ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

পুরস্কার পেয়ে আনন্দে কেউ হেসেছেন, কেউ কেঁদেছেন

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, ফিচার রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০২২
পুরস্কার পেয়ে আনন্দে কেউ হেসেছেন, কেউ কেঁদেছেন

ঢাকা: প্রাপ্তির প্রত্যাশায় তারা কেউই লেখেন না। তবুও প্রাপ্তিযোগ হলে ভালো লাগে, আনন্দ অনুভূত হয়।

সেই আনন্দে কেউ হেসেছেন, কেউ কেঁদে ফেলেছেন। সেরা কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তিতে তারকা লেখকরা জানিয়েছেন সেই অনুভূতি।  

রোববার (২৩ জানুয়ারি) বাংলা একাডেমি ষোষণা করে এ পুরস্কার। তারপরই বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত লেখকদের অনেকের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

পান্না কায়সার:
নিজের পরিচয় নিজেই তৈরি করেছেন লেখক পান্না কায়সার। তবুও তিনি পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন- তার স্বামীর নাম শহীদুল্লা কায়সার। ১৯৬৯ সালে শহীদুল্লা কায়সারকে বিয়ে করেন তিনি। এরপর ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আলবদর বাহিনীর কয়েকজন সদস্য শহীদুল্লা কায়সারকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর ফেরেননি। সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন এ নারী। মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণাকে ধারণ করে লিখতে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গবেষণা। সে ক্ষেত্রেই এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন।

কথা হলে পান্না কায়সার বাংলানিউজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমার প্রেরণা। যুদ্ধের সময় মুক্তি চলে এসেছে; মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করলাম কয়েকদিন আগে। আমিও আমার স্বামীর সঙ্গে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি একইসঙ্গে।

একটু ধরা গলায় তিনি বলেন, দীর্ঘ একটা সময় আমার ধ্যান, আমার জ্ঞান, ওর সঙ্গে আমার জীবন যাপন, আমি একীভূত হয়ে আবিষ্কার করেছি। যখন আমি ওকে হারিয়েছি, আমার সামনে আমি নতুন একটা জগৎ দেখতে পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা আমার দায়িত্ব। এ প্রেক্ষাপট থেকে আমি যখনই কলম ধরি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টা চলে আসে নানাভাবে।

বহুল আলোচিত গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধ আগে ও পরে’র এ লেখক বলেন, অনেক কিছু সাহসের সঙ্গেও লিখে ফেলেছি। আমি সত্যি কথা বলতে কখনো পিছপা হই না। আমার আত্মজীবনীতেও সেটি আছে। আজকাল মেয়েরা এতো সরাসরি নিজের কথা এভাবে বলে না। আমি বলেছি। আমি কিছু লিখেছি, এটি জানান দেওয়ার জন্য যে আমরা সবাই সত্য কথা বলব। তাতে সমাজে কলঙ্কজনক অধ্যায় আর কখনো ঘটবে না। এসব নানা মিশ্র প্রতিক্রিয়া থেকে আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধটাই সব থেকে প্রিয় নাম। আর এ পুরস্কার পেয়ে আমি খুশি। আমি না পেলেও খুশি, পেলেও খুশি। প্রাপ্তি আসলে ভালো লাগে, এটুকু ভালো লাগছে আমার।

আসাদ মান্নান:
১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন কবি আসাদ মান্নান। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে। এরপর তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন স্কুল-কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে। পালন করেছেন সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও। তবে লেখালেখি তার কাছে নেশার মতো। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সুন্দর দক্ষিণে থাকে, সূর্যাস্তের উল্টো দিকে, সৈয়দ বংশের ফুল, দ্বিতীয় জন্মের দিকে, ভালোবাসা আগুনের নদী, তোমার কীর্তন, যে-পাড়ে পাড় নেই সে-পাড়ে ফিরবে নদী, হে অন্ধ জলের রাজা, নির্বাচিত কবিতা ইত্যাদি। ২০২১ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন এ কবি।

