সভ্য সমাজের সঙ্গে দ্বীপবাসীর কোনো যোগাযোগ নেই। ওরা আদিম অধিবাসী।
ভয়ংকর এই নিষিদ্ধ দ্বীপের নাম ‘নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড’ বা ‘উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপ’। এমনই একটা ভয়ংকর দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে অবস্থিত। দ্বীপটা ভারত কেন্দ্রশাসিত আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত। এই দ্বীপেই তীরন্দাজ ‘সেন্টিনেলিজ’ জাতির বাস। অন্যদিকে ‘সাউথ সেন্টিনেল আইল্যান্ড’—এর চিত্র ভিন্ন। ওখানে কোনো জনমানবের অস্তিত্ব নেই। তেমনি আরেকটা দ্বীপের নাম ‘হ্যাভলক আইল্যান্ড’। এক সময় দ্বীপটা ছিল জনবসতিহীন। এখন সেখানে প্রচুর জনবসতি। যার বেশির ভাগই বাঙালি, আদি নিবাস পশ্চিমবঙ্গে। তারা দেশ ভাগের আগেই সেখানে গিয়েছিলেন। ভারত সরকার পরবর্তীতে আন্দামান-নিকোবরে জমি বন্দোবস্ত দিয়েছিল বাঙালিদের চাষাবাদ করে খেতে। মূলত সেই থেকেই হ্যাভলকের বাসিন্দা তারা।
উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপ আয়তনেও বিশাল। পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা দ্বীপ। আন্দামান-নিকোবর থেকে দ্বীপের দূরত্বও খুব বেশি নয়। বেশি নয়, দ্বীপের আধিবাসীর সংখ্যাও। দুই থেকে চার শতাধিক বড়জোর। কেউ কেউ বলেন, এরচেয়েও কম। তবে সেন্টিনেলিজ জাতি খুবই হিংস্র, এটা সত্য। এই নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। কারণ বিষয়টা বাইরের মানুষের কাছে এখন আর অজানা নয়।
আন্দামানবাসীরাও প্রমাণ পেয়েছেন সেন্টিনেলিজদের হিংস্রতার বিষয়ে। তারা জেনেছেন, শুনেছেন দ্বীপের কাছাকাছি জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে জীবিত ফেরত আসতে পারেন না আজ অব্দি। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে ভিন্ন, শুধু জেলেই নয়, দ্বীপে প্রবেশের চেষ্টা করায় তীর ছুড়ে বহু লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আদিবাসীরা। একবার সাদা চামড়ার একজন ধর্মযাজক সেন্টিনেল দ্বীপে ধর্মপ্রচার করতে গেলে তাকেও হত্যা করে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছিল ওরা। এছাড়াও আশির দশকের শুরুতে ‘প্রাইমরোজ’ নামক একটা জাহাজ বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে সেন্টিনেল দ্বীপের কাছে ঝড়ের কবলে পড়েছিল। গভীর রাত; ক্যাপ্টেন দিশাহারা হয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড ঝড়ে জাহাজ সামলে রাখতে পারছে না। উপায়ান্তর না দেখে তিনি নির্দেশ দিলেন জাহাজটাকে স্থলভাগের দিকে নিয়ে যেতে। একপর্যায়ে জাহাজ উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপের কাছে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন নাবিকরা। কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় হঠাৎ বড় একটা পাথর খণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে জাহাজের তলা ফেটে যায়। কিন্তু জাহাজের গতি কমেনি। বরং জাহাজ সামনে এগিয়ে দ্বীপের কাছে আটকে পড়ে। নাবিকেরা তখনো টের পায়নি যে, তারা ঝুঁকিতে আছেন, তাদের জাহাজের তলা ফেটে গেছে। তাই তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জাহাজ নিরাপদে ভিড়েছে জেনে। কিন্তু সকাল হতেই তারা নতুন বিপদের