ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস

মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১১

আলম শাইন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২৪
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১১

শিকার ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে, এমনটা ভাবেনি নরখাদকের দল। কল্পনাও করেনি সভ্য সমাজের মানুষ এতটা চতুর হতে পারে।

ওদের ধারণা দ্বীপ জঙ্গলাবৃত, চতুর্পাশ সমুদ্র বেষ্টিত, শিকার পালিয়ে যাওয়ার চিন্তাই করবে না। সেটা মাথায় নিয়েই শুধু নজরদারিতে রেখেছে। অথচ সেই সুযোগেই চোখের সামনে দিয়েই পালিয়েছে শিকার। পালানোর সময় চার-পাঁচ জন ধাওয়া করেও শিকার আটকাতে পারল না। বিষয়টা ওদের জন্য লজ্জাজনকই। তার ওপর প্রায় দৃষ্টিসীমার মধ্যেই ঘাপটি মেরে রয়েছে শিকার। তারপরেও ভয়ে বনে প্রবেশের চেষ্টা করেনি নরখাদকের দল। কারণ প্রচুর বনভীতি কাজ করে ওদের ভেতর। মূলত এই বনভীতির সৃষ্টি হয়েছে আগুনভীতি থেকে। যার কারণে ভয়ে ওরা আজ পর্যন্ত আগুনের ব্যবহারও শেখেনি। শুধু জানে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে। তার প্রমাণও ওরা পেয়েছে বজ্রপাত ও দাবানলে বনভূমি পুড়ে যেতে দেখে।

বেশ কয়েক বছর আগে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে দ্বীপে। তারপর থেকেই নরখাদকদের আগুনভীতি আরও বেড়ে গেছে। একদিন ওরা ১০-১২ জনের দল নিয়ে শিকারের খোঁজে বনে প্রবেশ করেছে। সেদিন আকাশ মেঘমুক্ত ছিল। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় শিকারের পিছু পিছু ধাওয়া করে গহীন বনে ঢুকে পড়েছে ওরা। ঠিক তখনই একখণ্ড কালোমেঘ বনের একাংশ ঢেকে ফেলেছে। ওরা বুঝতে পেরেছে শিগগিরই ঝড় বইবে। দেরি না করে দ্রুত বন থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিল। অমনি শুরু হলো তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। এর মধ্যেই আকাশ ফাটিয়ে গর্জন করে বজ্রপাতও ঘটল। চোখের পলকেই দুই-একজন ছাড়া বাকি সবাই বজ্রের আগুনে পুড়ে কাঠ-কয়লার মতো অঙ্গার হয়ে গেল। ভয়াবহ সেই ঘটনার পর থেকেই নরখাদকেরা আর যখন তখন বনে প্রবেশ করার সাহস পায়নি। তাছাড়া এর আগেও ওদের পূর্ব পুরুষদের অনেকেই বজ্রপাতের শিকার হয়েছে। বংশ পরস্পরায় সেই কাহিনী শুনে সবাই সতর্ক থাকার চেষ্টা করছে। ফলে ওরা এতটাই সতর্ক হয়েছে যে, শীত মৌসুমেও বনে প্রবেশ করতে ইতস্তত করে।

