ঢাকা, সোমবার, ৪ কার্তিক ১৪৩২, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

অন্যান্য

নানা সূচকে ‘ইমেজ ক্রাইসিসে’ বাংলাদেশ  

মোস্তফা কামাল। সৌজনৌ: কালের কণ্ঠ |
আপডেট: ০৯:৪১, অক্টোবর ২০, ২০২৫
নানা সূচকে ‘ইমেজ ক্রাইসিসে’ বাংলাদেশ   মোস্তফা কামাল

তলানিরও তল থাকে। এর পরও তলে তলে নয়, প্রকাশ্যেই বেশ কিছু সূচকে তলানিতে ডুবছে বাংলাদেশ।

কদিন ধরে এতে এক নতুন গতিপ্রবাহ। এর কিছু স্থানিকে, কিছু আন্তর্জাতিকে।  

শিক্ষা, ব্যবসা, বিমান প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, বিমানবন্দেরের নিরাপত্তা, কার্গো ভিলেজে বা ইপিজেডে আগুন, পাসপোর্টের মান অবনতিসহ কিছু সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতি আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়। এ ধারা চলতে থাকলে দেশের ইজ্জত ডুবতে  বিদেশি রাষ্ট্র বা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র লাগে না। কাকতালীয় বা ঘটনার অনিবার্যতায় সেই সন্ধিক্ষণেই বাংলাদেশ।

কার্গো ভিলেজের আগুন হোক নাশকতা বা দুর্ঘটনা, ঘটনা তো অবশ্যই।

যে ঘটনা একটি দেশের ইমেজ নষ্টের জন্য যথেষ্ট। কেবল দেশে নয়, বিশ্ব গণমাধ্যমেও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ এটি। তা বাংলাদেশের একটি কেপিআইভুক্ত (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) এলাকার অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্বকে যে বার্তা দেওয়ার তার পুরোটাই দিয়েছে। এর মাত্র কদিন আগে চট্টগ্রাম ইপিজেডে ঘটল ভয়াবহ আগুনকাণ্ড।

এর মাঝে রাজধানীর মিরপুরে পোশাক কারখানায় আগুনে শ্রমিক পুড়ে মরার খবর তো আছেই। গণ-অভ্যুত্থানের পর একে একে মিল-কারখানা বন্ধের জেরে নতুন করে শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হতে থাকার সময়েই এসব ঘটনা। এগুলোর একটিও সীমিত বা বিক্ষিপ্ত সংবাদ নয়। নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও লুকানো-ছাপানো বা অস্বীকারের মতো ঘটনা নয়। নাশকতা বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খাটানো হলেও তা আড়াল করার জো নেই।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে গুরুত্বের সঙ্গে। এ সময়টাতেই চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন সেবায় অযৌক্তিক ও অতিরিক্ত ট্যারিফ আরোপ এক সপ্তাহের মধ্যে প্রত্যাহার করা না হলে ব্যবসায়ীদের বন্দর অচলের হুঁশিয়ারির খবর। চট্টগ্রাম বন্দরে ট্রেইলার চলাচলে প্রবেশ ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে বন্দর থেকে সব ধরনের পণ্য পরিবহন বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ও ফ্লাটবেড ওনার্স পরিবহন মালিক সমিতি। চট্টগ্রাম বলা হলেও এটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খবর নয়, কেবল জাতীয় সংবাদও নয়। আন্তর্জাতিক সংবাদ।

চট্টগ্রামকে বলা হয় বন্দরনগরী। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। দেশ-বিদেশের ব্যবসায়ী ও আমদানি-রপ্তানির আন্তর্জাতিক সদর দুয়ার এটি। সেখানে চলছে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। বন্দর ব্যবহারকারীদের আপত্তি উপেক্ষা করে গত ১৪ অক্টোবর রাত ১২টার পর থেকে কার্যকর করা হয় চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন বাড়তি মাশুল। বিভিন্ন সেবা পেতে প্রায় ৪১ শতাংশ হারে নতুন মাশুল আরোপ করায় চট্টগ্রামে প্রতিবাদসভা করে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান দিয়েছে পোর্ট ইউজার্স ফোরাম। প্রতিবাদসভায় বন্দর ব্যবহারকারীরা বলেছেন, ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে রপ্তানীকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে কনটেইনার হ্যান্ডলিং, স্টোরেজ এবং পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকবে।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর আন্তর্জাতিকভাবে একটি অনিশ্চিত ও ব্যয়বহুল গন্তব্য হিসেবে চিহ্নিত হবে। তার ওপর চট্টগ্রাম বন্দরে ট্রেইলার চলাচলে প্রবেশ ফি ৫৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩০ টাকা করায় বন্দর হতে সব ধরনের পণ্য পরিবহন বন্ধ রাখার ঘোষণ দেয় চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ও ফ্লাটবেড ওনার্স পরিবহন মালিক সমিতি। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দরসংশ্লিষ্ট যেকোনো নীতিগত পরিবর্তন অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জাতীয় অর্থনীতির ওপর সুদূরপ্রসারি প্রভাব না পড়ে পারে না।

