ বর্ণ এবং অপরপাশে ছিল ফার্সি বর্ণ।

বাংলার প্রতি আরাকানের কৃ্তজ্ঞতা ছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। ১৪৩৩ সালে সুলতান জালালুদ্দিন মুহাম্মদ শাহের মৃত্যু হলে সম্রাট নারামেখলার উত্তরাধিকারীরা ১৪৩৭ সালে রামু এবং ১৪৫৯ সালে চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। বাংলার সুলতানদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও আরাকানের রাজারা মুসলিম রীতিনীতি বজায় রেখে চলে। বৌদ্ধ রাজারা নিজেদেরকে বাংলার সুলতানদের সাথে তুলনা করতো এবং মুঘলদের মতোই জীবন যাপন করতো। তারা মুসলিমদেরকেও রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিত। ১৭ শতকের দিকে আরাকানে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারা আরাকানের বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রে কাজ করতো। যেহেতু রাজারা বৌদ্ধ হওয়ার পরেও বাংলার সুলতানদের রীতিনীতি অনুযায়ীই রাজ্য পরিচালনা করতো, তাই আরাকানের রাজদরবারে বাংলা, ফার্সি এবং আরবী ভাষার হস্তলিপিকরদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বাঙালি। কামেইন বা কামান নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যারা মিয়ানমার সরকারের নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্ত্বার মর্যাদা পেয়েছে তারা আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠীরই একটা অংশ ছিল।

মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর চরম বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। মূলত ১৭৮৫ সালে বার্মিজরা আরাকান দখল করে। এর পরে ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ বার্মিজদের গ্রেফতার এড়াতে এবং আশ্রয়ের নিমিত্তে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। বার্মার শোসকেরা আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং একটা বড় অংশকে আরাকান থেকে বিতাড়িত করে মধ্য বার্মায় পাঠায়। যখন ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে তখন যেন এটি ছিল একটি মৃত্যুপুরী। ১৭৯৯ সালে প্রকাশিত "বার্মা সাম্রাজ্য"তে ব্রিটিশ ফ্রাঞ্চিজ বুচানন-হ্যামিল্টন উল্লেখ করেন, "মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ) - এর অনুসারীরা", যারা অনেকদিন ধরে আরাকানে বাস করছে, তাদেরকে কখনই  "আরাকানের স্থানীয় বাসিন্দা" বা "আরাকানের মুলনিবাসী" (Native of Arakan) উল্লেখ করে নাই ।

পরে ভূখণ্ডটি  ব্রিটিশদের দখলে আসে। ইংরেজরা তখন বড় ধরনের ভুল করে এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন জ্বলন্ত। তারা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কাশ্মীর থেকে আরাকান পর্যন্ত এ ধরনের বহু ভুল করে গেছে শোষক ব্রিটিশ শাসকরা, যার বোঝা নানা দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মাধ্যমে স্থানীয় মানুষগুলোকে রক্ত আর জীবন দিয়ে এখনো টানতে হচ্ছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী।  ছবি: সোহেল সরওয়ারউল্লেখ্য, কৃষিকাজের জন্য আরাকানের কম জন অধ্যুষিত এবং উর্বর উপত্যকায় আশপাশের এলাকা থেকে বাঙালি অধিবাসীদের অভিবাসন করার নীতি গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। আরাকান ও বাংলার মাঝে কোন আন্তর্জাতিক সীমারেখা ছিল না এবং এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোন বিধি-নিষেধও ছিল না। তাছাড়া ব্রিটিশরা আরাকান দখলের পূর্বকার সময় কালাদান নদী উত্তর তীর পর্যন্ত চট্টগ্রামের দক্ষিণ সীমানা ছিল, যা বারমার সাথে যুক্ত ছিল বলে কোন ঐতিহাসিক দলিলের অস্তিত্ব এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয় নি। ১৯ শতকে, হাজার হাজার বাঙালি কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানে গিয়ে বসতি গড়েছিল। এছাড়াও, হাজার হাজার রাখাইন আরাকান থেকে বাংলায় চলে এসেছিল।