আকস্মিক বজ্রঝড় তমুল বৃষ্টিপাত দ্বীপবাসীর নিত্যসঙ্গী। ভৌগলিক কারণেই সব সময় বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করে সেন্টিনেল দ্বীপে। শীতের মাস দুয়েক ব্যতীত যেকোন মুহূর্তে ঝড়-বৃষ্টি এই দ্বীপে বিনা নোটিশেই হানা দেয়। খেয়ালি আবহাওয়ার দরুণ নরখাদকেরা সব সময় সতর্ক হয়ে বনে প্রবেশ করে। ওরা জানে বনের গহীনে প্রবেশ করলে ফিরে আসতে বেগ পেতে হয়। যাতায়াতের সময় ঝড়ের কবলে পড়লে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। তার ওপর বাতাসের ক্ষিপ্রগতি থাকলে বিপদ বেড়ে যায়। গাছের ডালপালা ভেঙে কেউ আহত হলে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ এমন পরিস্থিতিতে রীতি অনুযায়ী স্বগোত্রীয়দের শিকারে পরিণত হতে হয় আহতদের। তাই যতটা সম্ভব আবহাওয়ার প্রতি খেয়াল রেখে চলাফেরা করে। বিশেষ করে আকাশে মেঘ জমলে বনের ধারে কাছেও কেউ ভেড়ে না। তেমনি সমুদ্রে মাছ ধরার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকে সবাই।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, দ্বীপবাসীরা সাঁতার কাটতেও জানে না। মানুষ যে জলে ভাসতে পারে বা সাঁতার কেটে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে, সেটা ওদের কাছে একটা আশ্চর্যজনক বিষয়। সমুদ্রে মাছ ধরতে নামলে ঝুঁকি নিয়েই মাছ ধরে। খুব দূরে যায় না, সৈকতের কাছাকাছিই থাকে। কারণ সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী টেকসই কোনো জলযান ওদের নেই। গাছের গুঁড়ি খোদল করে ডিঙ্গি বানিয়ে মাছ ধরে। গোসলাদির সময় সমুদ্রে নামলেও বড়জোর কোমর সমান জলে নেমে গোসল সারে। ভাটার সময় পারতপক্ষে সমুদ্রেই নামে না।

মূলত এসব কারণে নরখাদকদের কাছে কখনো জল-জঙ্গল নিরাপদ নয়। তারপরও জীবিকার তাগিদে জল-জঙ্গলে ঝুঁকি নিয়েই বিচরণ করে। দাবানলে বনজঙ্গল পুড়ে ছারখার হতে দেখলে ডেরা-কুটির ছেড়ে পালিয়ে বেড়ায়। আগুন দেখলে ওরা এখন এতটাই ভয় পেয়ে থাকে। ওদের ধারণা এই বস্তু গাছগাছালি পুড়িয়ে দিতে পারলে মানুষকে তো আরও সহজে পুড়িয়ে ফেলতে পারবে। ইতোপূর্বে তার প্রমাণও পেয়েছে। সুতরাং আগুন থেকে উপকৃত হওয়ার কিছু নেই। তারচেয়ে ভালো যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।

নরখাদকদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে মাছ। মাছ ছাড়াও সামুদ্রিক সব ধরনের প্রাণীই এদের খাবার। তবে সব ধরনের খাবারই কাঁচা খেতে পছন্দ করে। সৈকতের কাছাকাছি বনের কিনারে প্রচুর ফল-ফলাদির গাছ রয়েছে। ফলের মধ্যে নারকেল আর পশুর মধ্যে শূকর বেশি প্রিয়। শূকর সাধারণত বনের আশপাশেই ঘোরাফেরা করে, তাই শিকার করতে কিছুটা সুবিধা হয়। বনের ভেতর প্রবেশের প্রয়োজন হয় না, বাইরে দাঁড়িয়েই তীর ছুড়ে শিকার করতে পারে।

এদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার হচ্ছে নরমাংস। যদিও তা সব সময় খাওয়ার সুযোগ হয় না। বহিরাগত কেউ দ্বীপে এলে অথবা স্বগোত্রীয় কেউ আহত হলেই তবে নরমাংসের স্বাদ নিতে পারে। বহিরাগতের সন্ধান পেলে এরা পৈচাশিকভাবে উল্লাস করতে থাকে। সে এক বীভৎস কাণ্ড! তা দেখলেও গায়ের রোম শিউরে উঠে যে কারোই।  

উদয় ঘোষাল বহিরাগত। নরখাদকদের ধারণা বহিরাগতের মাংস বেশি সুস্বাদু হয়। এই ধারণার জন্ম হয়েছে সভ্য সমাজের মোটাতাজা মানুষের মধ্যে স্বগোত্রীয়দের মাংসের পরিচ্ছন্নতার তফাৎ বের করতে পেরে। সেই সুবাদে ওরা ধরে নিয়েছে উদয় ঘোষালের মাংস খেতে মজাদার হবে। অথচ সেই শিকারটাও চার-পাঁচজন দৌড়ে ধরতে পারল না। বিষয়টা ওদের জন্য দুঃখজনকই। তাই উদয়কে খুঁজতে দলবদ্ধ হয়ে ওরা বনের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াল। পড়ন্ত বিকেলে বনের ভেতরে প্রবেশের আর সাহস হয়নি ওদের। বনের সীমারেখার বাইরে দাঁড়িয়েই এলোপাতাড়ি তীর ছুড়তে লাগল।

