ঢাকা, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আরশোলা | অমিতাভ পাল

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৫
আরশোলা | অমিতাভ পাল

হঠাৎ ফড়ফড় করে ওঠা একটা শব্দে ভরে গেল সারাটা আকাশ। এইরকম একটা শব্দ স্বভাবতই মাটিতে অবস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এবারও করল কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে কেউ কিছু দেখতে পেল না।

এর কারণ অন্ধকার—এখন রাত এবং বিদ্যুৎহীনতার ফলে চারপাশ অষ্টাদশ শতাব্দীর আলো নিয়ে বসে থাকা ওই অন্ধকার কাউকেই কিছু দেখায় না বরং শোনায়, স্পর্শ করায় এবং ওই শোনা আর স্পর্শের ভিতর থেকেই সকলে খুজে পায় নিজ নিজ স্যান্ডেলগুলির মত নিজের চারপাশটাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপর এইরকম একটা অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার চর্চা আমরা করে যাচ্ছি কিছুদিন ধরে। চোখ বন্ধ করে একটা শিশু যেমন হেঁটে দেখে সে কেমন হাঁটতে পারে—আমরাও যেন সেই খেলায় মেতেছি। একবিংশ শতকের বিদ্যুৎময় উজ্জ্বলতাভরা রাতগুলিকে সদ্য খোলা শার্টের মত ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি আলনার কোথাও এবং অজস্র এলোপাথাড়ি কাপড়ের ভিড়ে সে হারিয়ে যাচ্ছে আবার তাকে খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত।

এখনও সেই অন্ধকার, সেই একই চারপাশ—শুধু একটা ফড়ফড় শব্দ বাড়তি একটা রিক্সার মত এসে যেন দাঁড়িয়ে আছে কোথাও যাবার ইচ্ছা নেই বলে। কিন্তু আমরা তো সেটা হতে দিতে পারি না ফলে রিক্সাওয়ালাকে সরে যেতে বলবার মতই ফড়ফড় শব্দটাকেও হয়ত সরতেই বলতে চাইছি কিন্তু সে কে—সেটা না জেনে কিভাবে তা করি। অথচ জানার কোনও উপায় কোথাও নেই। কেউ কেউ মোমবাতিটাকে উঁচু করে ধরে দেখতে চাইছে কিম্বা কেউ এসেছে চার্জার আর তারুণদের অনেকেই তাদের হাতের মোবাইলের মাথায় যে সরু আলোর সুতার টুকরাটা থাকে—সেটাকে ছুড়েই ধরতে চাইছে উৎসটাকে কিন্তু এইসব আলোর নাগালে নেই ওই শব্দের খনিটা। ওটা যেন আরেকটু উঁচুতে, আরও কোথাও।

সেখানে পৌঁছাতে আলোর আরেকটু বাড়তি আয়োজন দরকার। ফলে আমাদের এখন অপেক্ষা করতে হবে লোডশেডিং শেষ হবার এবং তারপর হঠাৎ দপ করে ঝলমল করে উঠবে যখন সমস্ত চারপাশ তখন ওই শব্দটার কাছে পৌঁছাতে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁচু হতেও হবে না। অপ্রতিরোধ্য কালো ব্রেসিয়ারের মত সে ফুটে বেরিয়ে থাকবে সাদা কামিজের পিঠে।

কিন্তু এইরকম একটা শব্দ মাথার উপরে নিয়ে অপেক্ষা করতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। এই মুহূর্তেই আমি সব নগ্নতাকে দেখে ফেলতে চাই। কালকের জন্য আজকের উচ্ছিষ্ট রেখে দেয়ার তো কোনও মানে হয় না। কাল আসবে কালকের প্যাটার্ন নিয়ে। আজ তাতে ঢুকবে কী করে? ফলে নিদ্রিত সেই অন্ধকারে চোখ দুইটিকে যতদূর সম্ভব ধুর্ত করে তোলা যায়—তাই করার চেষ্টা করলাম আমি। ফিরিয়ে আনতে চাইলাম আমার আদিম পূর্বপুরুষদের ইন্দ্রিয়গুলির বিশেষ ক্ষমতা। ওই ক্ষমতা দিয়েই তো তারা বুনো পৃথিবীকে চিনত, টিকে থাকত তার ঘন বনের ফাঁকে ফোকড়ে। এখনও তাদের কেউ কেউ সেইভাবেই থাকে অন্ধকারে তাদের চোখ জ্বলে ওঠে—কানের জালে আটকা পড়ে যায় শব্দের দাড়কিনা।

