ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ বৈশাখ ১৪৩২, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

জাতিসংঘ প্রতিবেদন থেকে-১০

ইন্টারনেট বন্ধ নিয়ে পলকের দাবি ছিল মিথ্যা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০২৫
ইন্টারনেট বন্ধ নিয়ে পলকের দাবি ছিল মিথ্যা

ঢাকা: জুলাই আন্দোলনের সময় তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ঢাকায় বিক্ষোভকারীরা ডাটা সেন্টারে আগুন দিলে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় বলে মিথ্যা দাবি করেন এবং এই বিভ্রান্তিকর তথ্য তিনি টেলিযোগাযোগ সরবরাহকারীদের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়েছিলেন।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা এই প্রতিবেদন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের সহজবোধ্যভাবে বোঝার সুযোগ করে দিতে অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর সম্পাদকীয় বিভাগ ইংরেজি থেকে হুবহু বাংলায় অনুবাদ করেছে। বাংলায় অনুদিত সেই প্রতিবেদনটি ধারাবাহিকভাবে পাঠকদের কাছে সংবাদ আকারে তুলে ধরা হচ্ছে। আজ থাকছে সেই প্রতিবেদনের দশম পর্ব।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্টারনেট বন্ধ (পরিষেবা ধীরগতি, ওয়েবসাইট বা অ্যাপ্লিকেশন ব্লক করা, অথবা ইন্টারনেট এবং যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আংশিক বা সম্পূর্ণ ব্যাঘাত) বিপুল সংখ্যক মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার, বিশেষ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্য এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি করে। এছাড়া অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রেও এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যাপকভাবে ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে এবং কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। এছাড়া রাষ্ট্রের আরোপিত অন্যান্য ধরনের নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাহতকরণ ও সাধারণত নির্বিচারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা একে অসামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে।

‘ইন্টারনেটভিত্তিক নির্দিষ্ট যোগাযোগ সেবা বন্ধ করার মতো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ কেবল ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা রক্ষার মতো বৈধ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একান্ত প্রয়োজন হলে এবং চূড়ান্ত বিকল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত অবশ্যই স্পষ্ট ও প্রকাশ্য আইনের ভিত্তিতে হতে হবে, যা আদালত বা অন্য কোনো স্বাধীন বিচারিক সংস্থার পূর্বানুমোদন প্রাপ্ত হতে হবে, পরিষেবা সরবরাহকারীদের আগে থেকেই জানানো হবে এবং কার্যকর প্রতিকার ব্যবস্থার আওতায় থাকবে। ’

কোনো ঘোষণা এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকার কোনো পূর্ব ঘোষণা, যথাযথ প্রক্রিয়া বা ব্যাখ্যা ছাড়াই ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন। সংশ্লিষ্ট জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার এবং ওএইচসিএইচআর-এর কাছে থাকা পরিষেবা সরবরাহকারীদের জন্য পাঠানো অভ্যন্তরীণ নির্দেশনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত মন্ত্রী পর্যায়ে নেওয়া হয় এবং তা জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি) ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মাধ্যমে কার্যকর করা হয়। এই বিশ্লেষণ অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনের ফলাফলের সঙ্গেসামঞ্জস্যপূর্ণ, যা ওএইচসিএইচআরের সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে।

তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের কার্যক্রম নিয়ে জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে বলা হয়,  সরকারের ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়ে পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ঢাকায় ‘বিক্ষোভকারীরা ডাটা সেন্টারে আগুন দিলে’ ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় বলে মিথ্যা দাবি করেন তিনি এবং এই বিভ্রান্তিকর তথ্য তিনি টেলিযোগাযোগ সরবরাহকারীদের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়েছিলেন। তার এই দাবি ওএইচসিএইচআরকে দেওয়া অন্যান্য সাবেক জ্যেষ্ঠকর্মকর্তাদের সাক্ষ্য, অভ্যন্তরীণ সূত্রের তথ্য এবং অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে দেওয়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিবৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ওএইচসিএইচআরের হাতে থাকা প্রযুক্তিগত তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণেও এটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। বিশেষ করে ডাটা সেন্টার আগুনে পুড়ে গেছে বলে দাবি করা এলাকাগুলোর সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে ইন্টারনেট সংযোগ সচল ছিল।

‘অন্য সময়ে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন যে, ভুয়া তথ্যের বিস্তার ঠেকাতে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। তবে এক সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওএইচসিএইচআরকে জানান যে, বাস্তবে ইন্টারনেট বন্ধ করায় বিভ্রান্তিমূলক তথ্য আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভুয়া তথ্য রোধের পরিবর্তে এই ধারাবাহিক ইন্টারনেট বন্ধের মূল প্রভাব ছিল জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বিস্তার বাধাগ্রস্ত করা। ইন্টারনেট বন্ধের সময় ও ভৌগোলিক পরিধি প্রধান বিক্ষোভ স্থল এবং সেই বিক্ষোভ দমন অভিযানের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে ১৪-১৭ জুলাই যখন অধিকাংশ বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ ছিল তখনও ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল।  

এ ছাড়া দুটি সম্পূর্ণ ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা ঘটে সেই সময়গুলোতে, যখন সরকার কৌশলগতভাবে দমন অভিযান বাড়ানোর নির্দেশ দেয়, যার ফলে এই প্রতিবেদনে বর্ণিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন সংঘটিত হয়। প্রথমবার ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় সম্পূর্ণ ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়, যখন নিরাপত্তাবাহিনীকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে আরও প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়।  

দ্বিতীয়বার ৫ আগস্ট সকালে ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করা হয়, যখন পুলিশসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীকে ‘মার্চ অন ঢাকা’ প্রতিহত করতে বল প্রয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে ইন্টারনেট বন্ধের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারের সহিংস দমন অভিযানের তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া প্রতিহত করা, যা অবৈধ এবং অনুচিত উদ্দেশ্য বলে প্রতীয়মান হয়।

 

‘ইন্টারনেট বন্ধের ফলে বিক্ষোভকারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সংগঠিত হওয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ওএইচসিএইচআরকে সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান যে, ইন্টারনেটভিত্তিক পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থী ও বিরোধী দলের কর্মীদের শনাক্ত করা এবং গ্রেপ্তার করা সহজ হয়ে যায়। কারণ তারা তখন সাধারণ ফোনলাইনের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে বাধ্য হয়, যা এনটিএমসি এবং অন্যান্য গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর পক্ষে তাদের অবস্থান শনাক্ত করা ও কথোপকথনে আড়িপাতা সহজ করে তোলে’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০০১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০২৫
ইএস/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।