ইতোমধ্যেই আরও অনেকেই চলে এলো বনের কাছে। কেউ কেউ বনের ভেতরে প্রবেশের হিম্মত দেখালেও বড়দের আপত্তিতে প্রবেশ করেনি আর। তবে সন্ধ্যা নাগাদ ওরা ওখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিয়ে রেখেছে। শিকারের নাগাল না পেয়ে পরে রাতের আঁধার নামার আগেই ডেরায় ফিরে গিয়েছে।

নরখাদকেরা আঁধারে চলাফেরায় অভ্যস্ত নয়। তাই সন্ধ্যালগ্নে খেয়েদেয়ে যার যার ডেরায় ফিরে যায়। অবশ্য ডেরাগুলোর কোনো নির্দিষ্ট মালিকানাও নেই। যেখানে ‘রাত সেখানেই কাত’ এমনটাই ব্যবস্থা। ওদের জীবনধারাও একটু ব্যতিক্রম। সংসার বলতে তেমন গোছানো কিছু নেই। নেই বিয়েশাদির বন্ধন রীতিও। নির্দিষ্ট কোনো নারী-পুরুষ একত্রে সময় কাটাতে হবে এমন বাধ্যকতাও নেই। পশুদের মতোই পারিবারিক জীবন ব্যবস্থা। ফলে কার সন্তান কোনটা, কেউ তা সঠিকভাবে নির্ণয়ও করতে পারে না। অনুমানে ধরে নেয় অমুক শিশু অমুকের সন্তান। তাই প্রতিটা শিশু সন্তানকে পুরুষরা স্নেহের দৃষ্টিতে দেখে। বলা তো যায় না, শিশুটা যদি ওর ঔরসজাত সন্তান হয়!

ওদের একজন দলীয় প্রধানও থাকে। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সে কঠোর ভূমিকা পালন করে। যেমন: কেউ আহত হলেই যে, ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে এমনটা নয় কিন্তু; আগে দলীয় প্রধানের অনুমতি নিতে হবে। সে যদি মনে করে আহত ব্যক্তি সহজে সেরে উঠবে না, তখনই সিদ্ধান্ত দেয় হত্যাকাণ্ডের।

গতানুগতিক অন্যান্য উপজাতিদের মতোই দলীয় প্রধান সাধারণত শৌর্য-বীর্যের অধিকারী হয়। ওদের মধ্যেও তদ্রুপ। ওরা দলীয় প্রধান বাছাই করে তীর ছোড়ার মাধ্যমে। যার তীরের ফলা যত দূরের নিশায় বিঁধবে সেই হবে দলীয় প্রধান। অবশ্যই এক্ষেত্রে পর পর পাঁচ-ছয়বার তীর ছুড়ে এগিয়ে থাকতে হবে। এই জন্য দলীয় প্রধান সবসময় হৃষ্টপুষ্ট মধ্য বয়সীরাই নির্বাচিত হয়। কারণ শক্তি সামর্থ্যের বিচারে ওরাই প্রাধান্য পেয়ে থাকে।

বর্তমান দলীয় প্রধানও শৌর্য-বীর্যে সামর্থ্যবান। দেখলেই বোঝা যায়, গায়ে যথেষ্ট শক্তি রাখে ও। গাট্টাগোট্টা শরীর, উচ্চতা পাঁচ ফুটের কাছাকাছি। পিগমিদের মতো আকৃতি। অবশ্য এই দ্বীপের সবারই গড় উচ্চতা পাঁচ ফুটের মতোই। খুব কমই আছে পাঁচ ফুট ছাড়িয়ে। তবে নারীদের উচ্চতা পুরুষের চেয়ে খানিকটা বেশি। শরীরও তাগড়া; হৃষ্টপুষ্ট। নারী-পুরুষ সবার মাথার চুল কোঁকড়ানো তামাটে রঙের। গায়ের রং কুচকুচে কালো।

