ব্রাসিলিয়া, ব্রাজিল থেকে: বাংলানিউজকে পাশে পেয়ে আবেগাপ্লুত ব্রাসিলিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তাদের আক্ষেপ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সুখ-দুঃখ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও ব্রাজিল প্রবাসীদের নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর কোনো আগ্রহ নেই, তারা তাদের খবর রাখেন না।
তবে বাংলানিউজ বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ অনলাইন নিউজপোর্টাল এ খবর রাখেন তারা। বলেন, দেশের জন্য পৃথিবীর অপর প্রান্তে বসে আমাদেরও মন পোড়ে। সংবাদমাধ্যমগুলো আমাদের সঙ্গে দেশের সেতুবন্ধন রচনা করলে কিছুটা হলেও মানসিক শান্তি পেতাম।
২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে কয়েকজন বাংলাদেশি সাংবাদিক ব্রাজিল এলেও শুধু ফুটবলের নিউজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন আক্ষেপ করে তারা বলেন, এখানে আমাদের জীবনযাত্রা নিয়ে প্রতিবেদন করার আগ্রহ ছিলো না তাদের।
বুধবার (১৬ ডিসেম্বর) ব্রাসিলিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত মহান বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া বেশ ক’জন প্রবাসী এমন আবেগপ্রবণ কথা বলেন বাংলানিউজকে।
অনুষ্ঠান শেষে দীর্ঘ আড্ডা হয় তাদের সঙ্গে। এক পর্যায়ে কিছুক্ষণের জন্য আড্ডায় যোগ দেন দূতাবাসের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স নাহিদা রহমান সুমনাও। তিনিও ব্রাজিল প্রবাসীদের কথা দেশের সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরার অনুরোধ জানান।
সুদূর আমাজন রেইনফরেস্ট এলাকা থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন সিলেটের ছেলে আবু সুফিয়ান উজ্জ্বল। তরুণ এই বাংলাদেশি প্রায় তিন বছর বসবাস করছেন ব্রাজিলে। দালালের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ হয়ে ঢুকেছিলেন এদেশে। ব্রাসিলিয়া থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী আমাজন রেইনফরেস্ট সংলগ্ন মানাউস শহরে তার রয়েছে একটি ছোটখাটো রেস্টুরেন্ট। অনর্গল পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলতে পারেন উজ্জ্বল। তার সঙ্গে আর একজন মাত্র বাংলাদেশি আছেন মানাউসে। ব্রাজিলের ইমিগ্রেশন আইন সম্পর্কে বেশ স্বচ্ছ ধারণা রাখেন বলেই মনে হলো তার কথাবার্তায়।
বর্তমানে ব্রাজিলের ন্যূনতম বেতন স্কেল ৯৮০ রিয়েল- এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে দেশ থেকে যখন আসি তখন ব্রাসিলিয়ার এক রিয়েলে (রিয়েস) বাংলাদেশের চল্লিশ টাকা পাওয়া যেতো। এক হাজার রিয়েল বেতন পেলে বাংলাদেশি টাকায় তা হতো চল্লিশ হাজার টাকা। আমাদের আয় বাড়লেও মুদ্রা বিনিময় রেট কমে যাওয়ায় বাংলাদেশি টাকায় আয় এখন অনেক কমে গেছে।
ব্রাজিলিয়ান এক রিয়েলে এখন বাংলাদেশি টাকা পাওয়া যায় মাত্র ২০ টাকা। তিনি বলেন, ব্রাজিলে বাংলাদেশের যারা ব্যবসা করতে চান তাদের জন্যে এটি বিরাট সুযোগ হলেও, আমরা যারা কাজ করে খাই তাদের জন্য বিষয়টি মোটেই সুখকর নয়।
উজ্জ্বল বলেন, ২০ হাজার ব্রাজিলিয়ান রিয়েস হলে (বাংলাদেশি টাকায় ৪ লাখ) এখানে একটি ব্যবসা শুরু করা যায়। এই টাকা দিয়ে বাংলাদেশেও যা সম্ভব নয়। ব্যবসার অনুমতিও মেলে অনেক সহজে।
তিনি জানান, এখানে বাংলাদেশি যারা আছেন তারা প্রায় সবাই কোনো না কোনো কাজ করছেন। ইউরোপের দেশগুলোর মতো ইমিগ্রেশন কড়াকড়িও নেই ব্রাজিলে। অ্যাপ্লাই করলেই প্রথমে ৬ মাস, পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে দশ বছর স্থায়ী বসবাসের সুযোগ মেলে। ২/৩ বছরের মধ্যেই স্থায়ী হওয়ার সুযোগ থাকে।
