ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ বৈশাখ ১৪৩২, ০৬ মে ২০২৫, ০৮ জিলকদ ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

প্যারিসের সেন নদী: শতাব্দী পর জনসাধারণের জন্য সাঁতারের সুযোগ

মুমিন আনসারি, প্যারিস থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৪৬, মে ৫, ২০২৫
প্যারিসের সেন নদী: শতাব্দী পর জনসাধারণের জন্য সাঁতারের সুযোগ ছবি সংগৃহীত

প্যারিসের নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে আইফেল টাওয়ার, লুভর মিউজিয়াম, নটর ডেম ক্যাথেড্রাল— আর ঠিক তাদের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা এক রাজকীয় নদী, সেন। বয়ে চলেছে শতাব্দী ধরে মহাকালের উপন্যাসের মতো।

প্যারিসের সৌন্দর্যের প্রশংসায় কোনো লেখক কখনো কার্পণ্য করেননি। ভালোবাসার শহর, আলোর শহর, সংস্কৃতির শহর কিংবা স্বপ্নের শহর যা-ই বলা হোক না কেন, এই সৌন্দর্যের একাংশ কৃতিত্বের দাবিদার এই সেন নদী।

শান্ত এই নদীর উৎস ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কোত দ’ওর (Côte-d’Or) এলাকার লাঙগ্রেস নামক স্থানে। সেখান থেকে এটি পশ্চিমমুখী হয়ে প্যারিস শহর পেরিয়ে নর্মান্ডির রুয়াঁ নগরী অতিক্রম করে ইংলিশ চ্যানেলে মিশেছে। নদীটির মূল উৎস স্যাঁ-জার্মেইন-সুর-সেন নামক একটি ছোট্ট গ্রামে। পথে এটি বহু ছোট নদী ও খাল দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে। যার ফলে নদীটি পরিবহন, কৃষি ও বাণিজ্যের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই নদী শুধু প্যারিস নয়, গোটা ফ্রান্সের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই নদী যেন প্যারিসের হৃদস্পন্দন— যেখানে স্রোতের সঙ্গে মিশে আছে প্রেম, বিপ্লব, শিল্প আর জীবন।

কিন্তু শিল্পায়ন ও নগরায়নের চাপে নদীর পানি ধীরে ধীরে হয়ে পড়ে দূষিত ও ব্যবহার অযোগ্য। নদীর পানি ব্যবহারে ফসলের মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর জনজীবনে নেমে আসে বিভিন্ন পানি বাহিত রোগের করাল গ্রাস। যার ফলে ১৯২৩ সালে জনসাধারণের জন্য এই নদীতে সাঁতার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

এরপর কেটে গেছে গোটা একটা শতাব্দী। সেনের কোলে গা না ভিজিয়েই প্যারিসের একটা গোটা প্রজন্ম বিদায় নিলো। এই নদীর নীলজলে সাঁতার কাটতে না পারার বেদনাটাও  ভুলতে বসেছিলো প্যারিসবাসী। এক শতাব্দী পর জনসাধারণের জন্য সাঁতারের অনুমতি মিলছে এবার। এই বছরের গ্রীষ্মে, প্যারিসবাসী এবং পর্যটকরা সেন নদীতে সাঁতার কাটতে পারবেন, ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ে শামিল হতে পারবেন। তবে নদীর পানিকে দূষণমুক্ত রাখতে ও জলজ প্রাণীর জীবনাচরণে ব্যাঘাত না ঘটানোর লক্ষ্যে তিনটি নির্ধারিত স্থানে সাঁতার কাটতে পারবেন পর্যটকেরা।

প্যারিসের তিনটি এলাকাকে জনসাধারণের সাঁতারের জন্য উন্মুক্ত করা হচ্ছে:

৪র্থ অ্যারোন্ডিসমেন্টের- ব্রাস মেরি
১৫তম অ্যারোন্ডিসমেন্টে- ব্রাস দ্য গ্রেনেল,
এবং ১২তম অ্যারোন্ডিসমেন্টের- বার্সি পার্কের নিচে।

নদীটির পানি-মান উন্নয়নে কয়েক বছরের কঠোর প্রচেষ্টার ফলেই এ সাফল্য এসেছে। প্যারিস শহর কর্তৃপক্ষ, ফরাসি সরকার ও স্থানীয় সংস্থাগুলোর যৌথ পরিবেশগত পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় নদীর পানি পরিশোধনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সেই সঙ্গে উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পোশাক পরিবর্তনের কক্ষ ও ঝরনার মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে সাঁতারুদের জন্য।

নদীর পানি বিশুদ্ধ হওয়ার প্রমাণ মিলেছে গবেষণায়ও। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় নদীর পানিতে বিরল প্রজাতির মসলের ডিএনএ শনাক্ত করা হয়েছে, যা নদীর ইকোসিস্টেমে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচক। এ মসল প্রজাতি পানির প্রাকৃতিক পরিশোধন প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে, যা পানি মান বজায় রাখতে সহায়ক।

প্যারিস নগর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই প্রকল্প কেবল বিনোদন নয়, বরং পরিবেশ রক্ষার এক রোল মডেল হিসেবেও বিবেচিত হবে। নগরজুড়ে ‘সবুজ’ উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের অংশ হিসেবে সেন নদীর পুনরুদ্ধার ভবিষ্যতের পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে উঠছে।

বিশ্বজুড়ে যখন নগর-নদীগুলো দখল, দূষণ ও অবহেলায় অস্তিত্ব সংকটে, তখন প্যারিসের সেন নদী দেখাচ্ছে এক ব্যতিক্রমী পথ। এই নদীর বুকে সাঁতার কাটতে নামা মানুষগুলো যেন বহন করছে এক নতুন বার্তা—শহরের মাঝেও প্রকৃতি ফিরে আসতে পারে, যদি থাকে সদিচ্ছা, পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের সক্ষমতা।

এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।