ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

রাজার খাস মহালে জংগল ট্যুর | মঈনুস সুলতান

ভ্রমণ ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৬
রাজার খাস মহালে জংগল ট্যুর | মঈনুস সুলতান

জংগল ট্যুরের নাম করে আমি ও আমার ভ্রমণ-সঙ্গী নৃত্যশিল্পী নাকাতুলে নেমে আসি পাহাড়ের ঢালে। কিন্তু এদিকে জংগল কোথায়? আফ্রিকার ছোট্ট রাজ্য লিসোটোতে আমরা খানিকটা আওয়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছি।

দেশটি শাসন করছেন একজন রাজা। তার খাস মহালে ঝোপঝাড় সামান্য আছে বটে, তবে সর্বত্র নানা আকারের শিলার গায়ে লেগে আছে সাদাটে পাথরের স্তর। ট্র্যাকস্যুট পরা নাকাতুলে অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছে। তার হিপে ক্লিপ দিয়ে ঝোলানো সিডি ওয়াকম্যান। কানে ইয়ারফোন গোঁজা, ঠিক বুঝতে পারি না মেয়েটি কী ধরনের গান শুনছে। ড্রাইভার আমাদের জংগল ট্যুরের জন্য এখানে নামিয়ে দিয়েছেন। তিনি রিসোর্টের বাংলোতে গাড়ি পার্ক করে জিরাবেন। কথা হয়েছে—আমি ও নাকাতুলে ট্যুর-গাইড মাকগথলা মাবইয়ের তদারকিতে মাইল তিনেকের জংগল পরিক্রমা পায়ে হেঁটে সেরে ঘুর-পথে গিয়ে উঠব বাংলোতে।



ডু ইউ নট রিমেমবার আমি তোমাকে ফুটপাত থেকে কমলা কিনে দিয়েছিলাম?’ এবার ফিচেল হেসে ‘দেন হোয়াট’ বলে সে আমার দিকে তাকালে, আমি বলি, ‘ইট ওয়াজ অ্যা নাইস সুইট ফ্রেঞ্চ কিস, তোমার জিহ্বায় লেগেছিল কমলালেবুর তাজা গন্ধ, ডু ইউ ওয়ান্ট ডু ইট এগেইন তুলিকা?’ ‘ওহ্ ইয়েস’ বলে সে কাছে আসলে আমি অনুভব করি তার পূর্ণ ঠোঁটে লেগে আছে কাজু বাদামের গুড়া



