ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

মালয়েশিয়াকে ভালোলাগে কেন?

গৌতম রায় | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১১
মালয়েশিয়াকে ভালোলাগে কেন?

বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নানামুখী অন্যায়, অবিচার, প্রতারণা এবং এসব বিষয়ে সুবিচার না পাওয়ায় বহুবার বিতৃষ্ণা জন্মেছে মনে। একদিন লন্ডনে পাস করা এক মালয় বন্ধুকে বলেছিলাম: তোমরা সব জায়গায় হালাল বা হারাম খাবারের পার্থক্য চিহ্নিত করছো।

কিন্তু বাংলাদেশীদের এই কষ্টের উপার্জন থেকে যেটা অন্যায়ভাবে খাচ্ছ সেটা হালাল না হারাম? প্রত্যুত্তরে সে এজন্য এদেশের অন্য এক জাতিকে দায়ী করেছে। কিন্তু তারপরও ভালো লাগে এই মালয়েশিয়া। কিন্তু কেন? শুধুই কি সৌন্দর্য্য বা অর্থোপার্জনের জন্যে। না।

জমিদার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে চন্দন পালঙ্ক, সানবাঁধা ঘাট, বড় বাড়িঘর দেখে ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু সে ভাললাগায় নিজের কোনো লাভ থাকে না। কিন্তু মালয়েশিয়াকে ভাল লাগার অনেক কারণ আছে। আমার দেশের বিভিন্ন অব্যবস্থা দেখে মনটা যখন হতাশায় ভরে যায় তখন মালয়েশিয়ায় তাকালে মন অন্যরকম হয়ে যায়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান যে কোনো দেশে সে দেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশে এই তিনটি বিষয়ে আজও সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। বরং এ নিয়ে বাণিজ্য বসতি গড়ে তুলেছে এক শ্রেণীর মানুষ। সেদিক থেকে এই তিন মৌলিক বিষয়ে অনেক উপরে মালয়েশিয়ার অবস্থান।

প্রথমেই বলি স্বাস্থ্য কথা। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে বেড নেই। আবার টাকা দিলে তা পাওয়া যায়। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, একেকটি বেডে দু’জন করে শিশু রুগী। আবার মেঝেতেও বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে হয়। সংবাদটা পড়ে মনটা আরো খারাপ লাগলো। দুধের শিশুরাও চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ এ মালয়েশিয়ায় কি দেখছি? আমার ছোট মেয়েটি (মালয়েশিয়ান) জন্মের পর কিছুটা শ্বাস কষ্টের কারণে ২ দিন বেশী হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ৩ জন ডাক্তার এক কেবিনে একটানা ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিয়েছেন তাকে। সারাক্ষণ কম্পিউটারে চোখ রেখে দেখেছেন কোনো সমস্যা আছে কিনা। অ্যাম্বুলেন্স কল করলে উম্মাদের মতো ওরা ছুটে আসে রোগী বাঁচাতে। তাও বিনে পয়সায়।

মনে আছে, আমার বুক ব্যথা হয়েছিল বলে স্ত্রীর ফোন পেয়ে কয়েক মিনিটে অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির। বললাম ব্যথা সেরে গেছে। না, শুনবে না। কল করার পর রোগী মারা গেলে ওদের চাকরি যাবে, সাজাও হবে, সাথে হাসপাতালের বদনামও। তাই আমাকে ওরা ছাড়বে না। পাঁজকোলা করে নিয়ে গেল হাসপাতালে। সব পরখ করে তারপর মুক্তি। অথচ কি কা-! একটাকাও লাগলো না। এটা সাধারণ হাসপাতালের কথা বলছি। আবার এক রিঙ্গিতের টিকেটে (সব বাংলাদেশীদের জন্য নয়) আমাকে কত শত রিঙ্গিতের ওষুধ যে দিচ্ছে সরকার তার হিসাব নেই। মানে বিনা চিকিৎসায় ওরা কাউকে মরতেই দিবে না।

আর আমার দেশের ডাক্তাররা কি করছেন? বাম পায়ে ব্যাথা হলে ডান পা কাটেন। অপারেশনের পর গজ ব্লেড ভেতরে রেখেই আবার ব্যান্ডেজ করে দেন এমন খবরও শুনেছি। গর্ভবতী এবং নবজাতককে এদেশে যে চিকিৎসা  দেওয়া হয় সেটা বাংলাদেশে কল্পনারও বাইরে। আমাদের দেশে যেটা হয় তা একেবারেই উল্টো: হাসপাতাল নয়, রোগীকে দামী কিনিকে পাঠায় সরকারি ডাক্তার। সামান্য জ্বর নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে বিপদ আরো বাড়ে। জ্বর হয়েছে তাই রক্ত, পায়খানা, প্রস্রাব এমনকি প্রয়োজনে সিটি স্ক্যান পর্যন্ত করিয়ে ছাড়ে ডাক্তার। অর্থাৎ রুগীর পকেট সাবাড় করতে হবে। আর ডাক্তারের পরামর্শ না শুনে নিজে পণ্ডিতি করলে কি না জানি বিপদ হয় সে ভয়ে জমিজমা বিক্রি করেও ডাক্তারকে টাকা দিতে হবে।

