‘বুকের বোতাম খুলে কী যে নিয়ে গেলে তুমি/সেই থেকে প্রতীক্ষা আমার’ (প্রতীক্ষা প্রহর)-পড়তে পড়তে মনে হবে কবি বোধ হয় প্রথম যৌবনে। এখনো প্রেমিকার সঙ্গে বিকেলে পার্কের ঘাসে বসে খোসা খসিয়ে বাদাম চিবান, তারপর দিনশেষে রাতের বেলায় লিখতে বসেন-
‘শুধু তোমাকে বুঝব বলেই
ধারালো করাতে পা রেখে আজো পথ চলা
মুনিঋষির বিবরে ডুব দিয়ে খুঁজছি আমি-
আমার আরাধ্য শুধু নারী অভিধান।
আবার যখন তিনি লিখেন- ‘আদিরসে চেয়ে দ্যাখো/আজো আসন তোমার সেই যুবকের ছায়ায়’ - (পারো যদি পোড়াও) মনে হবে বিরহ-কাতর এক যুবকের আর্তি। অন্যদিকে প্রেমিকার ওপর জোর খাটাতেও তিনি পিছপা নন, ‘প্রেম মানে দখলিসত্বে নিয়ে নেওয়া, এবং আমিও স্বপ্ন দেখি তোমাকে নিয়ে’ (প্রেম)।
কবি লিখে থাকেন তার জীবনে লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে, যা তার নিজ জীবনের গল্প নাও হতে পারে। কবি লিখেন তার চারপাশ, সময় এবং বদলে যাওয়া ঠিকানা নিয়ে। কবিতা সত্য বলে। কবিতা মানুষের কথা বলে। তাই কবিতাতে প্রেম থাকে, আবার একই সমান্তরালে বিরহও, থাকে বিচ্ছেদ-বেদনা। থাকে রাজনীতি, সমাজ, এবং সমাজের বহুবিধ উপাদান। কবিতায় থাকে মানুষের চিরায়ত আত্ম-অনুসন্ধান এবং জন্ম-মৃত্যু ভাবনা। সব ধরনের ব্যাপ্তিতে আলোতে অন্ধকারে কবি খুঁজতে থাকেন হিরন্ময় শব্দমালা, সত্য প্রকাশের তাগিদে।
‘সূর্যের ঘরের নামতাতে’ শুধুমাত্র নর-নারীর প্রেম বিষয়ই নয়, বরং এতে প্রস্ফুটিত হয়েছে যাপিত জীবনে কবিমনের বহুমাত্রিক চিন্তা-চেতনা।
সমাজে নিপীড়কের বিরুদ্ধে নিপীড়িত যখন ঈশ্বরের কাছে অসহায় ফরিয়াদ জানায় তখন কবি সংশয়ী হয়ে ওঠেন-
‘অসহায় লোকটি অতঃপর আকাশে তাকান,
‘আল্লাহ, তুমি এর বিচার করো’
........................................................
........................................................
ইতোমধ্যেই বসন্তবায়ু বইতে শুরু করেছে জালিমের আঙ্গিনায়
আমরা অপেক্ষাতে ...
আরশের নির্দেশ কখন, কীভাবে নেমে আসে
কিংবা আদৌ আসবে কি না!’ (সংশয়)
নারী মুক্তির কথাও ভাবেন কবি। তাই তার কবিতায় অনিবার্যভাবে পৌরাণিক নারী লিলিথ চলে আসে। আমরা শুনি তার আক্ষেপ-
‘হে আদমকন্যা, কী করে বুঝবে তাকে আজ
তুমি তো আর লিলিথের আত্মজা নও
নিতান্তই তুমি ইভের দুহিতা, আদমের বাঁ-পাঁজর’ (লিলিথ)
ক্ষয়ে যাওয়া বর্তমান নষ্ট সমাজ পরিবর্তন করার কথা তাগিদ কবি অনুভব করেন, এবং মনে করেন সংস্কারের মাধ্যমে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না, এজন্য প্রয়োজন রক্তাক্ত বিপ্লব যা একদিন আসবেই। ‘প্রগতি ভবন’ কবিতায় তাই তার উচ্চারণ, ‘অনিবার্য ভবিতব্য-/ উঁকি মারছে রক্তাক্ত প্রান্তর/ধ্বংসের ভিতেই গড়ে ওঠে প্রগতি ভবন’ (প্রগতি ভবন)
পুঁজিবাদী সমাজের আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েও কবি ভাবিত হোন। পুঁজির কাছে সবই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, এমনকি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উপকরণগুলোও। তাই ‘চে বিকোয় কত ডলার হে’ কবিতায় কবির তীর্যক বান,- ‘মুক্তবাজারে খাসা পণ্য বটে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো!’