কথা হলে পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ অনুভূতি জানিয়ে কবি আসাদ মান্নান বলেন, পুরস্কার বিষয়টি হচ্ছে স্বীকৃতি। একজন কবি বা লেখকের জন্য পাঠকের স্বীকৃতিটা হচ্ছে বড় স্বীকৃতি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেহেতু বাংলা একাডেমি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে সাহিত্যের একমাত্র অভিভাবক প্রতিষ্ঠান, সেহেতু বাংলা একাডেমি একজন লেখককে পুরস্কৃত করা মানে রাষ্ট্রীয় একটা স্বীকৃতি। আমি যেমন আনন্দিত, আমার থেকে আমার বন্ধু-বান্ধব যারা এটা প্রত্যাশা করেছেন, পাঠকও যারা আছেন, আমি মনে করি, আমার থেকে তাদের আনন্দটা অনেক বেশি।

তিনি বলেন, আমি আমার লেখালেখি জীবনের শুরুতে একটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ তরুণ কবি হিসেবে ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮ সালে পরপর দুই বাংলাদেশ পরিষদ পুরস্কার পাই। সেই কবিতাগুলো দেশপ্রেম এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রতিবাদে আমার কবিতা লেখা শুরু। ওই থেকে আমার সমস্ত কিছুর মূলেই বঙ্গবন্ধু। আর এ পুরস্কার প্রাপ্তির আনন্দ একটু অন্য ধরনের। আমি আমার আজকের এ প্রাপ্তি আমার বন্ধুদের উৎসর্গ করছি, যারা আমার কবিতার পাঠক হিসেবে আমাকে প্রেরণা যুগিয়েছেন।

ঝর্না রহমান:
প্রায় ৪০ বছর ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন ঝর্না রহমান। এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন কথাসাহিত্য বিভাগে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত একুশে সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ছোটগল্পে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্য ক্ষেত্রে এ লেখকের আত্মপ্রকাশ। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটক, কবিতা, ভ্রমণ-শিশুসাহিত্য, সবক্ষেত্রেই তার বিচরণ রয়েছে। তবে গল্পকার হিসেবেই তিনি বিশেষভাবে পরিচিত।

কথা হলে তিনি বলেন, এটা তো আসলে বলার অপেক্ষা রাখে না যে অনেক ভালো লাগছে! কারণ এটা হচ্ছে প্রত্যেক সাহিত্যিকের জন্যই একটা অন্যতম স্বীকৃতি। যারা কাজ করতে চান সমাজে, তারা নিজের আবেগে কাজ করে যান। তারপরও সেই কাজকে যদি কেউ স্বীকৃতি দেয়, তবে তার ওপর আলাদা একটি শক্তি ভর করে। সেই আনন্দটা অবশ্যই আমিও পাচ্ছি। আমি বহুদিন ধরে, ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে লেখালেখি করছি। আমি আমার দায়বদ্ধতা থেকে, আমার ভালোলাগা থেকে, আমার বোধ থেকে, আমার দর্শন থেকে আমি লিখি। এ পুরস্কারটা যে আমি পেলাম, আমার মনে হচ্ছে যে সত্যিই যে কাজে আমি নিযুক্ত, সে কাজে সত্যিকারভাবে আছি। এখানে কোনো ফাঁকি নেই, এখানে আমার নিষ্ঠার কোনো কমতি নেই। এটাই আমার আনন্দের বিষয়। এটা প্রত্যেক লেখকের কাছেই সমানভাবে আদরনীয়। আমাকেও এ পুরস্কার নিশ্চয় আলাদাভাবে শক্তি যোগাবে এবং অনুপ্রাণিত করবে। আমি বাংলা একাডেমির প্রতিও কৃতজ্ঞ। আর আমার আপনজন, আমার বন্ধু-স্বজন যারা আছেন, আমার পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদে আনন্দিত, সবাইকে অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, পুরস্কার পাওয়ার কথা শোনার পর প্রথমে আমার মা-বাবার কথা মনে পড়েছিল। তারা কেউ এ পৃথিবীতে নেই। তারা থাকলে খুব খুশি হতেন। তারাই আমাকে গড়ে তুলেছেন। লেখার জন্য মানুষের যে জিনিসটি প্রথম প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে বোধ-অনুভূতি। সেটি তৈরি করে দেয় পরিবার। সমাজকে দেখার দৃষ্টি করে দেয়। আমার ভাই-বোন যখন আমাকে ফোন করেছে, আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছে মা-বাবার কথা মনে পড়ে। আর আগামীতে বাংলা সাহিত্যের প্রতি আরও ভালো কিছু দেওয়ার চেষ্টা থাকবে সব সময়ের জন্য। কেননা একজন লেখক সব সময় মনে করেন যে তার শ্রেষ্ঠ লেখাটা লেখা এখনো বাকি।