কিন্তু আমি ব্যর্থ হলাম চরমভাবে—অবশ্য ঠিক চরমভাবে না বরং চরমের ঠিক আগের বিন্দুটিতে গিয়ে আটকে গেল আমার প্রচেষ্টার কুটা। সেই আগের বিন্দুটিতে ছিল তারাদের দল, অস্পষ্ট সাদা মেঘের পরিচয় আর মোম কিম্বা চার্জারের আলোতে আভাসিত প্রথম ভোরের মত অস্পষ্ট ধূসর জানালাগুলি। এদিকে শব্দটা তখন যেন আরও বেড়ে গেছে—যেন যে না দেখার বেড়ায় সে আটকে আছে, তাকে সে ভেঙ্গে ফেলতে চায় আর ঝাপিয়ে এসে পড়তে চায় আমাদের উপরে শিলাবৃষ্টির মত। আমরাও তো তাই চাই, আমিও তো, কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ যেন সচিবালয়ের গেইটের মত—টাকা কিম্বা পাশ না দিলে তার গরাদ একটুও ফাঁক হবে না। অধৈর্য এখন শব্দটা আর আমরা—দুই পক্ষকেই উত্যক্ত করছে বিরক্ত শিশুর মত।

আমার আশেপাশের লোকগুলির অবস্থাও এখন আমারই মত। বিরাট একটা জালের মধ্যে অজস্র মাছের মত ছটফট করছে তারা, জানতে চাইছে শব্দটা কোন নতুন বিস্ময় নিয়ে আসবে তাদের জীবনে। হয়ত জালের মাছের মতই তারা ধৃত হয়ে বাজারে যাবে বিক্রি হবার জন্য, হয়ত আরও বড় কোনও জলাশয়ে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে এবং লেজের বিক্রম দেখিয়ে তাবৎ জলটরদের বিস্মিত করে ফেলবে তারা, হয়ত এরকম কিছুই হবে না—যা ছিল তাই থাকবে, তবু না জানার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি তো মিলবে। এই অসহ্য যন্ত্রণা যেন দাঁত ব্যথার মত নাছোড়—মাড়ি কামড়ে ধরে পড়ে আছে। অথচ আলো আসছে না। বাল্বগুলি জ্বলে উঠছে না হঠাৎ। সারা শরীর রাগে কড়মড় করছে কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই কোথাও। একেকটা মুহূর্ত কত দীর্ঘ হতে পারে—তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। ঘড়ির কাঁটা ভুলে গেছে ঘুরতে। সবকিছু স্থির, অচঞ্চল—বাতাসও নড়ছে না। শুধু ওই শব্দ—আহ্! আবার ওই শব্দের কথা মনে পড়ে গেল। এতক্ষণ অন্য সব প্রসঙ্গের স্তূপের নিচে তাকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু মনে পড়তেই হুড়মুড় করে সব প্রসঙ্গগুলি যেন খসে পড়ল স্তূপের শরীর থেকে আর শব্দটা দাঁত বের করে হেসে উঠল এক বিকট অট্টহাসি। হাসিটা আমাকে পাগল করে ফেলল আর পাগলামির সেই চরম মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের পাড়ার একমাত্র পাঁচতলা বাড়িটার ছাদে উঠে শব্দটাকে খুঁজব।

দুই.
আমার হাতে এখন একটা মশাল আর আমি দাঁড়িয়ে আছি পাঁচতলাটার ছাদে। আমার হাতটাকে আমি লম্বা করে দিয়েছি আকাশের দিকে। মশালটা দপদপ করে জ্বলছে কিন্তু আকাশ যেন আজ আর বোরকা খুলতে চাইছেই না। আর আকাশের এই বিরূপ আচরণে মনটা হতাশ হয়ে উঠছে। একস্তর হতাশার উপরে জমে উঠছে আরেকটা স্তর। স্তরগুলি শক্ত হয়ে কঠোর হয়ে যাচ্ছে। তারপরও মশালটাকে হাতে নিয়ে আমি আরেকটু উঁকিঝুকি মারার চেষ্টা করলাম অন্তরীক্ষের বগল দেখার লোভে। কিন্ত আবারও ব্যর্থ হতে হলো। আর এই ব্যর্থতা রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য করল আমাকে। সব কিছু জাহান্নামে যাক—এই ভেবে মশালটাকে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে নিভিয়ে আমি ছাদ থেকে নেমে যাবার জন্য যেই সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি—ওমনি সারাটা আকাশ ঝলমল করে উঠল এক অপরূপ উজ্জ্বল আলোয়। প্রথমে আমার মনে হলো লোডশেডিং শেষে বিদ্যুৎ এসেছে বোধ হয়, কারণ ছাদের চিলেকোঠার দেয়ালে লাগানো বাল্বটা জ্বলে উঠেছিল তখনই। কিন্তু আলোটা যেন ওই বাল্ব, চারপাশের আরও অনেক অনেক বাল্ব ও টিউব লাইট এবং তাদের প্রতিফলনগুলির চেয়েও বেশি উজ্জ্বল, বেশি প্রভাময়। ফলে ঘাড় ঘুরে গেল আকাশের দিকে এবং সেদিকে তাকিয়েই দেখলাম এক অবাক করা দৃশ্য।

