ত্রিপোলি থেকে সমুদ্রপথে ইতালিতে যাওয়ার সময় গত ২৬ আগস্ট বুধবার দিবাগত রাতে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান কমপক্ষে ২৪ বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে ছিলেন সিরতের একটি পরিবারের তিন সদস্য মোঃ রমজান আলী, তার স্ত্রী সাহেরা খাতুন আর ৭ বছরের শিশু ইউসুফ।
খাদিজার সাথে কথা বলে সেদিনের সেই ভয়াবহতা কিছুটা আঁচ করা গেল। খাদিজা জানায়, যাত্রা শুরু করার ঘণ্টাখানেক পরেই তারা শুনতে পায় বোটের তলা ফেটে গেছে। অল্পসময়ের মধ্যেই দেখলো বোটে খুব দ্রুত পানি উঠছে আর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই বোটটি ডুবে যাওয়ার উপক্রম। খাদিজাদের পরিবারের সবারই লাইফ জ্যাকেট ছিল। কিন্তু তাড়াহুড়া এবং প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কির মধ্যে সবাই লাইফ জ্যাকেট ঠিকমতো পরার আগেই কেউ কেউ পানিতে পড়ে যায় এবং বাকিরা লাফ দিয়ে পানিতে নেমে যেতে বাধ্য হয়।
খাদিজার নিজের লাইফ জ্যাকেটটা ঠিকমতো পরা ছিল, তাই তার তেমন কোন অসুবিধা হয় নি, কিন্তু তার মায়ের লাইফ জ্যাকেটটা পেছন থেকে অন্য যাত্রীরা টানা হেঁচড়া করছিলো। এতে সেটি ছিঁড়ে যায়।
ছেঁড়া লাইফ জ্যাকেট নিয়ে সাহেরা খাতুন যখন হাবুডুবু খেতে থাকেন, তখন তার বড় ছেলে ইয়াসিন এসে ছোট ছেলে ইউসুফের লাইফ জ্যাকেট খুলে তাকে তার বাবা রমজান আলীর হাতে ধরিয়ে দেয় এবং তার লাইফ জ্যাকেটটা তাদের মাকে পরিয়ে দিতে চেষ্টা করতে থাকে। ঠিক মতো পরানোর আগেই অন্য যাত্রীদের ধাক্কাধাক্কিতে এবং প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে তারা পরস্পর থেকে দূরে সরে যায়। এর মধ্যে হঠাৎ ডুবন্তপ্রায় এক আরবীয় ব্যক্তি নিজে ভেসে ওঠার জন্য খাদিজার মাকে টেনে ধরে এবং তাকে দুই হাত দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে তার উপর ভর দিয়ে নিজে ভেসে থাকার চেষ্টা করে।
কান্নাভেজা কণ্ঠে খাদিজা জানায়, পানিতে নামার পর সে তার মাকে একবারও দেখেনি। এসব বর্ণনা সে শুনেছে তীরে ওঠার পর তার মেজভাই শাহনেওয়াজের কাছ থেকে। শাহনেওয়াজ তার মায়ের ডুবে মরার মর্মান্তিক দৃশ্যের পুরোটাই একটু দূর থেকে ভাসতে ভাসতে দেখেছে; কিন্তু ঢেউ, ভিড়, এবং সাঁতার কাটার অনভিজ্ঞতার কারণে কিছুই করার সামর্থ্য ছিল না তার। সেই আরবীয় ব্যক্তি পরপর দুইবার সাহেরা খাতুনকে এভাবে পানির নিচে চেপে ধরার পরপরই সাহেরা খাতুন তলিয়ে যান।
মায়ের মৃত্যুটা নিজের চোখে না দেখলেও ভাইয়ের মুখে শোনা ঘটনাটার বর্ণনা দিতে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো ১১ বছর বয়সী ছোট্ট শিশু খাদিজা। তার একটাই আফসোস, পানিতে পড়ার পরে সে শেষবারের মতো তার মায়ের চেহারাটাও দেখতে পায়নি।
খাদিজা জানায়, পানিতে নামার কিছুক্ষণ পরেই সে তার বাবাকে খুঁজে পায়। তার বাবা এক হাতে ইউসুফকে ধরে ভাসছিলেন। খাদিজা একটু দূরেই ছিল। কিন্তু প্রায় আধঘন্টা পরে সে হঠাত বুঝতে পারে তার বাবা আর বেঁচে নেই। কারণ সে দেখে তার বাবার মুখটা উপুড় হয়ে পানিতে ডুবে আছে এবং পা উপরের দিকে ভাসছে, আর সাত বছর বয়সী ইউসুফ তার বাবার উপর ভর দিয়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পর খাদিজা দেখতে পায় ইউসুফের মুখ দিয়ে সাদা সাদা ফেনা বের হচ্ছে। সে চিত্কার করে ইউসুফকে ডাকতে থাকে কিন্তু ইউসুফের মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না। ইয়াসিন দূর থেকে খাদিজার চিত্কার শোনে এবং খাদিজার নাম ধরে ডাকতে থাকে তার অবস্থান বোঝার জন্য। ততক্ষণে ইউসুফের মৃতদেহ তার বাবার মৃতদেহের থেকে আলাদা হয়ে সমুদ্রে তলিয়ে যায়। খাদিজা ভাসতে ভাসতে তার বাবার মৃতদেহের কাছাকাছি আসে এবং বাবার মৃতদেহ ধরেই সে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে।