ইদানিং ঢাকায় কিছু নামীদামী প্রাইভেট হাসপাতাল হয়েছে যেখানে অগ্রিম টাকা নিয়ে তারপর ভর্তি। এর আগে এতে রোগী মরে গেলে মরে যাক। টাকাওয়ালাদের যেন টাকাটা মার না যায়। অথচ মালয়েশিয়ায় চিকিৎসার নামে এই অবিবেচক বাণিজ্য ব্যবস্থা নেই। কেউ সেটা কল্পনাও করে না। হাসপাতালেই আসল চিকিৎসা হচ্ছে। কিনিক রয়েছে এখানে সৌখিন রোগীদের জন্য। আমাদের দেশে হাসপাতালের চিকিৎসা হয় কিনিকে। আর এখানে কিনিকের চেয়ে ভালো চিকিৎসা হয় হাসপাতালে। কারণ যে যন্ত্রপাতি হাসপাতালে রয়েছে তা কিনিকে নেই।

কোন ধনী দেশ আমাদের দয়াবশত হাসপাতালে ভালো যন্ত্রপাতি দান করলেও সেগুলোর মালিক হয়ে যায় ‘মুজিব-জিয়ার’  সৈনিকেরাই। এদেশে কেউ কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবে না হাসপাতালের ওষুধ চুরি করে বাইরে বিক্রি করবে। যেটা বাংলাদেশে কোনো ব্যাপারই নয়।
        
এবার শিক্ষা প্রসঙ্গ। বাংলাদেশে এটা এখন শিক্ষা ব্যবস্থা নয়। শিক্ষা বাণিজ্য হয়ে গেছে। কোমলমতি শিশুকে ভালো স্কুলে ভর্তি করতে হলে তার বাবাকে ওই স্কুলে এক গাদা টাকা চাদা  দিতে হবে। তবেই ভর্তি হতে পারে ওই শিশু। গরিব মানুষের ছেলেরা যায় সরকারি স্কুলে। আবার সেখানেও বিনামূল্যের বই শিশুদের কাছে ঠিকমত পৌঁছায় না। কারণ ওখানেও যে থাকে ‘মুজিব-জিয়ার’ লেবাসধারী সৈনিকেরা। এরপর দুর্নীতির পরশে পরশে বড় হয়ে যখন এই শিশুরা ভালো কলেজে ভর্তি হতে যায় তখন ‘লীগ, দল বা পার্টি’র আশীর্বাদ লাগে। নাহলে ভর্তি বাণিজ্যে ঢুকতে হবে। যে শিশুটি স্কুল জীবন থেকে পদে পদে দুর্নীতির ছোঁয়ায় বড় হচ্ছে এক সময় সে শিশুটিও দুর্নীতি করে সরকারি চাকরি পেয়ে হয়তো ভালো দুর্নীতিবাজ অফিসার হয়ে যায়।

এই মালয়েশিয়ায় শিশুদের জন্য যে শিক্ষাসুযোগ রয়েছে তা দেখে মাঝে মাঝে আমার হিংসাও হয়। যখন দেখি আমার ছেলেমেয়েরা সারা বছর স্কুলে কোনো টাকাপয়সা ছাড়াই ভালোভাবে পড়াশুনা করছে তখন ভাবি: জন্মটা কেন আমার এদেশে হলো না। তাহলে তো মা বাবার এত টাকার শ্রাদ্ধ হতো না। পরীক্ষার ফি দিতে মায়ের গলার গয়না বিক্রি করতে হতো না।

আমরা গলা ফাটিয়ে কাসে পড়েছি। দু একে দুই, দুই দ্বিগুণে চার। আর শিক্ষক মহোদয় বেত হাতে নিয়ে টেবিলে ঘুমিয়েছেন। এদেশে শিশুরা কি সুন্দর সুযোগ পাচ্ছে কম্পিউটারে, শিক্ষকদের আচার আচরণে। কই এখানে তো দুর্নীতির কোনো ছোঁয়া নেই। বাংলাদেশের মতো এখানে তো ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার চালু হয়নি। বরঞ্চ শিশুরা যাতে কোনো সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় সেটার তদারকি করে এদেশের সরকার।