৭১ আমাদের কন্টেন্ট। আমাদের অহং। সময় এখন অস্থির দোলাচলে। দুর্ভাগ্য আমাদের, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যাশিত ফল এখনো আমরা পাইনি। লুটেরা গোষ্ঠীর দখলে চলে গেছে সবকিছু। আমজনতার মুক্তি এখনো সুদূর পরাহত। তাই কবি বলেন–
‘মুখোশে মুখোশে ঢাকা অভাগা এ দেশ
বেনিয়া লুটেরা বড়ই ঘড়েল
তিলে তিলে খেয়ে চলেছে মুক্তির সনদ …
একাত্তর আদৌ হয়েছে কি শেষ !’- (একাত্তরের গল্প)
জীবন জিজ্ঞাসা কবীরের কবিতার আরেক উপজীব্য। এ গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতায় দার্শনিক চিন্তার আভাস পাওয়া যায়। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মানুষ ‘নিজেকে জানো’ ভাবনায় নিমগ্ন হয়, উদগ্রীব হয় উৎস খুঁজতে । কবীরও ব্যতিক্রম নন। তাই তার কবিতার জিজ্ঞাস্য- ‘ঢেউ গুনতে গুনতে এলোমেলো হয়ে গেছে ধারাপাত, উজান ঠেলে কতদূরেই গেলে বা/ উৎস ছোঁয়া যায়!’ (কাঁচুলির মায়ায়)
এবার আসা যাক কবীরের কবিতার প্রকৃতি এবং আঙ্গিক প্রসঙ্গে। মূলত অক্ষরবৃত্তে লেখা কবিতাগুলো; কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটলেও কবিতার স্বাভাবিক প্রবহমানতা বিনষ্ট হয়নি। ছোটো ক্যানভাসে লেখা কবিতাগুলো মেদহীন হলেও ইঙ্গিতময়তার কমতি নেই। কবিতাগুলো পাঠ করে প্রকাশকের মত (ফ্ল্যাপের লেখা দ্রষ্টব্য) আমারও মনে হয়েছে এ যেন বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন। আকৃতিতে ছোটো হলেও প্রকৃতিতে গভীর হওয়ায় পাঠককে ভাবনার অতলে নিয়ে যায়। সম্ভবত এখানেই কবির মুন্সিয়ানা।
সব মিলিয়ে কবি মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীরের ‘সূর্যের ঘরের নামতাতে’ পাঠকের মনোজগতে জীবনের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ আলোড়ন তুলবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
প্রকাশক - অনুপ্রাণন প্রকাশন
প্রকাশকাল - জানুয়ারি, ২০২০
প্রচ্ছদ - কাব্য কারিম
কনকর্ড এম্পোরিয়াল শপিং কমপ্লেক্স
কাঁটাবন , ঢাকা -১২০৫
অনলাইনেও বইটি পাওয়া যাচ্ছে –ওয়েব সাইট - https://www.anupranon.com
মূল্য -১৬০ টাকা
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি কবি ও সাহিত্য সমালোচক। বর্তমানে ফ্রান্সে বাস করেন।
ইমেইল- [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২১
এএটি