আমার ঠিক মাথার উপরে ছোঁয়া যায় এমন দূরত্বে ঝুলছে একটা বিরাট খাঁচা আর তাতে উড়ছে, ঘুরছে, ছটফট করছে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ পাখি। এইরকম পাখি আমি এর আগে কোনদিন দেখিনি—এত ঝলমলে, ছটফটে, এত পালকবহুল। তাদেরই হুড়াহুড়ি, ওড়াউড়ি, পালকে পাখায় ঘষাঘষি তৈরি করছিল ওই শব্দ—যা কিছুক্ষণ আগেও পাগল করে দিচ্ছিল আমাকে। এখন পাখিদের অপরূপ ওই রূপ শব্দটার কথা ভুলিয়ে দিয়েছে আমাকে, আমাদেরকে। এখন আমরা সবাই হা করে তাকিয়ে আছি। ওই খাঁচাটার দিকে, আর আমাদের সবার মনের মধ্যে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে অন্তত একটা পাখিকে নিজের করে নেবার ইচ্ছা। কৈশোরে একটা পাখিকে ধরে হাতে নেবার একটা স্মৃতি হঠাৎ জেগে উঠল হাতের আঙ্গুল আর তালুর কোষে কোষে। মাঝে মাঝেই ছটফট করে ওঠা এবং তারপর কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হয়ে পড়া কৈশোরের ওই পাখিটা যেন এই পাখিগুলির ভিড়ে লুকিয়ে আছে কোথাও। এখন আমার তাকে খুঁজে নিতে হবে।