মুখোমুখি হলেন। দেখলেন দ্বীপবাসীরা তীর-ধনুক হাতে নিয়ে জাহাজের দিকে আসার চেষ্টা করছে। দ্বীপবাসীদের অনেকটাই জংলি টাইপের মনে হলো তাদের কাছে। বিশেষ করে চেহারা কুৎসিত, কুচকুচে কালো হওয়ায় এমন ধারণা পোষণ করেছেন তারা। ওদের চেহারা দেখেই ভয় পেয়ে গেছেন নাবিকরা। কারণ তখন নাবিকরা ছিল নিরস্ত্র। অস্ত্রের মধ্যে ছিল শুধু কয়েকটা ‘ফ্লেয়ারগান’ বা ধোঁয়া ছোঁড়ার পিস্তল, আর হাতুড়ি-দা-কুঠার। এছাড়া শত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর মতো আর কোনো অস্ত্রশস্ত্র তাদের সঙ্গে ছিল না। ফলে তারা নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে যায়। এমতাবস্থায় নিরুপায় হয়ে ক্যাপ্টেন কাছাকাছি থাকা জাহাজগুলোতে সাহায্যের বার্তা পাঠান। ক্যাপ্টেনের বার্তায় সাড়া দিয়ে ভারতীয় কোস্ট গার্ড হেলিকপ্টারের সাহায্যে নাবিকদের উদ্ধার করে নিয়ে যান। কিন্তু জাহাজটাকে উদ্ধার করতে পারিনি তলা ফেটে যাওয়ায়। জাহাজটা আজও উত্তর সেন্টিনেলের কাছে কাত হয়ে পড়ে আছে। জোয়ার এলে অর্ধেকটা তলিয়ে যায়, বাকি অর্ধেক ভেসে থাকে। সেই পরিত্যক্ত জাহাজে একদিন জংলিরা উঠে কিছু লোহা-লক্কড় কুড়িয়ে নিয়ে যায়। যা দিয়ে তীরের ফলা বানায় জংলিরা।
দ্বীপবাসীর হিংস্রতার বহু নজির আছে। পারতপক্ষে তাই বাইরের কেউ উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপের কাছে ভিড়তে সাহস পায় না। এমনকি আন্দামানবাসীরাও সেন্টিনেল দ্বীপ থেকে দূরে থাকে। অবশ্য ভারত সরকার কর্তৃক দ্বীপটা সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই দ্বীপে পর্যটক বা গবেষক কেউ-ই প্রবেশ করতে পারেন না। তাছাড়া সেন্টিনেল দ্বীপের বলয় ঘিরে রয়েছে ভারতীয় কোস্ট গার্ডের কড়া নজরদারি। যার কারণে পর্যটক অথবা জেলেরা দ্বীপের কাছেও ভিড়তে সাহস পায় না। এতে করে দ্বীপবাসীও নিরাপদে রয়েছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, সেন্টিনেলিজদের অপরাধের জন্যে বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। এমনকি হত্যাকাণ্ডের জন্যেও ওদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না। আসলে ভারত সরকার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেন্টিনেল দ্বীপের আদিবাসীদের টিকিয়ে রাখতে। পাশাপাশি ওদের খাদ্য-বাসস্থান নিরাপদে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত সরকার। তাই দ্বীপের ৮-১০ কিলোমিটারের মধ্যে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। যাতে দ্বীপবাসী মৎস্য সংকটে না পড়ে। কারণ মাছ হচ্ছে দ্বীপবাসীর প্রধান খাদ্য। যদিও মাছের পাশাপাশি পশু-পাখি ফলমূল খেয়ে থাকে ওরা।
সেন্টিনেলিজরা নরখাদক। সুযোগ পেলেই ওরা মানুষের মাংসের স্বাদ নেয়। তবে নরখাদক হলেও সেন্টিনেলিজরা মূলত মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করে। কৃষি কাজ সম্পর্কে ওদের কোনো ধারণাই নেই। জানা নেই আগুনের ব্যবহারও। ফলে পশু-পাখি কিংবা মাছ শিকার করে কাঁচা খেয়ে থাকে। নরখাদকেরা বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করে পাতার ছাউনি দেওয়া ডেরা-কুটির। সন্ধ্যালগ্নে ওরা ডেরায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, আবার খুব ভোরে জেগে ওঠে পশু-পাখিদের মতো। রাতে