নাকাতুলে হাঁটতে হাঁটতে বাঁকা হয়ে চকচকে নুড়িপাথর কুড়িয়ে নিয়ে পরখ করে তা ছুঁড়ে দিচ্ছে সাদা পাথরের চাকলায়। যেতে যেতে আমাদের পথপার্শ্ব ভরে ওঠে ম্লান ফিকে সবুজাভ বাদমি ঘাসে। এ প্রান্তরের শেষে এককালে ছিল রাজার ইটে গড়া কটেজ। অনেক বছর তা ব্যবহার হয়নি, তাই দালান ধসে পড়ে শুধু দেয়ালের খানিকটা অংশ দাঁড়িয়ে আছে আকাশের তলায়। তার সামনে ঘাস খাচ্ছে তিনটি রাজকীয় অশ্ব। এদের একটি শ্বেতকায় ও অন্যটি লালেসাদায় চিত্রাপকরা। আরেকটি মারকুটে কিসিমের ঘোড়া আমাদের দেখতে পেয়ে বিরক্ত হয়ে চিঁ হি হি করে লেজ মুছড়ায়। ট্যুর-গাইড মাকগাথলা তার দিকে তাকিয়ে ‘চো-য়া-প চো-য়া-প’ আওয়াজ তুলে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানান। এদের ছাড়িয়ে সামনে যেতেই আমি দাঁড়িয়ে পড়ে নাকাতুলের মাধ্যমে জানতে চাই, ‘মাকগথলা, আপনি এরকম বিতিকিচ্ছিরিভাবে খোঁড়াচ্ছেন কেন?’ তিনি কোমর বাঁকা করে যেন ঢেঁকি পাড় দিতে দিতে আগ বাড়ছেন। আমার সওয়াল শুনতে পেয়ে থেমে পড়ে মাবই বেশ ইলাবরেটলি জবাব দেন। নাকাতুলের অনুবাদে বুঝতে পারি—জংগলের এদিকে আছে রাজার খাস গোচারণভূমি। মাকগথলা কিশোর বয়সে ওখানে রাখালের কাজ করতেন। কাছের দেশ সোয়াজিল্যান্ডের রাজা লিসোটোর মহারাজকে পাঠান একটি শক্তপোক্ত ষাড়। মাকগথলার ওপর দায়িত্ব পড়ে ষণ্ডটির দেখভালের। রাজকর্মচারীরা যুবক বয়সি সোয়াজি ষাড়ের জন্য হন্যে হয়ে জোড় খুঁজছেন। প্রজাতি, ব্রিড ইত্যাদি মিলিয়ে সহজে যথাযোগ্য পাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ষাড়টি যথাসময়ে গাভি না পাওয়ায় ত্যাক্তবিরক্ত হচ্ছে। একদিন ক্ষেপে গিয়ে সে রাখাল মাকগথলাকে শিং দিয়ে চেপে পেড়ে ফেলে মাটিতে। তিনি প্রাণে বেঁচে যান তবে কোমরে বেদম আঘাত পান। সুস্থ হলে রাজ-আদেশে তাকে রাখালির দ্বায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। সে অব্দি তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। ট্যুর গ্রুপ নিয়ে তিনি রাজার মহালে আসেন বটে, তবে গোখামার থেকে সহস্র হস্ত দূরে থাকেন। গণ্ডার ফন্ডারে তার তেমন ভীতি নেই, তবে সোয়াজি ষাণ্ডটি বড়ই বেতমিজ। মাকগথলা মাবই তার সাক্ষাতে পড়তে চান না। এ পর্যন্ত বিস্তারিত বয়ান দিয়ে তিনি আবার ঢেঁকি পাড়ের কায়দায় সামনে বাড়েন। আমরাও তাকে অনুসরণ করি।

ঘাস খাচ্ছে রাজকীয় অশ্ব

চলে আসি কাঁটাগাছে নিবিড় আরেকটি উপত্যকায়। খুব আয়েশি চালে আমরা হাঁটছি। হঠাৎ করে দেখি দাঁতাল এক হাতি শুঁড়ে তুলে নিচ্ছে ঘাসপাতা। বুনোহাতি দেখে আমার তো হালত খারাপ হয়ে যায়। আতঙ্কে গাছে চড়ে বসতে বাসনা হয়। নাকাতুলে খিলখিল করে হেসে কোমর বাঁকা করে দাঁড়িয়ে হাতির দিকে হাত নাড়ে। মাকগথলা মাবই দোঁতো হাসি হেসে আমাকে আশ্বস্ত করেন, ‘মিস্টার, এ হচ্ছে রাজ মহালের নিজস্ব হাতি, আমার পরিচিত, একে ভয় পাওয়ার কী আছে?’ বলে কাছাকাছি গিয়ে গজরাজকে ‘তোরো ইয়াকা’ সম্বোধন করে গড় হয়ে প্রণতি জানান। হাতিটি তাকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না। নীরবে ঘাসপাতা খেতে খেতে ত্যাগ করে বিপুল পরিমাণে নাদি। মাকগথলা গদগদ হয়ে বলেন, ‘তোরো ইয়াকা আমাদের মহারাজার সমবয়সী। সাউথ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ বুয়াররা তার মা-কে রাইফেল দিয়ে শুট করে কেটে নিয়ে যায় আইভরি। রাজ পরিবার তখন কটেজে অবসর কাটাচ্ছিলেন। শিশু-হাতিটি তার আঙ্গিনায় এসে খাবার প্রার্থনা করে। রাজকন্যা নিজ হাতে তাকে এক ঝুড়ি সব্জি খেতে দিয়ে নাম দেন তোরো ইয়াকা বা মাই ড্রিম। হাতিটি মাঝে সাজে একটু আধটু ড্রিংক করতে ভালোবাসে। বিলাতের রানি এলিজাবেথের নাতি প্রিন্স হ্যারি আমাদের রাজপুত্রের মেহমান হয়ে এখানে এসে তাঁবু খাটান। তোরো ইয়াকার সাথে তার জবর অন্তরঙ্গতা হয়। তিনি তাকে ফায়ার ওয়াটার বলে পরিচিত এক গামলা মামপোর পান করতে দেন। তা চেটেপুটে খেয়ে হাতিটি এত তুষ্ট হয় যে-সে বিলাতের রাজকুমারকে শুঁড় তুলে স্যালুট জানায়। ’ হাতি সম্পর্কে এ্যয়সা লম্বা চওড়া এবারত শোনার পর হস্তিমূর্খের মতো হে হে হেসে তাকে জবরদস্থ রকমের রয়েল স্যালুয়েট দিয়ে আমরা  আবার পা চালাই।