খুব তীক্ষ্ণ চোখে পাখির ভিড়টার দিকে তাকিয়ে খুঁজতে চাইলাম আমার পাখিটাকে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম ওই হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ পাখির প্রতিটিই হুবহু একরকম। ঠোঁট থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত কোথাও একটুও অমিল নেই তাদের মধ্যে। এদিকে আমি যখন ওই পাখিগুলির দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম—তখন এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করা লোকগুলির মধ্যে শুরু হয়ে গেছে লাফালাফি, চ্যাঁচামেচি আর পাখি নেবার এক আপ্রাণ চেষ্টা। কেউ এনেছে আঠা লাগানো বাঁশ, কেউ চেয়ার, মই—যার যা কিছু আছে সব এখন একটা পাখিকে হাতের মুঠায় নেবার জন্য ব্যবহার করছে তারা। স্টপেজে আসা সদ্য একটা বাসে ওঠার জন্য মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবী যেভাবে তার পাশের লোকটাকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে ফেলে দেবার চেষ্টা করে কিম্বা দরজাটাকে দুই হাতে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে যেন আর কেউ বাসে ওঠার সুযোগ না পায়—একটা পাখিকে নিজের করে পাবার জন্য লোকগুলি এখন তাই করছে। একটা বাগানকে যেন ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে চাইছে কতগুলি কোদাল। দৃশ্যটা আমার কাছে ভালো লাগল না, তাই দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে চাইলাম। যদিও আমারও ইচ্ছা করছিল ওই ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা পাখিকে ছিনিয়ে নিতে—কিন্তু কেন যেন আমার মনে হলো একটা পাখি শেষ পর্যন্ত আমিও পাব। এখন একটু ধৈর্য ধরে ভিড়ের প্রাথমিক ঢেউগুলিকে বয়ে যেতে দিতে হবে। তারপর সমুদ্র কিছুটা শান্ত হলে আমার প্রাপ্তির নৌকা ভাসাব আমি। তখনও হয়ত কিছুটা ভিড় থাকবে, কিছু কেনা, ঢেউয়ের কিছু নতুন শিশু—কিন্তু সেই সমুদ্রে সাঁতার কাটার সময় আমার খুব একটা পরিশ্রম হবে না।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম একেকজন একেকটা পাখি ধরছে আর ঝলমলে মুখে ফিরে যাচ্ছে নিজের বাসায়। ভিড়ের শরীর থেকে খসে পড়ছে বাড়তি মেদ মাংস, স্থূলতা বদলে যাচ্ছে সূক্ষ্মতায়। গৃহিণীভিড় যেন ধীরে ধীরে হয়ে যাচ্ছে ফ্যাশন সুন্দরী। কমে আসছে চেঁচামেচির গলার জোর। কিন্তু খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে বেশ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মনে হলো শুরুতে যে লক্ষ লক্ষ পাখি ছিল ওখানে—এতগুলি লোক এতগুলি পাখি নিয়ে যাবার পরও সংখ্যায় তারা একটিও যেন কমেনি। এখনও উড়ছে ঘুরছে ছটফট করছে তারা। এখনো খাঁচায় সারাটা শরীর ঝলমলে, চঞ্চল, পালকবহুল। ভিড়ের চেঁচামেচি কমে গেলেও খাঁচার শব্দ বেড়ে চলেছে আরও। সেই সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া একটানা শব্দটা এখন যেন জলপ্রপাতের মত এসে পড়েছে আমার কানে। কিন্তু খাঁচার ভিতরে এত পাখি থাকার পরেও খাঁচার  নিচে এক ফোঁটা বিষ্ঠা কোথাও পড়ে নেই। নেই পালকের এক অণু বুনোগন্ধ। অথচ পাখি বিক্রির দোকানগুলোতে এর চেয়েও কত কম পাখি থাকে কিন্তু বিষ্ঠা আর পালকে ভরে থাকে দোকান। বিষয়টা পাখিদের উৎস সম্বন্ধে অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য করল আমাকে। মনে হলো এরা বনের পাখি না। কিন্তু আকাশ থেকে নেমে আসা এই পাখিদের ঈশ্বরের পাখি ভাবতেও পারছিলাম না একাবিংশ শতাব্দীর চাপে। আর পৃথিবীর সব ঈশ্বরের পাখির তো পুরীষ থাকে, গন্ধ থাকে। ফলে হঠাৎ আমার মনে হলো এইসব পাখি কোনও গবেষণাগারে তৈরি কৃত্রিম যন্ত্র বোধহয়। কিন্তু যারা পাখি পেয়েছে—তাদের মুখ দেখে তো মনে হয় পাখিগুলি পালকে পাখাতেই নির্মিত। তাহলে রহস্যটা কী? না—একটা পাখিকে এখন আমার হাতে নিয়ে দেখতেই হচ্ছে। হাতে নিয়ে, চোখের কাছে নিয়ে, অনুভূতির সবগুলি দরজা খুলে দিয়ে আমি পাখিটাকে দেখব ঠিক একটা মেয়ে মানুষের নগ্নতার মত।