বাংলাদেশের পাসপোর্টের বৈশ্বিক মান অবনতিও বৈশিষ্ট্য বিচারে এ মানেরই খবর। এমনিতেই বাংলাদেশের পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক মান নিয়ে অবনতির ধারা অনেক দিনের কষ্ট ও ইজ্জতের প্রশ্ন। সেখানে কিছুদিন আগে পড়ল আরেকটি ধাক্কা। আশা তো ছিল, গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন উচ্চতায় যাবে বাংলাদেশ। কিন্তু সেখানেও তলানির তবলা। প্রতিবছর বিশ্বের ১৯৯টি দেশের পাসপোর্ট ও ২২৭টি ভ্রমণ গন্তব্য নিয়ে শক্তিশালী পাসপোর্ট সূচক প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স। প্রতিষ্ঠানটির ২০২৫ সালের সর্বশেষ পাসপোর্ট সূচকে বাংলাদেশি পাসপোর্টের মান তলানিতেই পড়ল। বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম স্থানে নেমে গেছে। গত বছর ছিল ৯৭তম অবস্থানে। বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে আছে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা উত্তর কোরিয়াও। মানে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকরাও এখন বিশ্বের ২২৭টি ভ্রমণ গন্তব্যের মধ্যে মাত্র ৩৮টিতে ভিসামুক্ত সুবিধাযোগ্য। গত বছর এ তালিকায় ছিল ৪২টি দেশ। ২০২৩ সালে ১০১তম অবস্থানে।

অর্থাৎ ২০২৪ সালে তল থেকে যেটুকু উঠে আসা, এ বছরে আরো তলে ডোবা। দুই দশক আগে, ২০০৬ সালে হেনলি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৮তম। বাংলাদেশি পাসপোর্টের মান যাচাই করতে এসব বৈশ্বিক সূচক দেখার প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের পদে পদে বিদেশে গিয়ে হয়রানি ও বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। হেনলি পাসপোর্ট সূচকে ২০২৫ সালে বাংলাদেশের চেয়ে এখনো এগিয়ে আছে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মায়ানমার। দেশটির অবস্থান ৯৬তম। একই অবস্থানে আছে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া ও যুদ্ধবিধ্বস্ত লেবানন। আর দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশ ভুটানের অবস্থান আরো এগিয়ে ৯২তম। প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ৮৫তম। বাংলাদেশের সঙ্গে তৈরি পোশাক ব্যবসায় প্রতিযোগী থাইল্যান্ডের পাসপোর্টের অবস্থান ৬৬তম।

বাংলাদেশের অবিরাম তলানিতে পড়ার দেশি-বিদেশি সূচক ভর করছে শনির দশার মতো। সদ্য ঘোষিত এইচএসসির ফলাফলে শিক্ষা খাতে এসেছে চরম বার্তা। কুড়ি বছরের ইতিহাসে এবার এইচএসসিতে সর্বনিম্ন ফলের রেকর্ড দেখতে হয়েছে। ১১টি শিক্ষা বোর্ডে পাসের গড় হার ৫৮.৮৩। ফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ বছর ফেল করেছেন ৪১.১৭ শতাংশ পরীক্ষার্থী। মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ৬৯ হাজার ৯৭ জন। গত বছরের চেয়ে তা ৭৬ হাজার ৮১৪ জন কম। দেশের ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউই পাস করেনি। শতভাগ পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে এক হাজার ৪৩টি।  ভয়াবহ এই ফলবিপর্যয় নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। কারো কারো মতে, এটাই প্রকৃত ফলাফল। অতিরঞ্জিত যে ফলাফল বিগত বছরগুলোতে দেখানো হয়েছিল, এবার তা হয়নি।

কারো কারো মতে, সরকার পরিবর্তনের পর আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পড়ালেখায় মন দেয়নি। শিক্ষার মানের এ তলানি বার্তার পেছনে সিলেবাস, পরীক্ষাপদ্ধতি, প্রশ্নপত্র, নম্বর দেওয়ার ধরন নিয়েও কথা হচ্ছে। এগুলোর বেশির ভাগই কথার কথা। শিক্ষার মান কমছে, শিক্ষার্থীদের এখনো পড়ার টেবিলে নেওয়া যায়নি—এ তথ্য লুকানোর কোনো সুযোগ নেই।

ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানে চরম খরার মাঝে শিক্ষার এ হালের সমান্তরালে শিক্ষকদেরও রাস্তায় লড়াকু হওয়া, মার খাওয়ার ঘটনা। সেই সঙ্গে তাদের ভুখা মিছিল। এগুলোতে দেশের ইমেজের প্রশ্ন। এসবের যোগফলে বাজে বার্তা যাচ্ছে বিহর্বিশ্বে। আরো বিভিন্ন খাতেও অবনমনের এ ধারা বিবেকবানদের উদ্বিগ্ন করছে। লোকালয়ে, বাজারে, মাজারে, মিলকারখানায় লাগানো আগুন বিমানবন্দর চিনে যাওয়া দৃশ্যমান ঘটনা।

আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশাপাশি স্থল ও সমুদ্র বন্দরগুলোতেও ভালো খবর নেই। বন্দরকেন্দ্রিক ছোট-বড় মন্দ খবরগুলো বিশ্বগণমাধ্যমকেও নাড়া দিচ্ছে। আর সামাজিক গণমাধ্যম তো আছেই। অন্যদিকে যোগ হচ্ছে শিক্ষা সেক্টরের খবর। শিক্ষার্থীদের স্টাইলে শিক্ষকরাও কিছুটা বেপরোয়া। আন্তর্জাতিক বিশ্বের চোখ-চশমায় তা ধরা না পড়লে আমাদের পাসপোর্টের মানের দিকে কেন নজর যাবে তাদের? তা বিশ্ব দরবারে দেশের পরিচয়কে খাটো করে দিয়েছে। একটা অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর এমন আশাহতের ঘটনা ধারণারও বাইরে। অথচ বিশ্বের কাছে গর্ব ও সম্মানের সঙ্গে প্রেজেন্ট করার মতো অনেক ঘটনা ও উপাদান বিদ্যমান বাংলাদেশে।  

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।