১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের করা এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, আরাকানে তখন ৫৮,২৫৫ জন মুসলমান ছিল। ১৯১১ সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৮,৬৪৭ জন হয়। অভিবাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বাংলার সস্তা শ্রম যা আরাকানের ধান ক্ষেতের কাজে লাগত। বাংলার এই অধিবাসীরা (বেশিরভাগই ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলের) মূলত আরাকানের দক্ষিণেই অভিবাসিত হয়েছিল। এটা নিশ্চিত যে, ভারতের এই অভিবাসন প্রক্রিয়া ছিল পুরো অঞ্চল জুড়ে, শুধু আরাকানেই নয়। ঐতিহাসিক থান্ট মিন্ট-ইউ লিখেছেন: "বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বার্মায় আসা ভারতীয়দের সংখ্যা কোনভাবেই আড়াই লক্ষের কম নয়। এই সংখ্যা ১৯২৭ সাল পর্যন্ত বাড়তেই থাকে এবং অভিবাসীদের সংখ্যা হয় ৪৮০,০০০ জন, রেঙ্গুন নিউ ইয়র্ককেও অতিক্রম করে বিশ্বের বড় অভিবাসন বন্দর হিসেবে। মোট অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১.৩ কোটি (১৩ মিলিয়ন)। " তখন বার্মার রেঙ্গুন, আকিয়াব, বেসিন, প্যাথিন এবং মৌমেইনের মত অধিকাংশ বড় শহরগুলোতে ভারতীয় অভিবাসীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশ শাসনে বার্মিজরা অসহায়ত্ব বোধ করত এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামার মাধ্যমে তারা অভিবাসীদের উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত।

অভিবাসনের ফলে সংঘাত মূলত আরাকানেই ছিল সবচেয়ে প্রকট। ১৯৩৯ সালে, রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যকার দীর্ঘ শত্রুতার অবসানের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন জেমস ইস্টার এবং তিন তুতের দ্বারা একটি বিশেষ অনুসন্ধান কমিশন গঠন করে। কমিশন অনুসন্ধান শেষে সীমান্ত বন্ধ করার সুপারিশ করে, এর মধ্যে শুরু হয় ২য় বিশ্ব যুদ্ধ এবং এর পরে ব্রিটিশরা আরাকান ছেড়ে চলে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানীরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্হ বার্মায় আক্রমণ করে। ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে। এর মধ্যে বৌদ্ধ রাখাইন এবং মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ব্রিটিশপন্থিদের সাথে বার্মার জাতীয়তাবাদীদেরও সংঘর্ষ হয়। জাপানীদের আক্রমণের সময় উত্তর আরাকানের ব্রিটিশপন্থি অস্ত্রধারী মুসলমানদের দল বাফার জোন সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গারা যুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষকে সমর্থন করেছিল এবং জাপানী শক্তির বিরোধিতা করেছিল, পর্যবেক্ষণে সাহায্য করেছিল মিত্রশক্তিকে। ফলে জাপানীরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল। এই সময়ে প্রায় ২২,০০০ রোহিঙ্গা সংঘর্ষ এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশান্তরী হয়। জাপানী এবং বার্মার দ্বারা বারংবার গণহত্যার শিকার হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা তখন থেকেই দেশ ছাড়তে থাকে।

১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসানের পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জীবনে শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। জোর করে কেড়ে নেওয়া হয় সহায়-সম্পদ ও নানা মানবিক-আইনগত অধিকার। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে আরাকানি রোহিঙ্গাদের। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বঞ্চিত করা হয়। বিয়ে করার অনুমতি ছিনিয়ে নিয়ে সন্তান হলে তাদেরকে নাগরিক হিসাবে নিবন্ধন করা বন্ধ থাকে। তাদের জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।

রোহিঙ্গা শরণার্থী।  ছবি: সোহেল সরওয়ারমিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী 'কালা' নামে পরিচিত। বিদেশিদেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা ও অবজ্ঞা।