ভিড়টা এখন যেন ভিড়ের কঙ্কাল। হাড় মাংস-মেদ-মজ্জা-শিরা-উপশিরা সব ক্ষয়ে গেছে। শুধু এখনও পাখি না পাওয়া কিছু লোক এবং সব শেষ হয়ে গেলেও যাদের কৌতূহল মেটে না—অনাবশ্যকভাবে দাঁড়িয়ে থাকে অবশিষ্ট আরও কী যেন দেখবে বলে—তাদেরকেই দেখা যাচ্ছে খাঁচাটার চারপাশে। খাঁচাটা এখন আরও নিচে নেমে এসেছে—একেবারে মাটি ছুঁই ছুঁই অবস্থা। যেভাবে সে নামছে তাতে মনে হয় নামতে নামতে একসময় সে মাটির নিচে চলে যাবে। আকাশ থেকে এসে আমাদের মর্ত্যভূমিতে কিছুটা সময় আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে সে আবার অন্তর্হিত হবে উল্টা আকাশের ভিতরে। মাটিকে আমার ওই উল্টা আকাশই মনে হয়। অক্ষরেখার নিচের ধনাত্মক বিন্দুর মত তাকে মনে হয় নেগেটিভ আকাশ। আর পৃথিবীটা যেহেতু একটা গোল বল এবং সে ঘুরছে—তাই রাতে যে আকাশটা মাথার উপরে থাকে—দিনে সেটা পায়ের নিচে চলে তো যায়ই। চারদিকে আকাশ থাকলে এই এক জ্বালা। যে কোনও দিকেই তাকে দেখা যায়। ডান-বাম-উর্ধ্ব-অর্ধ-ঈশান-নৈঋত—সব দিকেই তার নীল হাসিমাখা মুখ ঝলমল করে। যেন একটা সেলুন—যে দিকেই তাকাই মুখ, পেট, ঘাড়, পিঠ দেখা যায় সারাক্ষণ। এমনকি চোখ বন্ধ করে রাখলেও যেন না দেখার হাত থেকে রেহাই নেই। সেই সেলুনেও ওই অনাবশ্যক লোকগুলির দেখা পাওয়া যা। হয়ত সেলুনটার পাশের বাসাতেই সে থাকে, হয়ত বাসা থেকে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে বেরিয়েছে সে—তারপরও সেলুনটার সামনে এলে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিতে চাইবে সে। নাপিতের কাছ থেকে চিরুণী নিয়ে আরেকবার আঁচড়াবে চুল এবং তারপর সেলুনের কাজ শেষ হয়ে গেলে টেলিভিশন বিক্রির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকবে যা দেখাচ্ছে—তাই। বিজ্ঞাপন-খেলা-গান-সিনেমা-খবর-দৃশ্যহীন নীল পর্দা-কিছুতেই আপত্তি নেই তার।

এখনও খাঁচাটার পাশে নিজের হাতে একটা পাখি নিয়ে দাঁড়িয়ে ওই অনাবশ্যক লোকটি দেখছে। দেখছে মানে তাকিয়ে আছে। কী দেখছে জিজ্ঞসা করলে অর্থহীন ঘোলা চোখে সে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকবে প্রশ্নকর্তার দিকে। তারপর বলার মত কিছু না থাকায় আবার চোখ ফিরিয়ে দেখতে থাকবে। প্রাণীকুলে প্রতিটি প্রাণীরই নাকি ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে প্রকৃতি। এদের বোধহয় তাকিয়ে থাকাটাই কাজ। আমি মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে ভাবি এদের অন্ন জোটে কোত্থেকে। এইসব তাকিয়েদের কাউকেই আমি দেখিনি—যার স্বাস্থ্য খারাপ। তাকিয়ার মতই মোটাসোটা এই সব তাকিয়েরা। এবং অপমানজ্ঞান এদের এত প্রখর যে, কোনও একটা টেলিভিশনের দোকান এদের দূরদূর করে তাড়িয়ে দিলেই তৎক্ষনাৎ এরা চলে যায় এবং আরেকটা টেলিভিশনের দোকানে গিয়ে ভিড় জমায়।

এইসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দেখলাম খাঁচার নিচের অংশ সত্যি সত্যিই মাটির নিচে ঢুকে গেছে। আর হয়ত মাত্র কয়েক মিনিট, তারপরই চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া কোনও কিছুর মত সেও হারিয়ে যাবে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সাথে সাথে আমি এগিয়ে গেলাম খাঁচাটার দিকে। একটা টেলিভিশনের দোকানের মত দূরদূর করে তাড়ালাম অনাবশ্যক দর্শকদের। তারপর খাঁচাটার শিকের ভিতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম হাত—একটা পাখিকে ধরার জন্য। কিন্তু কোনও পাখিকে আমার ধরতে হলো না। লক্ষ লক্ষ কিচমিচ করা ঝলমলে পালকের ছটফটে পাখিগুলির ভিতর থেকে একটা পাখি উড়ে এসে বসল আমার হাতে। তার বসার ভঙ্গিটা এত আন্তরিক যে, মনে হলো পাখিটার সাথে দীর্ঘ একটা বন্ধুত্ব আমার আছে। এতদিন সে যেন হারিয়ে ছিল পাখিগুলির ওই ভিড়ে। এখন আমি হাত বাড়াতেই সেই হাতের গন্ধ পেয়ে সে চিনতে পেরেছে আমাকে। অন্য আরও দু’একজন যারা হাত ঢুকিয়েছিল খাঁচায়—তাদের হাতেও ঠিক ওইভাবেই উড়ে এসে বসল তাদের পাখিগুলি। তাকিয়ে থাকল মিলিত হবার আনন্দ।