প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয় ডেরার আশপাশেই। যার ফলে এলাকাটা অস্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধময় থাকে সব সময়। জংলিরা আগুনের ব্যবহার জানে না। রাতের জগত তাই ওদের কাছে বিভীষিকাময়। আঁধার ভীতির কারণে দ্বীপের অন্ধকারচ্ছন্ন বন-জঙ্গলে এরা পারতপক্ষে দিনের বেলায়ও প্রবেশ করে না। পশু-পাখি শিকার করলে বনের আশপাশে দাঁড়িয়েই তীর ছুড়ে। শিকার বনে হারিয়ে গেলে খুঁজে বের করে আনারও সাহস পায় না অনেক সময়। শুধু তাই নয়, সৈকত ছেড়ে বড়জোর কোমর সমান জলে নামে মাছ ধরতে; কারণ ওদের জলভীতিও প্রচণ্ড। তাই সৈকত আর বনের কিনার ধরে ওরা সব সময় বিচরণ করে নিরাপদ থাকতে। বিশেষ করে সকালের দিকে দ্বীপবাসীদের সৈকতে বেশি দেখা যায়। কারণ তখন জোয়ারে বড় বড় মাছসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী চলে আসে কিনারে। সেই সুযোগে সামুদ্রিক প্রাণীগুলো শিকার করে খাদ্যের চাহিদা মেটায়।
অন্যদিনের মতো আজও সকালে সৈকতে চলে এসেছে দ্বীপবাসীদের কয়েকজন। রাতে দ্বীপবাসী নিশ্চিতে ঘুমাতে পারেনি। আতঙ্কিত অবস্থায় রাত কাটিয়েছিল। গতকাল সকালে সুনামির মুখোমুখি হয়েছিল দ্বীপবাসী। পুনরায় বড় বড় ঢেউ এসে দ্বীপবাসীকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, এমন আতঙ্কেই আতঙ্কিত ছিল ওরা। গতকাল সকালে সৈকতের কাছাকাছি যারা মাছ ধরেছিল, তাদের কেউ-ই আর বেঁচে নেই। উত্তাল ঢেউয়ের তলে চাপা পড়ে চিরতরের জন্য হারিয়ে গেছে। আর যারা পাহাড়ের কাছাকাছি ছিল, তাদের তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে উঁচু উঁচু ঢেউয়ের তোড়ে দ্বীপের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও সুনামির তাণ্ডবে দ্বীপটার উচ্চতা বেড়েছে প্রায় ফুট তিনেক। যার কিছুই মালুম করতে পারেনি দ্বীপবাসী। হঠাৎ এত কিছু কেন ঘটেছে, তা এখনো দ্বীপবাসীর কাছে পরিষ্কার নয়। অবশ্য এতকিছু জানারও আগ্রহ নেই ওদের।
নিয়মমাফিক সকালে ঘুম থেকে উঠে জংলিদের কয়েকজন ভয়ে ভয়ে সমুদ্র পাড়ে এসেছে, নিখোঁজদের খুঁজতে। গতকাল সারা দিন ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছিল ওরা। তাই এখানে আসেনি কেউ-ই। ইতিপূর্বে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তীতে আহতদের ফিরে পেয়েছিল জংলিরা। সেই প্রত্যাশায় আজও এসেছে, আহতদের উদ্ধার করতে। খুব বেশি আহত হলে ওদের বাঁচিয়ে রাখে না স্বগোত্রীয়রা। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে তীর ছুড়ে হত্যা করে। পরবর্তীতে মৃতের মাংস কেটে টুকরো টুকরো করে সবাই মিলে ভুরিভোজের আয়োজন করে। বহিরাগতদের ক্ষেত্রে নিয়ম ভিন্ন, আহত না হলেও তীর ছুড়ে তাকে হত্যা করে কাঁচা মাংস খায় জংলিরা।
জংলিদের কাছে গতকালের দুর্যোগটা ছিল ভিন্ন ধরনের। আগাম কোনো সতর্কতা সংকেত পায়নি ওরা। অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। ওরা সমুদ্র পাড়ের সন্তান, সমুদ্রের মর্জি বুঝে জন্মলগ্ন থেকেই। শুধু এবারি ঘটল বিরল ঘটনা। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ উত্তাল ঢেউ দ্বীপে আঘাত হেনেছিল। স্রোতের টানে ভেসে গিয়েছিল দ্বীপের কয়েকজন আদিবাসীও; যারা এখনো নিখোঁজ রয়েছে। হারিয়ে যাওয়াদের খুঁজতেই সৈকতে এসেছে স্বগোত্রীয়রা। বুদ্ধি করে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে আহতদের খুঁজতে বের হয়েছে জংলিরা। কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে দ্বীপের চারপাশে তল্লাশি চালাচ্ছে কাঁচা মাংস খাওয়ার লোভে। পঁচা খাবার ওদের পছন্দ নয়, তাই হন্নে হয়ে খুঁজছে আহতদের। যদি পেয়ে যায়, তাহলে টাটকাই খেতে পারবে। জংলিরা এতটাই হৃদয়হীন বর্বর যে, কারণবশত স্বগোত্রীয় কারোর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে অথবা মারাত্মক জখম হলে, উল্লাসিত হয়ে নাচতে নাচতে হত্যাকাণ্ড চালায়।
সেন্টিলেন দ্বীপের পরিধিও কম নয়, একজন মানুষের পক্ষে হেঁটে দুই-এক দিনেও দ্বীপ প্রদক্ষিণ করা সম্ভব নয়। তার ওপর দ্বীপে রয়েছে ঘন বন-জঙ্গলের বিস্তৃতি। বনের ভেতরে গা ছমছমে পরিবেশ। উঁচু উঁচু গাছ-গাছালি আর দুর্ভেদ্য লতাগুল্মের বিস্তৃতির কারণে দিনের বেলায়ও বন অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। জংলিরা পারতপক্ষে বনের গহীনে প্রবেশ করে না। তবে নারকেল খাওয়ার লোভে বনের কাছাকাছি ঘুরে বেড়ায়। নারকেল ওদের প্রিয় খাবার। সমস্যা হচ্ছে, জংলিরা গাছে উঠতে জানে না। নিচে পড়ে থাকা নারকেলের খোঁজে প্রতিদিন বনের কিনারে ঘুর ঘুর করে।
জংলিদের ডেরা-কুটির থেকে বন খানিকটা দূরে। দূরত্ব আনুমানিক হাফ কিলোমিটার। আর ডেরা-কুটির থেকে সৈকতের দূরত্ব দেড়-দুই কিলোমিটারের মতো। ডেরা-কুটিরের আশপাশে বনের বিস্তৃতি থাকলেও বন ততটা গভীর নয়।
সকালে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে জংলিরা দলবদ্ধ হয়ে বেরিয়েছে আহতদের মাংস খাওয়ার লোভে। হাতে তীর-ধনুক। সামান্য আহতদের আরও কাবু করতে হলে তীর-ধনুকের প্রয়োজন আছে। বড়দের সঙ্গে উল্লাস করতে করতে কিশোররাও বেরিয়েছে তীর-ধনুক নিয়ে। জংলি কিশোররা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে অল্প বয়সেই পাকা শিকারি হতে।
আহতদের খুঁজতে খুঁজতে নারী-পুরুষের ৬-৭ জনের দল সৈকতের পূর্বপাশে চলে এসেছে। চারদিকে দৃষ্টি রেখেই ওরা সামনে হাঁটছে। কিছুক্ষণ হাঁটতেই দূর থেকে দেখতে পেল সৈকতের বালির উপর একজন মানুষ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। দূর থেকেই গায়ের রং আর পোশাক পরিচ্ছদ দেখে নিশ্চিত হয়েছে মানুষটা ওদের স্বগোত্রীয় কেউ নয়। স্বগোত্রীয় হলে গায়ের রঙ হতো কুচকুচে কালো; উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া শরীর থাকবে অনাবৃত। তার মানে শিকার বহিরাগত। দুর্যোগের কবলে পড়ে আহত হয়ে দ্বীপে আছড়ে পড়েছে।
শিকারিরা খুশি, ভীষণ খুশি আহত শিকারের সন্ধান পেয়ে। অনেক দিন গত হয়েছে নরমাংসের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি। মহাভোজের আয়োজন হবে আজ দ্বীপে। ধীরে ধীরে সতর্ক হয়ে এগোচ্ছে ওরা। তীর-ধনুকের পজিশন ঠিক করে নিয়েছে আগেই। শিকার যদি শক্তি প্রদর্শন করে তাহলে তীর ছুড়ে সঙ্গে সঙ্গে গেঁথে ফেলবে। আর বেশি আহত হলে তো কথাই নেই, তীর-ধনুকের প্রয়োজন হবে না।