পাহাড়ে সাদা পাথরের স্তর

খুব একমনে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঘাস এদিকে নিবিড় হয়ে ঢেকে দিয়েছে পাথুরে আস্তরণ। যেতে যেতে মাকগথলা ‘সেরুরুবেলে সেরুরুবেলে’ বলে চেঁচামেচি করে ওঠেন। শব্দটি বুঝতে না পেরে জানতে চাই—বিষয় কী? নাকাতুলে ফিসিফিসিয়ে বলে, ‘লুক এ্যাট অল দিজ বাটারফ্লাইজ্। ’ কিন্তু প্রজাপতি কোথায়? ঘাসে মনে হয় ফুটে আছে বেশ কিছু থোকা থোকা সাদাটে রুপালি ফুল। নিরিখ করে তাকাতেই বুঝতে পারি—ফুল নয় সাদা প্রজাপতিগুলো নাড়ছে রুপার ফুটকি দেয়া তাদের নরোম ডানা। প্রচুর শুয়োপোকা জন্মে বলে এ ধরনের ঘাসকে বলা হয় কেটারপিলার গ্রাস। প্রজাপতিদের মৃদুমন্দ ওড়াউড়িতে স্থানটিতে এসেছে পরির দেশের অলিক ব্যঞ্জনা।

এ মায়াবি রাজ্য পেরিয়ে যেতেই রোদে ঝলমল করে ওঠে আকাশ। মাকগথলা আমাদের আশ্চর্য একটি গাছ দেখান। এ কাঁটা গাছে উপনিবেশ গড়েছে কয়েক শত উইভার বার্ড বা নীড় বোনায় দক্ষ এক ধরনের পাখি। তাদের কলোনিটি মনোযোগ দিয়ে দেখার মতো। অনেকগুলো নীড়ের বিশাল এ উপনিবেশকে শিল্পিত কেতায় তৈরি ট্রি হাউসের মতো দেখায়। বিশেষ একটি পরিপেক্ষিতে পাখিদের এ সাতমহলা ঘরটিকে দেখায় মরুভূমিতে বসে থাকা কঁকুদঅলা উটের মতো। মাকগথলা তার তলায় সটান বসে পড়ে পাইপে তামাক ধরান।


