ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

প্রবাসে বাংলাদেশ

বাল্যবিবাহ, এর আইন ও আমাদের দায়বদ্ধতা

শাহনাজ সুলতানা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৪ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১১
বাল্যবিবাহ, এর আইন ও আমাদের দায়বদ্ধতা

মাদারীপুর উপজেলার খালিয়ার পূর্ব স্বরমঙ্গল গ্রামের আব্বাস আলীর কন্যা চাঁদনী আক্তার সামিরার বয়স (১২) বছর। গত কিছুদিন পূর্বে পারিবারিকভাবে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল গোবিন্দপুর গ্রামের বিদেশ ফেরত অহিদুলের (২৭) সাথে।

কিন্তু এ বিয়েতে সামিরা আপত্তি জানালেও অভিবাবকরা তার মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে জোরপূর্বক বিয়ের আয়োজন করেন। কিশোরী সামিরা তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি, জোরপূর্বক আয়োজিত এ বিয়েকে ঠেকানোর জন্য কোন উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সহপাঠিদের সহযোগিতায় সে স্থানীয় সাংবাদিকদের ঘটনাটি জানায়। পরে এসআই কামালের নেতৃত্বে পুলিশ সামিরার বিয়ে ভেঙে দেয় এবং ওই সময় সামিরার বাবা ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত মেয়ে সামিরাকে কোথাও বিয়ে দিবে না বলে পুলিশের নিকট অঙ্গীকার করেন।

গণমাধ্যেমে খবরটি প্রকাশিত হবার পর মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম সামিরাকে, মাত্র বার বছর বয়সে সে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার লক্ষ্যে সাহস সঞ্চার করে যেভাবে অভিভাবকদের অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে কঠোরভাবে মোকাবেলা করেছে, সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের সমাজে প্রতিটি নারীর উচিত শুধুমাত্র বাল্যবিবাহ নয়, যৌন হয়রানি, পারিবারিক সহিংসতা, এসিড নিপে, যৌতুকসহ যতো ধরনের ঘৃণ্যতম এবং মানবতা বিরোধী কর্মকা- রয়েছে তার বিরুদ্ধে এগিয়ে আসা। বর্তমান বিশ্বে নারীরা পিছিয়ে নেই, পুরুষের সাথে সমানভাবে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন বিভিন্ন পেশায় এবং অবদান রাখছেন নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, এমন এক ধূসর সময় ছিল পৃথিবীতে, যখন নারীকে শুধু ভোগের বস্তুই মনে করা হতো। পরিবার বা সমাজ তাদের চাওয়া পাওয়ার কোন মূল্য দিত না। অনেকের ধারণা ছিল, নারী মানেই যৌনুধা মেটানোর আশ্রম আর সন্তান উৎপাদনের মেশিন। বিশেষ করে, আমাদের পুরুষ শাষিত সমাজে নারীরা ছিল বরাবরই অবহেলিত। এমনও সময় পেরিয়ে এসেছি, সে সময়টাতে অধিকাংশ পরিবারে কন্যা সন্তান জন্মালে সদ্য প্রসূতি মায়ের ওপর নেমে আসতো পারিবারিক, সামাজিক এবং বিভিন্ন মানসিক নির্যাতন। যেটা শুধুমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না।

অনেক চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে আদি বর্বরতার যুগ পেরিয়ে বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ নারী এখন অন্য কারো ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সুশিক্ষায় শিতি হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে এবং অনেকেই নিজ নিজ কর্মেক্ষেত্র যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করে সফল নারী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। বিশ্বের অধিকাংশ নারী যখন সোনালি স্বপ্ন চোখে নিয়ে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন আগামীর পথে, ঠিক তখনই গণমাধ্যমের কিছু কিছু খবরাখবর সত্যিই ভাবনায় ফেলে দেয়।

প্রশ্ন জাগে আমরা কি আসলেই আদি যুগের ধ্যান ধারণা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পেরেছি? এখনো কেন জানি মনে হয়, সমাজের অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সনাতন ধ্যান ধারণা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। তাদের অনেকেরই ধারণা, মেয়েদের লেখাপড়া করে লাভ নেই। তাদের তো ঘরেই থাকতে হবে। যে পুরুষ দু’বেলা দু’মুঠো ভাত এবং বছরে এক জোড়া কাপড় দিতে পারবে, সে পুরুষই তাদের মেয়ের জন্য উপযুক্ত । যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা নিজ মেয়েকে উক্ত পুরুষের সাথে বিয়ে দিতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাচঁবেন। কিন্তু যে পুরুষটির সাথে তাদের মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন, সে পুরুষটা যদি মেয়ের বয়সের চেয়ে দ্বিগুণ বয়স এবং অ-শিতি হয় সেটাকে তারা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দেখেন না। তারা ভাবেন, বিয়ের জন্য শুধু একটি পুরুষ খুবই প্রয়োজন, তার শিা, বয়স এবং আচার আচরণ, অতীত কোন কিছু নিয়েই তারা মোটেই তোয়াক্কা করেন না ।