ট্রলারটা ডুবতে শুরু করেছিল রাত দুটোর সময়। খাদিজার বর্ণনা অনুযায়ী তার বাবা মারা যান আড়াইটার দিকে। সেই রাত আড়াইটা থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত উদ্ধারকর্মীরা আসার আগ পর্যন্ত খাদিজা তার বাবার লাশ ধরে এই বিশাল সমুদ্রে অপেক্ষা করতে থাকে কখন তাদেরকে উদ্ধার করা হবে এই অপেক্ষায়। সকালের দিকে তার এবং তার কাছাকাছি থাকা তার মেঝোভাই শাহনেওয়াজের শরীর অবশ হয়ে আসছিল। একটু পরপরই তাদের চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু তাদের কাছাকাছি থাকা এক ফিলিস্তিনি (অথবা সিরিয়ান) নারী বারবার তাদের নাম ধরে ডেকে ডেকে তাদেরকে জাগিয়ে দিচ্ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত সকাল দশটার দিকে কয়েকটা স্পিড বোট এসে যাত্রীদের উদ্ধার করতে শুরু করে। খাদিজা তার বাবার লাশ ধরে ধরেই বোটের দিকে এগোচ্ছিল। কিন্তু বোটের কাছাকাছি প্রবল স্রোতের টানে তার বাবার মৃতদেহ তার হাত থেকে ছুটে যায় এবং বোটের নিচের দিকে চলে যায়। উদ্ধারকর্মীরা খাদিজা, তার দুই ভাই এবং আরো কিছু যাত্রীকে বোটে তুলে যখন ফিরে আসছিলেন, তখন একটু দূরে খাদিজা তার মায়ের মৃতদেহ ভাসতে দেখে। সে চিত্কার করে উদ্ধারকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার মায়ের লাশটা উঠানোর জন্য। কিন্তু তারা তার কথায় পাত্তা দেয় না। কারণ তখনও অনেক জীবিত মানুষকে উদ্ধার করা বাকি ছিল।
তীরে আনার পর প্রথমে তাদের সবাইকে এক স্থানে জড়ো করা হয়। সেখান থেকে যারা বেশি অসুস্থ তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাকিদের একটা ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ছেলে এবং মেয়েদের আলাদা করে পৃথক পৃথক ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার খাদিজা আলাদা হয়ে যায় তার ভাইদের কাছ থেকে। অবশ্য ততক্ষণে তার সাথে অন্য একটি বাংলাদেশি পরিবারের উদ্ধার হওয়া দুই মা এবং মেয়ে যোগ দেয়।
ট্রলারটি দুর্ঘটনায় পড়ে ২৬ তারিখ বুধবার রাতে, খাদিজারা উদ্ধার পায় ২৭ তারিখ বৃহস্পতিবার সকালের দিকে। ত্রিপোলিতে সংবাদ ছড়াতে থাকে সেদিন বিকেলের দিকে। পরদিন শুক্রবার দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাদের খোঁজে যান।
দূতাবাসের মূল কার্যালয় ত্রিপোলি থেকে সরিয়ে তিউনিসিয়ায় স্থানান্তর করা হলেও শ্রম বিষয়ক কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম লিবিয়াতেই অবস্থান করছিলেন। তিনি এবং দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তারা শুক্রবার গিয়ে খাদিজাসহ জীবিত উদ্ধার হওয়া নারী এবং শিশুদের নিজেদের হেফাজতে নিয়ে আসেন। তবে তার দুই ভাই এবং জীবিত উদ্ধার হওয়া আরেকটি বাংলাদেশি পরিবার আবুল বাশারের দুই ছেলে আসিফ এবং আরিফ এখনও ত্রিপোলির একটি ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি রয়েছে। তাদের সাথে আছে আরো অন্তত ৩৮ বাংলাদেশি।
দূতাবাসের কর্তকর্তারা গত ২৯ আগস্ট (শনিবার) গিয়ে বন্দিদের সাথে দেখা করে এসেছেন। তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অন্তত পরিবারের সদস্য এই চারজনকে খুব শিগগিরই মুক্ত করা সম্ভব হবে।
প্রাথমিকভাবে খাদিজা উদ্ধার হওয়া অন্য দুটি পরিবারের সঙ্গে থাকলেও পরে তাকে দূতাবাসের কাছাকাছি তার পূর্ব পরিচিত এক শিক্ষিকার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়, যিনি সিরতে খাদিজাদের প্রতিবেশী ছিলেন এবং সিরত বাংলাদেশি স্কুলে খাদিজার শিক্ষিকা ছিলেন। বর্তমানে সে সেখানেই আছে এবং অপেক্ষা করছে কখন তার দুই ভাই মুক্তি পাবে।
# লেখক: প্রকৌশলী মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা
সাবেক শিক্ষক, সিরত বাংলাদেশি স্কুল, সিরত, লিবিয়া
বাংলাদেশ সময় ১১২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৫
এমএমকে/জেএম