রাজহস্তী তোরো ইয়াকা

নাকাতুলে অরেঞ্জ জুসের প্যাকেট ছিড়ে আমাকে—‘একটু জরুরি কথা আছে’ বলে নিয়ে আসে অন্য আরো কয়েকটি কাঁটাগাছের আবডালে। বিষয় কী—জানতে চাইলে সে কাজুবাদামের একটি প্যাকেট ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে, ‘জাস্ট অপেন ইয়োর মাউথ। ’ সাথে সাথে আমার মুখ গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয় ছিটাগুলির মতো বাদামের সুস্বাদু গোলা। সে এবার জানতে চায়, ‘ডু ইউ রিমেমবার.. গেল বছর ফ্রেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে কবি বাৎজিলির সাথে আমরা জিম্বাবুয়ের কামি রুয়িনে গিয়েছিলাম শত বছর আগের আফ্রিকান রাজাদের প্রাসাদের ধংসস্তূপ দেখতে?’ ঘটনাটি সাথে সাথে বয়োস্কোপের ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ভেসে ওঠে আমার মনে। ধংসস্তূপের পাশের একটি বটোল-শপে ঢুকে কবি বাৎজিলি পান করেন প্রচুর পরিমাণে ‘চিকোকিহানা’ নামে এক ধরনের অত্যন্ত কড়া মুনসাইন জাতীয় অ্যালকোহল। এর সাথে পাইপে অল্প একটু ‘দাকখা’ সেবন করলে খুব দ্রুত বেহেড হয়ে কবিতার চরণ জপতে জপতে তিনি বার কাউন্টারে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। নাকাতুলে জানতে চায়, ‘ডু ইউ রিমেমবার, তুমি আকাশে রঙধনু দেখা যাচ্ছে এ রকম ডাহা মিথ্যা বলে আমাকে বাইরে নিয়ে এসেছিলে?’ আমি জবাব দেই, ‘আমি সামান্য মিথ্যা বলে তোমাকে রেসকিউ করেছিলাম ডিপ্রেসিং সিচ্যুয়েশন থেকে, ডু ইউ নট রিমেমবার আমি তোমাকে ফুটপাত থেকে কমলা কিনে দিয়েছিলাম?’ এবার ফিচেল হেসে ‘দেন হোয়াট’ বলে সে আমার দিকে তাকালে, আমি বলি, ‘ইট ওয়াজ অ্যা নাইস সুইট ফ্রেঞ্চ কিস, তোমার জিহ্বায় লেগেছিল কমলালেবুর তাজা গন্ধ, ডু ইউ ওয়ান্ট ডু ইট এগেইন তুলিকা?’ ‘ওহ্ ইয়েস’ বলে সে কাছে আসলে আমি অনুভব করি তার পূর্ণ ঠোঁটে লেগে আছে কাজু বাদামের গুড়া।


উইভার বার্ডের উপনিবেশ

আমাদের জংগল ভ্রমণ শেষ হতে চলে। বিকাল এখনো গড়িয়ে যায়নি, হাতে সময় আছে প্রচুর। আস্তে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বাংলোর বিষয়টি নাকাতুলে বুঝিয়ে বলে। পর্যটনের ছোট্ট এ স্থাপনাটি চালাচ্ছেন সাউথ আফ্রিকার বয়োবৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গ বুয়ার সম্প্রদায়ের এক কাপোল। কামরার ভাড়া থেকে ডিনার ব্রেকফার্স্ট সমস্ত কিছুর খরচাদি নাকাতুলের পেট্রোন ও সুহৃদ ডক্টর ইনগ্রাম-হিল অ্যাডভান্স পে করে দিয়েছেন। আমাকে কোনো কিছুর জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি মুখে কিছু বলি না বটে, তবে নিজেকে খুব ডিপ্রাইভড্ লাগে। মনে হয় এ ট্যুরের কোনো কিছুতে আমার কোনো অংশগ্রহণ নেই।


দুই শিংগালের লড়াই

বাংলোর কাছাকাছি জংগলে গাছপালা খানিকটা ঘন হয়ে উঠেছে। আমরা দীর্ঘ ঘাস মাড়িয়ে উঠে যাচ্ছি পাহাড়ের রিজে। নিচে ঝোপঝাড়ে শুকনা পাতা মাড়িয়ে দৌড়-ঝাপ ও ছোটাছুটির শব্দ শোনা যায়। আর্তনাদ করে ওঠে একটি হরিণ। আমরা ঘুরে দাঁড়াই। দেখি—নিচে খুরে দীর্ঘ ঘাস আউলামাড়া করে শিংয়ে শিং ঠেকিয়ে মরণপণ যুঝছে দুই মর্দা হরিণ। তাদের খুলির ঠোকাঠুকির স্পষ্ট আওয়াজ শোনা যায়। শিংগাল দুটি মারপ্যাচের কায়দায় একে অপরের তলপেটের নরম মাংসে শিং বিঁধিয়ে দেয়ার সুযোগ খোঁজে। বুঝতে পারি—নিশ্চয় ঝোপঝাড়ের আবডালে দাঁড়িয়ে মাদি কোনো হরিণ দেখছে মর্দাদের শিং ঠোকাঠুকির তামশা। এদের হিংস্রতা মানুষদের অসুয়া প্রবণতাকে হার মানায়। বাংলোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি—আমার ভেতরে নীরবে ধোঁয়াচ্ছে ডক্টর ইনগ্রাম-হিলের প্রতি যে হিংসা, ঠোকাঠুকি করার মওকা পেলে হয়তো এ পোড়ানি থেকে ত্রাণ পাওয়া যেত।



বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।