এমনও দেখেছি বিয়ের বয়স হয়নি, লেখাপড়া বন্ধ করে দাদার বয়সী লোকের কাছে পনের, ষোল বছরের মেয়েদের বিয়ে দিতে। কিন্তু বিয়ে দেবার সময় একটি বারও অভিভাবাকরা ভাবেন না যে,  মেয়ের নিজস্ব কোনো মতামত থাকতে পারে, বা বয়সের দ্বিগুণ পুরুষের সাথে অল্প বয়সী একটি মেয়ে কি ভাবে বাকীটা জীবন কাটাবে? তা ছাড়া অনেকাংশে দেখা যায় অল্প বয়সে বিয়ের পর ঘন ঘন বাচ্চা প্রসবের দরুণ অনেক মেয়েরা পুষ্টিহীনতায় ভুগেন এবং যথাসময়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে অনেক নারী মারা যান।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ এক জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাল্যবিবাহ বন্ধের দাবীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলন হয়েছে এবং তা বন্ধের লক্ষ্যে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের আওতায় বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এ সমস্যা প্রতিরোধে যথাযত আইন থাকলে ও বাস্তবে এ আইনের কতোটুকু ব্যবহার হচ্ছে? দ্য মেজরিটি অ্যাক্ট অনুসারে ১৮ বছরের নিচে কোনো ব্যক্তি ভোটাধিকার প্রাপ্ত হন না এবং তারা কোনো দেওয়ানি চুক্তিও করতে পারবেন না। মুসলিম বিয়ে যেহেতু একটি দেওয়ানি চুক্তি, কাজেই একজন নাবালক বা নাবালিকা তারা নিজে কেনো চুক্তি করতে পারবেন না। তা ছাড়াও ১৯৭৪ সালের শিশু আইনটি সংশোধন করে ১৯৮৪ সালের সংশোধন অনুসারে বিয়েতে বর ও কনের বয়স পরিবর্তন করে বরের ক্ষেত্রে ২১ এবং কনের ক্ষেত্রে ১৮-এর নিচে বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারী শিশু আইন ও অন্যান্য আইনে ১৬ থেকে ১৮ বছর, এমন কি ২১ বছর বয়সী ব্যক্তিকে শিশু হিসাবে গণ্য করা না হলেও ১৯৮৪ সালের সংশোধনে ২১ বছরের কম বয়সী পুরুষ এবং ১৮ বছরের কম বয়সী নারীকে বৈবাহিক ব্যাপারে শিশু ও নাবালক বা নাবালিকা হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।

ফলে যারা নিজের ইচ্ছায় অনুপযুক্ত বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন অথবা যাদের অভিবাবক কর্তৃক অনুপযুক্ত বয়সে বিবাহ সম্পন্ন হবে, তাদের উক্ত আইনের ৪, ৫, ও ৬ ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং তারা সর্বোচ্চ এক মাসের জেল অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

আমরা যারা বিলেতে বসবাস করি সবাই জানি, বিলেতে কোন ছেলে বা মেয়েকে ১৮ বছরের নীচে বিয়ে দেওয়া যায় না এবং জোরপূর্বক কোনো ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইলে অভিভাবকদের কঠোর আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। আর এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রায় সব অভিভাবাকই তাদের সন্তানকে ১৮ বছরের পূর্বে বিয়ে দিতে বিরত থাকেন। এ ছাড়াও  আগের তুলনায় বিলেতে অধিকাংশ অভিবাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন খুবই সচেতন, সন্তানদের লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য যা যা প্রয়োজন নিজ সাধ্য অনুযায়ী তারা সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্র একটু অন্য রকম।

দেখা যায়, অনেক পরিবারের মেয়েদের বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স হবার পূর্বেই অভিবাকরা চিন্তায় পড়ে যান। তবে এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে দরিদ্রতা, পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ও লিঙ্গবৈষম্যসহ নানা ধরনেন চাপ। কিন্তু তাই বলে, নিজ সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা না করে, তাদের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে অভিভবাকরা যখন মানবতা বিরোধী নির্মম সিদ্ধান্ত নেন, তখন খুবই খারাপ লাগে। আমাদের সমাজে প্রতিটি অভিভাবকদেরই উচিত এ সব কুসংস্কার পরিত্যাগ করে নিজ সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে তাদেরকে  সহযোগিতা করা এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া। বাল্য বিবাহ বন্ধের লক্ষ্যে সমাজে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও সাহসী হতে হবে এবং জাতীয় এই সমস্যার বিরুদ্ধে সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী কবি ও সংবাদকর্মী।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১১ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad
welcome-ad