আমার পাখিটাকে তাড়াতাড়ি খাঁচা থেকে বের করে নিয়ে ছুটে গেলাম বাসার দিকে। তারপর নিজের ঘরে এসে যেই ঢুকলাম, অমনি পাখিটা হাত থেকে উড়ে গিয়ে বসল একটা আলমারির ওপর। ঘরের জানালাটা খোলা নেই তো? কিন্তু পাখিটার আমার কাছে আসার আগ্রহ, ঘরে ঢুকেই নিজের জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে পড়া—পাখিটার পালিয়ে যাবার কথা আমাকে ভাবতেই দিল না। আমাদের পাড়ায় বাকি সব লোকেরা যে পাখিগুলি ধরেছে—তাদের কোনও একটা যদি পালাতো তাহলে এতক্ষণে সামান্য হলেও একটা শোরগোল শুনতে পেতাম কোথাও। কিন্তু সারাটা পাড়া এত নিশ্চুপ আর মনোযোগী হয়ে আছে যে, পাখি উড়ে পালানোর ব্যাপারটা অসম্ভব বলেই মনে হলো। আর যদি পালায়ও খাঁচাটা তো আছেই—ওখান থেকে আরেকটা পাখিকে না হয় ধরে আনব। সারা পাড়ার সবগুলি বাড়িতে প্রত্যেকটা লোকের কাছে যে পাখিটা আছে—সেটা আমার কাছ থেকে পালাবে কেন? এইসব ভাবতে ভাবতে জানালাটার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম খাঁচাটা যেখানে ছিল, ভিড় ছিল—সেই জায়গাটা শূন্য একটা উঠানের মত পড়ে আছে। খাঁচা নেই, পাখিগুলি নেই, ঝলমলে পালকের বাহারি রঙ নেই, শব্দ নেই, মানুষের হুটাপুটি নেই—এসব যেন সেখানে ছিল না কোনদিন।

দৃশ্যটা দেখেই পাখিটার পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা আবার ফিরে  এলো মাথায়।   সাথে সাথেই জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। দরজাটাকে আটকালাম জেদ ধরা শিশুর বন্ধ করা চোয়ালের মত। ঠিক করলাম আগামীকালই একটা খাঁচা কিনতে হবে পাখিটাকে সেখানে আটকে রাখার জন্য। তারপর পাখিটার দিকে চাইতেই দেখলাম বেনারসির মত ঝলমলে পালকের পোশাক খুলে সে একটা ঘরে পরিধেয় সাদামাটা ম্যাক্সি পরে আছে। ঢিলেঢালা ফাঁক ফোকড়ে ভরা সেই ম্যাক্সির বিভিন্ন জানালায় দেখা যাচ্ছে তার উদগ্র শরীরের লালাভ লোভী মাংস। আমার খুব ইচ্ছা করছিল এখনই দাঁত বসিয়ে দেই ওই লাল মাংসের স্তূপে। তাই হাত বাড়িয়ে যেই পাখিটাকে ধরতে গেলাম, ওমনি পাখিটা মানুষের গলায় বলে উঠল, ‘বাতিটা আগে নেভাও। ’

তিন.
পরদিন সকালে প্রচণ্ড হৈচৈ-এ শব্দে ঘুম ভাঙল আমার। সারাটা পাড়ায় যেন শব্দরাই শুধু থাকে—এইরকম মনে হলো শব্দের প্রচণ্ডতায়। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হলাম ব্যাপারটা কী—জানার জন্য। গিয়ে দেখলাম গতরাতে ঝলমলে চঞ্চল অপরূপ পাখিদের চিৎকার বনে যাওয়া লোকগুলি নিজ নিজ বাসার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে জানাচ্ছে এক অদ্ভুত খবর। সকালে ঘুম থেকে উঠে তাদের প্রত্যেকেই নাকি আবিষ্কার করেছে তাদের পাখিগুলি সব আরশোলা হয়ে গেছে। খবরটা শুনেই আমিও লাফিয়ে ঘরে ঢুকলাম আমার পাখিটাকে দেখার জন্য। আর গিয়ে দেখলাম বেনারসির মত পালক পড়ে আছে যথাস্থানে এবং আমার বিছানায় ঘরে পরবার সাদামাটা ম্যাক্সিটার ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা লাল ঘিনঘিনে আরশোলা।



বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।