দ্বীপবাসী নির্দিষ্ট কোনো ভাষায় কথা বলতে পারে না। এমনকি কারো নির্দিষ্ট কোনো নামধামও নেই। একে অপরকে ইশারা-ইঙ্গিতে ডাকে। ইশারার মাধ্যমেই নাম প্রকাশ করে। যেমন: ওদের মধ্যে কেউ যদি একটু বেশি লম্বা হয়, তাহলে ইশারায় উচ্চতা দেখায়। সবাই তখন বুঝে নেয় লম্বা লোকটার কথা বলছে। খাটো হলেও তদ্রুপ। মধ্যম আকৃতির হলে বা গায়ে কোনো দাগ অথবা ক্ষতচিহ্ন থাকলে, ইশারায় লোকটাকে ওভাবে চেনায়। ওরাও ইশারার বর্ণনায় একে অপরকে সহজেই চিনতে পারে। সভ্য মানুষ কথা বলে যেমন দ্রুত বোঝাতে পারে, তেমনি ইশারার মাধ্যমেই সবকিছু দ্রুত বোঝাতে পারে ওরা। সেভাবেই ইশারায় বর্তমান দলীয় প্রধান বুঝিয়ে দিলো, যার গাফিলতিতে শিকার পালিয়েছে, তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি না দিলে ভবিষ্যতে সবাই একই ভুল করবে বারবার। কাজেই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই কঠিন বিচার হবে। তার আগে ওকে সুযোগ দেওয়া হবে শিকার খুঁজে বের করার।

নরখাদকেরা বিচার ব্যবস্থা এবং নরমাংসের স্বাদ নেওয়া ওদের পূর্ব পুরুষদের কাছেই শিখেছে। ঊনিশ শতকের শুরুর দিকের ঘটনাটা। কিছু দুর্ধর্ষ ডাকাতকে আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারের কারাগারে বন্দি করে রেখেছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসন। কারাগারে বন্দিদের ওপর খুব অত্যাচার নির্যাতন চালাত সিপাহিরা। তাদের নির্যাতন সইতে না পেরে সেখান থেকে একজন ডাকাত যেভাবেই হোক দক্ষিণ আন্দামানের কোন এক দ্বীপে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। দ্বীপটাতে তখন মানব বসতি ছিল না। গভীর জঙ্গল, হিংস্র জানোয়ার আর নারকেল কাঁকড়ার উৎপাত ছিল সমস্ত দ্বীপজুড়েই। তাই বাধ্য হয়ে কয়েদি সেখান থেকেও পালানোর পরিকল্পনা করল। তারপর সুযোগ বুঝে একদিন জীবনবাজি রেখে গাছের গুঁড়িতে চেপে উত্তাল সমুদ্রে ভেসে পড়ল। সে জানে সাগরে ভেসে যাওয়ার মানে হচ্ছে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া। অত্যাচার নির্যাতন হজম করার চেয়ে সাগরে ভেসে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাই উত্তম মনে হয়েছে তার কাছে। এতে কোনো দ্বীপে আশ্রয় পেলে তো ভালোই, বেঁচে যাবে; না হলে মরতেও তার আপত্তি নেই।

কয়েদি ভাসতে ভাসতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপের সৈকতে আছড়ে পড়েছে। তাকে অসুস্থ অবস্থায় সেখান পড়ে থাকতে দেখে দ্বীপবাসীর মায়া হয়েছে। সৈকত থেকে কুড়িয়ে এনে সুস্থ করে তুলেছে। তারপর দ্বীপে নিরাপদে বসবাস করতে একটা ডেরা-কুটিরও বানিয়ে দিয়েছে। সেন্টিনেলিজরা স্বভাবে বুনো হলেও বর্তমান বংশধরদের মতো এতটা হিংস্রর ছিল না। ফলে বহিরাগত লোকটাকে খুব আদর যত্নে রেখেছে।