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির সময় আরেকটি বিরাট রাজনৈতিক ভুলের অবতারণা ঘটে। তারা জিন্নাহের সাথে একাধিক বৈঠক করে পাকিস্তানের সাথে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। আর শুরু হয় রোহিঙ্গাদের কপাল পোড়া। তাদের এই কাজটা আরাকানের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী মেনে নিতে পারে নি। তাদের কপালে “বেঈমান” তকমা লেগে যায়। এদিকে জিন্নাহ শেষমেশ অস্বীকৃতি জানায়। তখন তারা নিজেরাই রোহিঙ্গা মুসলিম পার্টি গঠন করে আরাকান স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। আর তারা একদম ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে যায় বার্মার সরকারের কাছে। ১৯৬২ সালে সামরিক সরকার বার্মায় ক্ষমতা পেলে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার বেড়ে যায়। ১৯৭৮ আর ১৯৯২ সালে দুইবার তাদের উপর সামরিক অভিযান চালানো হলে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পালায়। এই আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ২০১৭ সালের আগস্টে শুরু হওয়া আক্রমণেও লাখ লাখ রোহিঙ্গা গৃহহীন-উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়।

স্বাধীনতা পেলেও প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে বার্মা শাসন করছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এরা বার্মিজ জাতীয়তাবাদ এবং থেরাভেদা বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে। আর এর ফলেই তারা রোহিঙ্গা, চীনা জনগোষ্ঠী যেমন - কোকাং, পানথাইদের (চীনা হুই মুসলিম) মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে ব্যপকভাবে নির্যাতন করে থাকে। কিছু নব্য গণতন্ত্রপন্থি নেতা যারা বার্মার প্রধান জনগোষ্ঠী থেকে এসেছেন তারাও রোহিঙ্গাদের বার্মার জনগণ হিসেবে স্বীকার করেন না। বার্মার সরকার রোহিঙ্গা ও চীনা জনগোষ্ঠীর মত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার উসকানি দিয়ে থাকে এবং এ কাজ তারা অতি সফলতার সাথেই করে যাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলা হয় "বিশ্বের সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত জনপদ"। এবং "বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু"।

১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়। তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না এবং দুইয়ের বেশি সন্তান না নেওয়ার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়। রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের অধিকাংশের বার্মার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। তাদের উপর বিভিন্ন রকম অন্যায় ও অবৈধ কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের জমি জবর-দখল করা, জোর-পূর্বক উচ্ছেদ করা, ঘর-বাড়ি ধ্বংস করা এবং বিবাহের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেওয়া হয়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুসারে, ১৯৭৮ সাল থেকে মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা নতুন করে মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়ে স্বদেশ ছেড়ে বিশ্বের দেশে দেশে পালিয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর 'নাগামান' ('ড্রাগন রাজা') অভিযানের ফলে প্রায় দুই লক্ষ (২০০,০০০) রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সরকারিভাবে এই অভিযান ছিল প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যে সব বিদেশি অবৈধভাবে মিয়ানমারে বসবাস করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই সেনা অভিযান সরাসরি বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলছিল এবং ফলে ব্যাপক গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের ঘটনা ঘটে।

জ্বলছে রাখাইন রাজ্য।  ছবি: সোহেল সরওয়ারপরবর্তীতে ১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন দাঙ্গায় প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। ২০০৫ সালে, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে এই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। বিশেষতঃ ২০১৫ সময়কালে তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে চলমান গণহত্যায় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসছে। বাংলাদেশ সীমান্তে শরণার্থীর ঢল নেমেছে। সেই সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। যাদের মধ্যে ছিন্নমূল ও বিধবা নারীর সংখ্যাই বেশি। সীমান্তে ওপারে জ্বলন্ত আরাকানে শত শত স্বজনের লাশ ফেলে এসেছে এই অসহায়-হতভাগা মানুষগুলো, যারা আধুনিককালের বর্বরতম গণহত্যার শিকার।  

পৃথিবীর ইতিহাসে বেশ কিছু চরম গণহত্যার তালিকায় রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ স্থান পাওয়ার মতো হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করছে না। ইতিহাসের পাতা থেকে যদি আমরা তুলনা করি তবে দেখতে পাবো, রোহিঙ্গা গণহত্যাটিও প্রচণ্ড ভয়াবহ।