দূর থেকে দেখে শিকারটাকে আহত মনে হলেও তারা সতর্ক হয়ে এগোচ্ছে। বলা যায় না, যদি শিকার উল্টো আক্রমণ করে। দোপায়ী শিকারকে বিশ্বাস নেই। আরেকবার জলে ভেসে আসা দোপায়ী শিকার ওদের একজনের বুকে লাথি মেরেছিল। লাথির আঘাতে বেচারি অনেকদিন কষ্ট পেয়েছিল। সেই থেকে দ্বীপবাসী খুব সতর্ক। তীর-ধনুক হাতে নিয়েই শিকারের কাছাকাছি যায়। তাছাড়া সভ্য মানুষদের মতোই ওরাও শত্রুকে দুর্বল ভাবে না। সাধারণত ওরা রিস্কের কাজে কিশোর-কিশোরীদের ব্যবহার করে। ওদের সামনাসামনি রাখে। বিপজ্জনক কিছু হলে যেন বড়রা নিরাপদ থাকে, সেজন্য এই ধরনের কাজ করে। আবেগ, মায়া-মমতার ঘাটতি থাকায় মূলত নির্দয় হয় আদিবাসী জংলিরা। তাছাড়া এটাই সেন্টিনেলিজ জাতির রীতি। যুগ যুগ ধরে ওরা বংশ-পরস্পরায় এভাবেই কিশোর-কিশোরীদের ব্যবহার করে আসছে।
দুই কিশোর সামনে এগিয়ে গেল। হাতে তীর-ধনুক। ওদের পেছন পেছন বড়রাও এগোচ্ছে। শিকার জল থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে পড়ে আছে। সতর্ক হয়ে দুই কিশোর এগিয়ে গিয়ে তীরের ফলা দিয়ে প্রথমে শিকারের পিঠে খোঁচা মারল। জামা ছিঁড়ে পিঠে আঁচড় লেগে সামান্য রক্তপাত হলেও শিকারের হুঁশ নেই। ব্যথা পেয়ে সামান্য নড়লো শুধু। এবার নিশ্চিত হয়েছে শিকার বেঁচে আছে, কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন না কী অচেতন তা বোঝার ক্ষমতা নেই ওদের। তবে যতটা বুঝতে পেরেছে যে, শিকার নিরাপদ। তাই কিশোররা ইশারায় জানালো শিকারকে এখনই বেঁধে ফেলতে।
সাহস পেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক ভাবেই বড়রা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। শিকার প্রতিপক্ষ নয়, দুর্বল; এটা যখন নিশ্চিত হয়েছে, তখন উল্লাসে ফেটে পড়ল। শূকরের মতো ঘোৎ ঘোৎ করে হাসতে লাগল। সমস্বরে হাসতে লাগল। সাগর পাড় কাঁপিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাসতে লাগল। মুখে কোনো কথা নেই। কারণ ভাবের আদান-প্রদানের জন্য ইশারা-ইঙ্গিত আর হাসি ছাড়া ওদের আর কোনো ভাষা জানা নেই। ওরা কাঁদতে জানে না, জানে না কথাবার্তা বলতেও। শুধু ইশারায়ই ভাবের আদান-প্রদান করে, তবে হাসতে জানে। দলের নারীরাও খুশিতে হাত-পা ছুঁড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাসছে। সে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হলো মুহূর্তেই। আহতের ভাগ্য ভালো যে, সে এখনো অচেতন। নচেৎ এমন নৃত্যকলা দেখলে নির্ঘাৎ হার্ট ফেইলিউর হতো বেচারির।
শিকার অচেতন থাকায় বল প্রয়োগের প্রয়োজন হচ্ছে না। এখন সমস্যা হচ্ছে, তাকে হাঁটিয়ে নেওয়াও সম্ভব নয়, বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে নিতে হবে। তারপর যা করার ওদের ডেরায় নিয়ে করবে। সবাই মিলে ভুরিভোজের আয়োজন করবে আজ।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক বড়রা লতা দিয়ে শিকারের হাত-পা শক্ত করে বাঁধতে লাগল। বাঁধা অবস্থায় অমনি লোকটার চোখ খুলে গেল। সে হঠাৎ বুঝতে পারেনি কী হতে চলছে, তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কুৎসিত কুচকুচে কালো নারী-পুরুষেরা। ওদের দেখে প্রথমে ভয়ে সে চেঁচিয়ে উঠার চেষ্টা করল, কিন্তু শরীরে পর্যাপ্ত শক্তি না থাকায় চেঁচাতে পারেনি, গলা ধরে আসছে। চুপচাপ রইল তাই। তার বিশ্বাস, কালো হোক আর কুৎসিত হোক, মানবজাতির কেউই তো তাকে উদ্ধার করেছে। সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সেবা-শুশ্রূষা করে ওরা নিরাপদে পৌঁছে দেবে নিশ্চয়ই। চলবে...
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪
আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩
এমজেএফ/আরএইচ