দ্বীপবাসীর সঙ্গে ইতোমধ্যে তার বন্ধুত্বের সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে সে দ্বীপবাসীর জীবনধারার সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। আর সেই সুযোগে দ্বীপের একাধিক নারীর সঙ্গে আদিম বাসনায় লিপ্ত হয়। তাতে দুই নারীর গর্ভে দুই সন্তান জন্ম নেয়। ওদের গায়ের রঙ বহিরাগত লোকটার মতোই উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের। ফলে সন্তানদের জন্মদাতা নিয়ে কারো দ্বিমত ছিল না।

কয়েদি কয়েক বছর ভালোভাবেই দ্বীপে কাটিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন দ্বীপে অতিবাহিত হওয়ায় একঘেয়েমি চলে এসেছে তার মধ্যে। কারো সঙ্গে মন খুলে কথাবার্তাও বলতে পারছে না, তাই সভ্য সমাজে ফিরে যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে। একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে কয়েদি প্রহর গুনতে লাগল। তার ইচ্ছে আবার আন্দামান-নিকোবরে ফিরে যাবে। তবে এবার সে একটা বিশেষ বার্তা নিয়ে যাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিপাহিদের জন্য। নিশ্চয় তারা খুশি হবেন বার্তাটা পেয়ে। তাতে তার পালিয়ে আসার সাজা মওকুফ হওয়ার সুযোগ আছে।

পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সমুদ্র শান্ত দেখে একদিন গাছের গুঁড়ির একটা ডিঙ্গি নিয়ে কাউকে না জানিয়ে গোপনে সমুদ্রে ভেসে পড়ল কয়েদি। পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সেন্টিনেল দ্বীপে তার দুটি সন্তান আছে। সন্তানদের কারণে যদি দ্বীপবাসী তাকে আসতে না দেয়, সেই ভয়েই পালানোর পরিকল্পনা করেছে। কয়েদির এবারের যাত্রা বিপরীত। সেন্টিনেল থেকে আন্দামানের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। এছাড়া তার জানামতে আশপাশে আর কোনো দ্বীপ বা জনবসতি নেই। সুতরাং বাধ্য হয়ে তাকে আন্দামানেই ফিরে যেতে হচ্ছে।

সমুদ্র স্রোত অনুকূলে থাকায় বিকেলের মধ্যে কয়েদি আন্দামান পৌঁছে গেল। দ্বীপে পৌঁছেই সে ব্রিটিশ সিপাহিদের সঙ্গে দেখা করল। জেল পলাতক কয়েদি সিপাহিদের কাছে ধরা দিতেই তারা খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। পলাতক আসামি ফেরত এসেছে বিষয়টা যেন তারা বিশ্বাসই করতে পারছেন না। ভাবছেন এমন তো হওয়ার কথা নয়; নিশ্চয়ই কয়েদির মাথায় গণ্ডোগোল আছে। সিপাহিরা ইতস্তত করতেই কয়েদি বলল, ‘আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তোমাদের কাছে ফিরে এসেছি, না এলে তোমরা আমাকে ধরতেই পারতে না। একটা গোপন সংবাদ জানাতে আমি আন্দামানে আবার ফিরে এসেছি। এখন আমাকে বন্দি করবে, না কি গোপন সংবাদটা শুনবে, তোমরাই তা ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। ’

সিপাহিদের ঊর্ধ্বতন লক্ষ্য করলেন, কয়েদি কোনো ধরনের অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে না। যা বলছে ঠাণ্ডা মাথায়ই বলছে। তার মানে কয়েদির কথায় আস্থা রাখা যায়। বিষয়টা নিশ্চিত হয়ে তিনি বললেন, ‘গোপন সংবাদটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তোমার মুক্তির জন্য আমরা উপরে সুপারিশ করব। আর ভুলভাল কিছু শোনালে, পালিয়ে যাওয়ার জন্যে অতিরিক্ত সাজা ভোগ করতে হবে। শর্তে রাজি হলে বলতে পার। ’