যেমন, আর্মেনীয় গণহত্যায় (১৯১৫-১৯২৩) তুরস্কের অটোম্যান শাসনামলে (১৯২১ থেকে ১৯২২) তৎকালীন আর্মি অফিসার এনভার পাশার নেতৃত্বে বিংশ শতাব্দীর সর্ব বৃহৎ গণহত্যা সংগঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এবং তৎপরবর্তী সময়ে তুরস্ক শুধু ১.৮ মিলিয়নের অধিক আর্মেনীয় এবং অ-তুর্কীদের সরাসরি হত্যা এবং বিতাড়িতই করেনি, এছাড়াও হাজার হাজার আর্মেনীয় এবং অ-তুর্কিকে খাদ্যাভাবে মৃত্য বরণ করতে বাধ্য করে। তুরস্ক যখন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত তখন সর্ব প্রথম কনসেনট্রেমন ক্যাম্পের সাথে বিশ্বের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যও তুরস্ককে অভিযুক্ত করা হয়।

সোভিয়েত রাশিয়ার স্তালিন যুগের (১৯২৯-১৯৫৩) জোসেফ স্তালিনকে ধরা হয় বিংশ শতাব্দীর কুখ্যাত গণহত্যাকারী, যে তালিকায় হিটলার এবং মাও সে-তুংও আছেন।   স্তালিন সক্ষম হয়েছিলেন নিজের জাতিকে টুকরো টুকরো করতে। এই অপকর্ম তিনি করেছিলেন কারা অভ্যন্তরে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত এক্সটারমিনেশন ক্যাম্পের  মাধ্যমে।   স্তালিনের শাসনামলে ঠিক কতজনকে হত্যা করা হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয়, প্রায় কুড়ি মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেন এই গণহত্যাকারী। এই কুড়ি মিলিয়নের মধ্যে দুই মিলিয়ন হলো দুর্ভিক্ষ পিড়িত ইউক্রেনিয়ান কৃষক।

দ্য হলোকস্ট (১৯৩৯-১৯৪৫) যদিও জঘন্য গহত্যার তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে তথাপি এই গণহত্যা এখনো সবচেয়ে নিন্দিত এবং খুবই সতর্কতার সাথে এই গণহত্যার তথ্য লেখা হয়েছে। হিটলারের নাজি বাহিনী কর্তৃক ইহুদিদের ইউরোপ মহাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণার প্রেক্ষিতে প্রায় ১১ মিলিয়ন মৃত্যু সংগঠিত হয়েছিল যার অর্ধেকই ছিল ইহুদি।

হিরোশিমা ও নাগাসাকি গণহত্যা ঘটেছিল ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখজনক দুটি দিন যখন জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহর দুটি সম্পূর্ণ রূপে ধংস প্রাপ্ত হয়। বিংশ শতাব্দীতে প্রচলিত ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে গণহত্যার মত জঘন্য অপরাধ যেন অতি সাধারণ ঘটনায় রূপ নিয়েছে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমা শহরে ফেলা হয় প্রথম আনবিক বোমা। এই বিস্ফোরণ কেড়ে নেয় প্রায় দুই লক্ষ প্রাণ এবং অনেকের কোনো হদিসই পাওয়া যায়নি। প্রথম বিস্ফোরণের ঠিক দুই দিন পরেই অর্থাৎ ৯ আগস্ট সকাল ১০ টা ৫৮ মিনিটে নাগাসাকির একটি শিপইয়ার্ড এর উপর ফেলা হয় ২০ কিলোটন ক্ষমতা সম্পন্ন বোমা, যেদিন প্রায় ৭০ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। ভৌগলিক কারণে দ্বিতীয় আনবিক বোমাটি হিরোশিমার চেয়ে নাগাসাকিতে কম ক্ষতি সাধন করে।

রোহিঙ্গা শরণার্থী।  ছবি: সোহেল সরওয়ারভারত ভাগ (১৯৪৭)-এর সময়কালে ব্যাপক গণহত্যা সংগঠিত হয়, যাতে নিহত হয় এক মিলিয়নের মত মানুষ, আর কপর্দকহীন ভাবে স্থানান্তরিত হয় অগণিত।