উজ্জ্বলের মতে, মানবাধিকার নিয়ে বিশ্বের কোনো দেশ যদি সহানুভূতিশীল থাকে, তা হলো ব্রাজিল। ২০১৩ সালে মানবাধিকার সংগঠনগুলো ঘরে ঘরে ভিজিট করে বাংলাদেশিসহ বিদেশিদের খুঁজে খবর নিয়ে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ লাভে সহায়তা করেছে।
টাইলস ফিটার ফারুক উদ্দিন আছেন মহা টেনশনে। দেশে যাবেন, কিন্তু মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট পাচ্ছেন না বলে যেতে পারছেন না। স্থানীয় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকাণ্ডে পুরোপুরি সন্তুষ্ট থাকলেও এমআরপি পাসপোর্ট না পেয়ে বেশ হতাশা ব্যক্ত করলেন। বলেন, মেশিন স্থাপন করা হলেও এটি এখনও অ্যাক্টিভেট হয়নি।
তবে এটি স্থানীয় দূতাবাসের দায় নয়, ঢাকার গাফিলতি- এমনটিও জানালেন তিনি। মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট মেশিনটি যাতে দ্রুত অ্যাক্টিভেট হয়, সে দাবি জানান তিনি।
সুপার মার্কেট ওয়ার্কার কামরুল ইসলাম, মাহমুদুর রহমান, স্মল বিজনেসের মালিক হেলাল আহমেদ ও রুহুল আমিনসহ সবার একই অনুরোধ, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট যেন দ্রুত চালু হয়। আর যদি তা করতে দেরি হয়, তাহলে দেশে যেতে তাদের জন্য যেন বিকল্প পন্থার ব্যবস্থা করে সরকার।
ব্রাসিলিয়ায় দায়িত্ব পালনরত রাষ্ট্রদূত মিজারুল কায়েসের প্রশংসায় অবশ্য পঞ্চমুখ সবাই। তাদের মতে, মিজারুল কায়েসকে তারা তাদের নিজেদের মানুষই মনে করেন। আবু সুফিয়ান বলেন, এর আগে অন্য রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে একটু কথা বলা, একটি ছবি তোলা কল্পনার বাইরে ছিলো। কিন্তু মিজারুল কায়েস দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি কল্পনা নয়, বাস্তব।
আরও বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর খুঁজে খুঁজে আমাদের বের করেছেন। দেখা করতে এলে নিজে বাইরে এসে রিসিভ করেছেন। দূতাবাসে জাতীয় দিবসগুলোতে অনুষ্ঠানের আয়োজন ও এসব আয়োজনে আমাদের আমন্ত্রণ জানানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন, আমাদের সৌভাগ্য যে এমন একজন কমিউনিটিবান্ধব হাইকমিশনার আমরা পেয়েছি।
মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট সম্পর্কে প্রবাসীদের অভিযোগ সম্পর্কে দূতাবাসের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স নাহিদা রহমান সুমনার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান, গত জুলাই মাসে এমআরপি মেশিন স্থাপন করা হলেও এখনও তা অ্যাক্টিভেট করা সম্ভব হয়নি।
যত দ্রুত সম্ভব এটি অ্যাক্টিভেট করার জন্য দফায় দফায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটিসহ অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে রাষ্ট্রদূত মিজারুল কায়েস এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন।
তিনি আরও জানান, যেহেতু ২৪ নভেম্বরের পর হাতে লেখা পাসপোর্ট অকেজো, সেহেতু এমআরপি চালু না হওয়া পর্যন্ত দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতে সংশ্লিষ্টরা চরম বিপাকে পড়েছেন।
২৪ নভেম্বর থেকে ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দিয়েছেন এমনটি জানিয়ে নাহিদা বলেন, আগ্রহীদের আমরা বলেছি প্রয়োজনে পাশ্ববর্তী কোনো দেশ থেকে ভিসা সংগ্রহ করতে। জরুরি প্রয়োজনে পাসপোর্টের পরিবর্তে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ট্রাভেল পারমিটের ব্যবস্থা করা যায় কিনা- এমনটি ভেবে দেখতেও আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৫
এএ/