স্কুলের টেক্সটবুক ছাড়া সারাবছর আমাদের দেশের লোকেরা খুব বেশি বই পড়ে না। বইমেলা এলে পাঠক কিছু বই কেনে।
সত্তরের দশকে, একটা সময় ছিল, যখন নতুন দেশে আমাদের প্রচুর লেখার ও অনেক লেখকের প্রয়োজন ছিল। তখন চিন্তায় ছিল সম্ভাবনা কথা। চেতনায় ছিল জাতি গঠনের তাগিদ। কিন্তু সে সময় আমরা পেরিয়ে এসেছি। এখন মানের দিকে নজর দেওয়ার সময় হয়েছে। বেশি বেশি নয়—প্রকাশককে ছাপতে হবে খুবই সিলেকটিভ বই। পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে বিপণন ব্যবস্থা। লেখক লিখবেন। প্রকাশক সম্পাদনা পরিষদের সুপারিশের ভিত্তিতে তা প্রকাশ করবেন। প্রয়োজনে সরকার দেবেন সাবসিডি। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেবে লোন। বিপণন প্রতিষ্ঠান দেখবেন মার্কেটিং। পাঠক পাবেন তার প্রত্যাশিত বই। এভাবে একটি সুপরিকল্পিত টিমওয়ার্কের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে জ্ঞানভুবনের বিরাট উঠান। পৃথিবীর অনেক দেশে প্রকাশনা শিল্প অনেক এগিয়েছে। আমাদেরও এতদিনে তা করে ওঠার কথা ছিল।
জ্ঞানমুখী সমাজ গড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে। গবেষণা এবং প্রকাশনা তো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্বও বটে। কর্ম-পরিসরের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সারাদেশে ছড়িয়ে আছে এর প্রায় ২৩০০ ক্যাম্পাস। প্রায় ২১ লক্ষ নিয়মিত ও প্রাইভেট শিক্ষার্থী জ্ঞানচর্চা করছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। তাই, নিজস্ব অবকাঠামো ও জনবলকে কাজে লাগিয়ে উপজেলা পর্যায়ে পাঠাগার স্থাপন কিংবা কলেজে কলেজে লাইব্রেরিতে গ্রন্থ সরবরাহ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাপকভাবে পাঠ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জাতীয় ভাবধারার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়ে ও জ্ঞানভুবনে পাঠ ও গবেষণার দিকে নজর দিয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়েছে ব্যতিক্রমী কিছু পদক্ষেপ। গাজীপুরে কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসে প্রকাশনা বিভাগ ও ছাপাখানা স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ধানমণ্ডিতে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবন ও সিটি অফিস কমপ্লেক্সে ডিজিটাল আর্কাইভস গড়ে তোলারও কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সিলেবাস অনুযায়ী এবং জাতীয় উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়ে গবেষণামূলক ও সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে শিক্ষা-বান্ধব প্রতিবেশ নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠানটিকে সত্যিকারের ‘সেন্টার ফর এক্সিলেন্স’ হিসেবে গড়ে তোলার এই পরিকল্পনা অত্যন্ত সময়োপযোগী উদ্যোগ।
কলেজশিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। ৪ সপ্তাহ সময়কালের এই ট্রেনিংয়ে একসাথে ৩টি বিষয়ের ৪০ জন করে প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করে থাকেন। সে হিসাবে বছরে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২ হাজার টাকা মূল্যমানের বই উপহার দেওয়া হয়। এই কার্যক্রমে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টাকার বই বিতরণ করা হয়। এডিবি-র আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত এই ধরনের কার্যক্রমে বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থার সহায়তা গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে করে সম্প্রসারিত হবে গ্রন্থ-পাঠের প্রবণতা এবং গবেষণা।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টি থিসিস বেজড অ্যাডভান্স মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করেছে। চালু রয়েছে এমফিল-পিএইচডি প্রোগ্রামও। প্রত্যেক শিক্ষার্থী ও গবেষককে বাধ্যতামূলকভাবে একটি অভিসন্দর্ভ লিখতে হবে। তাদের এই গবেষণাগ্রন্থ বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রকাশ করবে। জাতীয় ভাবধারা এবং শিক্ষার্থীর প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রেখে গবেষণার বিষয় নির্বাচন করা হচ্ছে। এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়েও বেরিয়ে আসবে নিষ্ঠাবান গবেষক। পাঠকরা পাবে মানসম্মত গ্রন্থ। কারণ, গ্রন্থগুলো রচনার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একজন সুপারভাইজার থাকবেন। অভিসন্দর্ভ পরীক্ষার জন্য অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হবে। এবং সর্বোপরি একটি সম্পাদনা পরিষদের সুপারিশের ভিত্তিতে তা প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া শিক্ষকরাও নিয়মিতভাবে গবেষণা কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। অচিরেই দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী গাইড-নোট বই নির্ভর পড়ালেখা থেকে সরে আসবে। মননশীল ও সৃজনশীল গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে একটি মজবুত ভবিষ্যত প্রজন্মও তৈরি হবে।
একসময় দেশের সব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত পাঠাগার ছিল। শিক্ষার্থীরা সেখানে নিয়মিতভাবে পড়ার এবং বই ইস্যু করে বাড়িতে নেয়ার সুযোগ পেত। বর্তমানে সে প্রবণতা কমেছে। বিশেষ করে নতুন প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠে ওই কালচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সকল কলেজে পাঠচক্র গড়ে তুলতে পারে। সপ্তাহে একদিন করে সকল শিক্ষার্থীকে পর্যায়ক্রমে লাইব্রেরিতে পড়ার বাধ্যতামূলক নিয়ম প্রবর্তন করতে পারে। এতে করে পাঠসূচির পাশাপাশি, শিক্ষকের সরাসরি তদারকিতে, নানান জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই এবং পত্র-পত্রিকা পড়ে জ্ঞানের জগতকে প্রসারিত করার সুযোগ পাবে তারা। প্রতিবছর নিয়মিতভাবে সেরা পাঠক, সেরা লেখক, সেরা শিক্ষক, সেরা শিক্ষার্থী, সেরা গবেষক, সেরা সংগঠক—এরকম ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রবর্তন করেও পাঠ-কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করা যায়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে গ্রন্থের বিষয়-নির্বাচন, লেখক নির্বাচন, সম্পাদনা, প্রকাশনা এবং বিপণনের প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষামন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থ বিপণন বোর্ড। বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সাথে সৃজনশীল ও মননশীল ধারার সমন্বয় করে সারাদেশে বইমুখী সমাজ তৈরি করতে পারে এই প্রতিষ্ঠান। সারাদেশে গড়ে তুলতে পারে বুকস মার্কেটিং সোসাইটি। অন্তত ২৩০০ কলেজে প্রতিটি নির্বাচিত গ্রন্থের ৫ কপি করে যদি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বই বিতরণ করা হয়, তাহলে প্রত্যেকটি বইয়ের ১১৫০০ কপি নিশ্চিতভাবে বিক্রির পথ নির্মিত হয়। তাহলে লেখককে তাঁর রয়্যালিটির জন্য ভাবতে হবে না। প্রকাশককেও তাকিয়ে থাকতে হবে না পাঠকের দিকে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য যে-কোনো ধরনের বইও রচনা-ক্রয়-প্রকাশ এবং বিপণনের ব্যবস্থা করতে পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশনাশিল্প এবং প্রকাশনা সমিতি এই কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করতে ও গতিশীল করতে সর্বোতভাবে সহায়তা করতে পারে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৬
টিকে/
** সিসি ক্যামেরাই সব নয়