চীনের গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবকালে (১৯৪৯-১৯৭৬) কমিউনিস্ট চায়নাতে প্রায় ৪৫ থেকে ৭০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। বিভিন্ন ঘটনায় এই মৃত্যু সংগঠিত হয়েছিল।   একটি ঘটনা ছিল, যখন কমিউনিস্ট ফোর্স, চ্যাং কি-শেক এর ন্যাশনাল আর্মিকে পরাস্ত করে। বস্তুত বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় দুটি ধারায়: একটি হচ্ছে মাও সে তুং এর গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড কর্মকাণ্ড, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়।

বাংলাদেশ গণহত্যা (মার্চ –ডিসেম্বর ১৯৭১) বা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর অধীনে মার্চ, ১৯৭১ সালে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়েছিল, যা নয় মাসব্যাপী পরিচালিত হয় এবং আনুমানিক ত্রিশ লক্ষ ব্যক্তিকে হত্যা ও দুই লক্ষ থেকে চার লক্ষ বাংলাদেশি নারীকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করা।

কম্বোডিয়ার কিলিং ফিল্ডস (১৯৭৫-১৯৭৮)-এ খেমার রুজ বাহিনী কম্বোডিয়ার সরকার উৎখাতের মাধ্যমে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করে। খেমার রুজদের প্রথম কাজ ছিল সাবেক শাসন ব্যবস্থার সাথে যারা যুক্ত ছিল তাদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে হত্যা করা।   স্বল্পস্থায়ী এই গণহত্যায় হতাহতের সংখ্যা দুই মিলিয়নের কম ছিল না, যা কম্বোডিয়ার জনসংখ্যার কুড়ি ভাগ।  

সার্ব কর্তৃক বসনিয়ান গণহত্যা (১৯৯২-১৯৯৫), যাতে ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্রের বসনিয়া হার্জেগোভিনা সরকার যুগোস্লাভিয়া থেকে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।   স্বাধীনতা ঘোষণার পরবর্তী কয়েক বছর বসনিয়ার সার্ব বাহিনী যুগোস্লাভিয়ার সার্ব অধ্যুষিত সেনাবাহিনীর সহায়তায় বসনিয়ার বেসামরিক বসনিয়াক মুসলিম এবং ক্রোয়েশীয় নাগরিকদের লক্ষ্য করে বর্বর হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত করে। এর ফলে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত্য এক লক্ষ মানুষ নিহত হয় যার আশি ভাগই ছিল বসনিয়ান মুসলমান। সার্বিয়ানরা শুধু হত্যা করেই খান্ত হয়নি, তাদের দ্বারা ধর্ষিত হয় অসংখ্য নারী এবং শিশু।   দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে নাজি বাহিনী কর্তৃক ইহুদি  নিধনের পর এই সার্বিয়ান হত্যাযজ্ঞ ছিল সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধ।

রুয়ান্ডা গণহত্যা (১৯৯৪) কোনো রাজনৈতিক কারণে হয়নি,  উপজাতীয় বিভেদের ফলে সংগঠিত হয় এই জঘন্য গণহত্যা। এই গণহত্যার ফলশ্রুতিতে মৃত্যু বরণ করে পাঁচ লাখ থেকে এক মিলিয়ন মানুষ। সংখ্যালঘু তুসি সম্প্রদায় শতাব্দী ধরে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে আরেকটি উপজাতি সম্প্রদায় হুতু জাতি গোষ্ঠীকে দমিয়ে রেখে দখল করে রেখেছিল দেশটির শাসনভার।   পরে সরাসরি রুয়ান্ডার সেনাবাহিনীর উৎসাহে এবং সরকারের পূর্ণ সমর্থনে হুতু মিলিশিয়া দ্বারা পরিচালিত হয় পাল্টা গণহত্যা।

পৃথিবীর রক্তাক্ত অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে আরও কিছু গণহত্যার উদাহরণ মেলে, যেমন ইউরোপিয়ান সেটলারদের দ্বারা আমেরিকা মহাদেশ এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসিদের হত্যা; ভারতে ব্রিটিশ গণহত্যার উদাহরণও রয়েছে। আর এখন চোখের সামনে ঘটছে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-লেখক-গবেষক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।