১৬ জুলাই রংপুরে প্রকাশ্যে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পর দেশব্যাপী ছাত্রজনতা আরও ফুঁসে ওঠে। আন্দোলন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতিতে কোনরকম আইনের তোয়াক্কা না করে আন্দোলন বানচাল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন একটি নোটিশের মাধ্যমে দেশব্যাপী সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে।
এর ফলে আবাসিক হলগুলোতে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীরা আশ্রয়হীন হয়ে অনিরাপদ হয়ে যায়। অপরদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি নোটিশের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণা করে।
ওইদিনের এসব ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তিনজনেরর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া আনুষ্ঠিক অভিযোগপত্রে। যে মামলায় আসামি করা হয়েছে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে। যদিও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ইতোমধ্যে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
ফরমাল চার্জ মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার। এই ফরমাল চার্জ আদালতে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. আব্দুস সোবহান তরফদার, মো. মিজানুল ইসলাম। যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
আদালতের নথি ও গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, বেপরোয়া গুলিবর্ষণ ও হামলার মাধ্যমে সারা দেশে সাধারণ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে কমপক্ষে ৬ জনকে হত্যা ও অসংখ্য শিক্ষার্থীকে আহত করার প্রতিবাদে ১৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশব্যাপী কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি ঘোষণা করে। কিন্তু তৎকালীন সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ছাত্রজনতার ওপর বর্বর হামলার নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের (সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী) ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ, দুই সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর এবং দলীয় সংসদ সদস্যদের সাথে মতবিনিময় সভার মাধ্যমে তিনি দলের নেতাকর্মীদের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রস্তুতির নির্দেশ দেন।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি এসেছে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা আমাদের করতেই হবে, কাজেই আপনারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রস্তুত হয়ে যান। ”
সভায় উসকানিমূলক বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, শাহজাহান খান, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, সালমান এফ রহমান, আ ক ম মোজাম্মেল হক, ড. হাছান মাহমুদ, আসাদুজ্জামান খান কামাল, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, মাহবুব উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক, মীর্জা আজম, সুজিত রায় নন্দি, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারা।
এ ছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাবে শাহজাহান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে আ ক ম মোজাম্মেল হক ‘ঘরে বসে থাকার সময় নেই’ বলে আন্দোলনকারীদের হত্যা বা ধ্বংস করার জন্য উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। সেখানে উপস্থিত অন্যান্য নেতারা আন্দোলনকারীদের প্রতি সহিংস হওয়ার জন্য উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। এভাবে আওয়ামী লীগ ও সরকারের দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রীরা দেশব্যাপী নৃশংসতা চালানোর লক্ষ্যে দলীয় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন রকমের অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনামূলক বক্তব্য দিয়ে উত্তেজিত করে তোলে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা
সরকার ও আওয়ামী লীগের পাশাপাশি আন্দোলন দমাতে কোনরকম আইনের তোয়াক্কা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন একটি নোটিশের মাধ্যমে দেশব্যাপী সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে, যাতে আবাসিক হলগুলোতে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীরা আশ্রয়হীন হয়ে অনিরাপদ হয়ে যায়। অপরদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি নোটিশের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণা করে। এমন ন্যক্কারজনক ও অন্যায্য আদেশের প্রতিবাদে দেশব্যাপী ছাত্রসমাজ ফুঁসে ওঠে এবং প্রতিবাদ শুরু করে। ঠিক একইভাবে নিপীড়ন বিরোধী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের একদল শিক্ষক ছাত্রসমাজের ওপর বর্বর হামলা ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ছাত্র, শিক্ষক এবং সাধারণ জনতা কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠানের চেষ্টা করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের জেলা, উপজেলা সর্বত্র পুলিশ এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা কোনো কারণ ছাড়াই একযোগে হামলা করে এবং প্রায় সহস্রাধিক নিরস্ত্র সাধারণ শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, শিক্ষক ও নিরস্ত্র সাধারণ জনতাকে আহত করে। যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়, যাদের মধ্যে দুই বছরের একটি শিশু ও তার বাবাও ছিলেন। ওইদিন ঢাকার মাতুয়াইল এলাকার সিয়াম নামে ১৮ বছরের এক যুবক শহীদ হন। তিনি গুলিস্তানে একটি ব্যাটারির দোকানের কর্মচারী ছিলেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ পালনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বিনা উসকানিতে সাধারণ নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারসহ পুলিশি আক্রমণ বন্ধের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, বিনা উষ্কানিতে যে সমস্ত পুলিশ সদস্য ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, আওয়ামী সন্ত্রাসী যারা পুলিশের সহযোগী হিসেবে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বরং শেখ হাসিনার প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা অধঃস্তনদের কাছে পৌঁছে দিয়ে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে অপরাধজনক কর্মকাণ্ড ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে।
এদিনের ঘটনাসহ জুলাই আন্দোলনের পুরো ঘটনায় যৌথ দায় হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিবন্ধন (১২৭ নং) করা হয়। ওই অভিযোগের প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপপরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় আগামী ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য এবং ৪ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
৫ আগস্টের পর ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত ২৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে এক আসামির।
ইএস/এমজেএফ