শর্ত মেনে কয়েদি বলল, ‘আমি দুই বছর যাবত দ্বীপে পালিয়ে ছিলাম। তখন দেখলাম সেখানকার আদিবাসীরা বিভিন্ন কারণে ব্রিটিশ সিপাহিদের ওপর খুব ক্ষিপ্ত। ব্রিটিশদের কথা ওরা কানেই নিতে পারে না। কারণ ওদের পূর্ব পুরুষদের বসতভূমি ব্রিটিশদের দখলে। ওরা বসতভূমি উদ্ধার করতে সবাই একত্রিত হয়েছে। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছে। এরই মধ্যে প্রচুর তীর-ধনুকও সংগ্রহ করেছে। ওরা পরিকল্পনা করেছে দুই-তিন দিনের মধ্যেই তোমাদের আক্রমণ করবে। যেভাবেই হোক ওদের পূর্ব পুরুষদের বসতভূমি মুক্ত করবে। আমি দ্বীপ থেকে পালিয়ে এসেছি তোমাদের খবরটা জানাতে। নিজ থেকে না এলে তোমাদের সাধ্য ছিল না আমাকে খুঁজে বের করার, আশা করি বুঝতে পেরেছো। ’

সব কিছু শুনে কোম্পানির লোকজন প্রথমে বিশ্বাস করেনি। ভেবেছে কয়েদি নিজকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যে গল্প ফেঁদেছে। তার পরেও তারা শক্রর আক্রমণ ঠেকাতে সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখল। কয়েদি পালিয়ে আসার তিন দিনের মাথায় ঠিকই সেন্টিনেলিজরা সিপাহিদের ওপর হামলা চালিয়ে বসল। কিন্তু দ্বীপবাসী তীর—ধনুক নিয়ে ব্রিটিশ সিপাহিদের আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে সুবিধা করতে পারেনি। পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছে সেন্টিনেল দ্বীপে।

ফিরে এসে বহিরাগত লোকটাকে দ্বীপে না দেখে ওদের ভেতরে সন্দেহ জেগেছে। লোকটা গেল কোথায়! খোঁজ নিতে নিতে দ্বীপের একজনের কাছে জানতে পারলো সে আন্দামানে পালিয়েছে। তার মানে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এবার ওরা নিশ্চিত হয়েছে, বহিরাগত লোকটার বিশ্বাসঘাতকতায় যুদ্ধে চরমভাবে হেরেছে। সে আগেভাগে গিয়ে না জানালে নিশ্চয়ই বাপ—দাদার ভিটেমাটি উদ্ধার করতে সক্ষম হতো। তাই ওরা প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে। এবার ব্রিটিশ সেনা নয়, বহিরাগতের ওপর ক্ষেপেছে। কিন্তু তাকে ধরার মতো কোনো সুযোগ ওদের হাতে নেই। তাই দ্বীপবাসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে বহিরাগতের সন্তানদের ওপর প্রতিশোধ নেবে। বিশ্বাসঘাতকের সন্তানেরা এই দ্বীপে বসবাস করার অধিকার রাখে না। ওরা দলপতির কাছে বিচার চাইলো। সবশুনে দলপতি রায় দিয়েছে, বহিরাগতের সন্তানদের কেটে টুকরো টুকরো করে সাগরে ভাসিয়ে দিতে। রায় শুনে সবাই খুশি। দ্রুত বাস্তবায়নও করে ফেলল। কিন্তু তাতেও ওদের শরীরের জেদ মেটেনি। পরিশেষে জেদ মেটাতে শিশুদের মাংস মুখে পুরে কাঁচা চিবিয়ে খেল। এরপর থেকেই ওরা শুরু করে নরমাংসের স্বাদ নেওয়া। বিশেষ করে দ্বীপে বহিরাগত কেউ এলেই সঙ্গে সঙ্গে তীর ছুড়ে হত্যা করে কাঁচা চিবিয়ে খায়। নরমাংসের স্বাদ পেয়ে এখন স্বগোত্রীয়দেরও রেহাই দেয় না দ্বীপবাসী। কেউ আহত হলেই হত্যাকাণ্ড চালায়। চলবে...

মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-১
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-২
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৩
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৪
মানুষখেকোর দ্বীপ। পর্ব-৫
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৬
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৭
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৮
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-৯
মানুষখেকোর দ্বীপ | পর্ব-১০


আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২৪
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।