আমিনুর রহমান:
আশির দশকের বাংলাদেশের অন্যতম কবি, অনুবাদক, শিল্প সমালোচক ও প্রবন্ধকার আমিনুর রহমান। ১৯৬৬ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা এ লেখক এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন অনুবাদ বিভাগে। অনুবাদে তিনি বিভিন্ন দেশের কবিতা অনুবাদের পাশাপাশি কাজ করেছেন আবৃত্তি বিষয়ক প্রবন্ধমালা (সম্পদনা) নিয়েও। এছাড়া বাংলাদেশের চিত্রকর ও চিত্রকলা নিয়েও তার কাজ উল্লেখ করার মতো। সক্রিয়ভাবে জড়িত আছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সম্পাদনা এবং প্রকাশনার সঙ্গে।

কথা হলে আমিনুর রহমান বলেন, এ পুরস্কার আমাকে সামনে আরও ভালো কাজ করা জন্য অনুপ্রাণিত করবে। যেকোনো পুরস্কার মানুষকে অনুপ্রাণিত করে, আমিও তার বাইরে নই। আর পুরস্কারের জন্য আমাকে মনোনীত করায় বাংলা একাডেমির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। অনুবাদে অনেকদিন ধরে কাজ করছি, এ প্রাপ্তি সেই কাজকে মূল্যায়িত করল।

সাধনা আহমেদ:
নাটকে এবার এ পুরস্কার পেয়েছেন সাধনা আহমেদ। ১৯৯৭ সালে টেলিভিশন নাটক লেখার মাধ্যমে নাট্যকার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। এরপর এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক টেলিভিশন নাটক ছাড়াও মঞ্চের জন্য লিখেছেন– দমের মাদার, ফাগুনশেষে, ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন, অংশুপট উপাখ্যান, বিপুল তরঙ্গ, গাঙকুমারী, বিরাঙ্গনার আঁচল ও প্রজন্ম’১৩ এবং ভারতের দল ‘রঙ্গকর্মীর’ জন্য লিখেছেন ‘সপ্তপর্ণী’। এছাড়া লিখছেন গল্প আর কবিতাও। তার লেখা পাঠ্যসূচি হয়েছে ভারতের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও।

পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি জানিয়ে এ লেখক বলেন, আমি কাজের জন্যই কাজ করি, কাজ করেছি, কাজ করছি। লেখাই আমার জীবন, আমার প্রাণ। আমি এটার মধ্যেই বেঁচে থাকি। আমি সবার কাছে দোয়া চাই যেন আমার কাজ আরও ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পারি। পুরস্কার পেয়ে যেন আমি থেমে না যাই। আমার শুভাকাঙ্ক্ষি, নাটকের মানুষ, থিয়েটারের মানুষ, সবাইকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই।

তিনি বলেন, আমি গর্বিত যে আমি এদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। বাংলা ভাষার মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার আকাঙ্ক্ষা যে বাংলা সাহিত্য পৃথিবীর বুকে আরও বেশি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, বাংলা সাহিত্যের গভীরতা সারা পৃথিবীতে ছড়াবে। সেই জায়গাটি থেকে মনে হয়, আমি আরও কাজ করি। আর ভাষার আকর নিয়ে যে দেশে আমি জন্মেছি, সে দেশের সৃষ্টিতে যাদের অবদান অনস্বীকার্য, বঙ্গবন্ধু, ভাষা শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সবাইকে আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। তাদের জন্যই আমি আমার ভাষার অধিকার পেয়েছি, স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি ও লিখতে পারি।

বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২১ এর জন্য আরও মনোনীত হয়েছেন কবিতায় বিমল গুহ; কথাসাহিত্যে বিশ্বজিৎ চৌধুরী; প্রবন্ধ গবেষণায় হোসেনউদ্দীন হোসেন; অনুবাদে রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী; শিশুসাহিত্যে রফিকুর রশীদ; বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক গবেষণায় হারুন-অর-রশিদ; বিজ্ঞান কল্পবিজ্ঞান পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে শুভাগত চৌধুরী; আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনি বিভাগে সুফিয়া খাতুন ও হায়দার আকবর খান রনো; এবং ফোকলোর বিভাগে আমিনুর রহমান সুলতান। বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা ২০২২-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিতদের এ পুরস্কার দেবেন।

বাংলাদেশ সময়: ০১১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০২২
এইচএমএস/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।