বাসস্থান সম্পর্কে বলতে গেলে এক কাব্য রচনা করা যাবে। মালয়েশিয়ার বাসস্থান ব্যবস্থা দেখলে আসলেই স্বর্গরাজ্য মনে হয় এদেশকে। প্রবাসীরা অবশ্যই দেখছেন কত শত শত আকাশ ছোঁয়া ভবন হচ্ছে মালয়েশিয়ায়। ওই সব ভবনেই আবার সব আমোদপ্রমোদ শিশুদের খেলার ব্যবস্থাসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশে যা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে মালয়েশিয়ায় তা হতদরিদ্রেরও নাগালের মধ্যে। এতো বহুতল ভবন হচ্ছে মাত্র ৩ কোটি মানুষের জন্য? না, ভুল ধারণা। সবই হচ্ছে ভবিষ্যত প্রজম্মকে একটি সুন্দর নিশ্চিত রাষ্ট্র উপহার দেবার জন্য।

আজকের এই ৩ কোটি লোকসংখ্যা ২০ বছর পর অনেক হবে। সেদিনের চিন্তা করেই মালয়েশিয়ায় এতো বাড়ি পথঘাট হচ্ছে। এদেশের যে কেউ যখন খুশী তখন সে একটি বাড়ির মালিক হতে পারে। বাংলাদেশে যখন একটি বাড়ি বা একটি ফাটের মালিক হওয়া মধ্যবিত্তের কাছে শুধুই স্বপ্ন সেখানে এদেশে তখন সেটা শুধুই সহজ সুযোগ এবং স্বপ্ন হাতের মুঠোয়। ব্যাংক টাকা নিয়ে বসে আছে। নিয়মিত উপার্জন করছে এমন প্রমাণ দেখাতে পারলেই একটি বাড়ির মালিক। ইচ্ছে করলে একটি গাড়িরও মালিক। আর কি চাই। আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার সেটাও ব্যাংক দিচ্ছে, উচ্চশিক্ষার জন্য টাকা দরকার সেটাও ব্যাংক দিচ্ছে। কেন এদেশের মানুষ আন্দোলন হরতাল করবে? আর বাংলাদেশে বাড়িওয়ালা যেভাবে ইচ্ছা বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছে, যেভাবে খুশি জমির দাম বাড়াচ্ছে।

ব্যাংক থেকে টাকা লোন নিতে ঘুষ লাগে। দালাল আর দুর্নীতি সব জায়গাতে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে আছে। এক আজব দেশ। দেখার কেউ নেই। যে দেখবে সেও তো খায়। ক্ষেত রক্ষার জন্য যে বেড়া দেওয়া হয় সে বেড়াই ক্ষেত খায়। আমার দেশে একজন শিশু ভূমিষ্ট হবার পরই প্রথা হিসাবে দুর্নীতির ছোঁয়া পায় এবং কবরে যাওয়া পর্যন্ত দুর্নীতিই তাকে তাড়া করছে।

মালয়েশিয়াকে ভালো লাগার আরো অনেক কারণ আছে। বাংলাদেশের কালো ধোঁয়া, শব্দ দূষণ, মানুষে মানুষে বিবাদ বিভেদ দলাদলি, রাজনীতি, হরতাল, ভেজাল খাবার, পদে পদে দুর্নীতি, অভাব, অতিরিক্ত লোভ লালসা এখানে নেই। আছে বিশুদ্ধ বায়ু, প্রাকৃতিক বিপর্যয়মুক্ত আবহাওয়া, পথ এগিয়ে যাবার সুবিধা, অনাকাক্সিক্ষত অস্বাভাবিক মৃত্যুহ্রাস যা প্রতিটি বাংলাদেশীর জন্য আজ অপরিহার্য্য।

তবে মালয়েশিয়ায় কিছু একটা করতেই হবে। বেকার থাকা যাবে না। এদেশের মানুষদের মধ্যে শুধু অলস আর নেশাগ্রস্থ লোকরাই গরিব থাকে। মালয়েশিয়া সরকার নাগরিকদের ভালোবাসে। আর আমাদের সরকার জনগণকে বোঝা ভাবে এবং গিনিপিগের মতো বিদেশে রপ্তানি করে।

পাঠক, জানি না আমার এ লেখায় আপনি একমত হবেন কি না। আমার বাংলাদেশকে আমি ছোট করে দেখছি না। ২০ বছর মালয়েশিয়ায় অবস্থানের কারণে যে অসামঞ্জস্য চোখে পড়েছে সেটাই শুধু তুলে ধরলাম। কিন্তু আমরা কেন মালয়েশিয়া থেকে পিছিয়ে আছি? কি নেই আমাদের। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরাও যে মালয়েশিয়ার চেয়ে এগিয়ে আছি। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সংগ্রাম সবকিছুই মালয়েশিয়ার চেয়েও বেশী অর্জন। তারপরও পিছিয়ে আছি শুধু অর্থনৈতিক দৌড়ে।

গৌতম রায়: সম্পাদক, সাপ্তাহিক প্রবাসীকন্ঠ, মালয়েশিয়া।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।