মুক্তিযোদ্ধার জবানি হলেও বর্ণনাটা যেহেতু উপন্যাসের আদলে, সেহেতু এটিকে ইতিহাস বর্ণনাও বলাও যাবে না, আবার একেবারে নিখাঁদ উপন্যাসও বলা যাবে না। রচনারীতিতে অনন্য এই গ্রন্থকে বলা যায় ‘ইতিহাসের মোড়কে উপন্যাস অথবা উপাখ্যান’।
একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে মাসখানেকের বেশি সময় ধরে আলাপের পর বছর ধরে ঘাম ঝরিয়ে দায়বদ্ধতার সবটুকুন ঢেলে এই বইটি লিখেছেন সিনহা আবুল মনসুর। আমেরিকা প্রবাসী এই লেখক পেশায় চিকিৎসক। কিন্তু অঙ্গীকারে লেখক।
লেখার প্রতি সেই অঙ্গীকার আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বোধ থেকেই সিনহা আবুল মনসুর লিখেছেন এই বইটি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বোধটা তার কেন বা কেমন? সেটা বইয়ের শুরুতেই উল্লেখ করেছেন সিনহা আবুল মনসুর, ‘...আমাদের তো একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস ছিল, তাহলে আমাদের বর্তমানটা এতো ঘোলাটে কেন? সেকি ওই ইতিহাসকে নিজের অজান্তে বা জানতে ভুলে যাবার জন্য?’
বোঝা যায়, গর্বের মুক্তিযুদ্ধকে ভুলতে দিতে চান না সিনহা আবুল মনসুর। উপরন্তু বাঙালি জাতিসত্ত্বায় যখন থেকে স্বাধিকার বা স্বাধীনতার চেতনাবোধ জাগ্রত হয়, সেই বায়ান্ন থেকে একাত্তরের বিজয়ের সূর্যোদয় পর্যন্ত ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কখন কী হয়েছিল, কী প্রেক্ষাপটে হয়েছিল- তা তিনি প্রজন্মকে জানিয়ে দিতে লিখেছেন এই উপন্যাসে।
খোলাসা করে বললে, ৫২ এর স্বাধীনতার আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, পঁয়ষট্টির পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ, ছেষট্টির ছয় দফা, আটষট্টির আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের ১১ দফা ও গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অগ্নিগর্ভ মার্চ এবং ৯ মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও বর্ণনা উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
এমনকি আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘স্মৃতিস্তম্ভ’, শামসুর রাহমানের ‘আসাদের শার্ট’, হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ রচনার পটভূমিও উঠে এসেছে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর জবানিতে। চরিত্রগুলোর আলোচনায় এসেছে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ নির্মাণের প্রেক্ষাপট এবং ভূমিকাও।
বোঝাই যায়, ইতিহাসটা অনেক শেকড়ে গিয়ে তুলে ধরেছেন সিনহা আবুল মনসুর। পেশায় চিকিৎসক, কিন্তু এতোবড় কাজ নেওয়ার সময় পেলেন কীভাবে?
আবার আসে সেই দায়বোধের কথা। সিনহা আবুল মনসুর বলে চলেন, “মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পরিচয়। এ নিয়ে লেখার চিন্তাভাবনা আগে থেকেই ছিল। একজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে আমাদের মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত ছিলেন একেবারে বিজয়ের সূর্যোদয় পর্যন্ত, যখন তার সঙ্গে আলাপ হলো, তখন দায়বোধটা তাগিদ দিতে থাকলো। মনে হতে থাকলো, আমার প্রজন্ম সত্যটা জানে না, যেটা জানে, সেটা অর্ধসত্য, অথবা ভুলও। প্রজন্মের দরবারে গল্পের আদলে তুলে ধরতেই এই বই। ”
ইতিহাসে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের যে বর্ণনাটা আছে তার সঙ্গে এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের বক্তব্য মিলে যায়, উপরন্তু বর্ণনাটা পরিবেশ-প্রেক্ষাপটসহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেসব জায়গায় খানিকটা ভিন্নতা আছে, সেসব জায়গায় ইতিহাসবিদদের বইকে কষ্ঠি পাথর হিসেবে নিয়ে যাচাই করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছেন এই ‘অঙ্গীকারাবদ্ধ’ লেখক। সে কথাও উল্লেখ আছে বইয়ের শেষে।
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের ভাষ্যমতে, ‘এক মুক্তিযোদ্ধার না বলা কথা’ এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প। ... ইতিহাসের মোড়কে এ এক উপাখ্যান। ...উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা ঢুকে যাই ইতিহাসের কঠিন অলিগলি অন্ধিসন্ধিতে। ’
এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে দিব্যপ্রকাশ থেকে বের হওয়া বইটির প্রচ্ছদশিল্পী তানভীর রনি। দাম রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা।
সিনহা আবুল মনসুরের প্রথম বই প্রকাশ হয় ২০১২ সালে। ভ্রমণ সংকলনের ওই বইয়ের নাম ‘সেই সব অদ্ভুত ভ্রমণ’। এরপর বেরোয় ‘হুমায়ূন: একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’, ‘দ্বীপ ও জনপদের গল্প’, ‘জীবানানন্দ: সময়ের নিঃসঙ্গ নাবিক’, ‘জীবন এত ছোট কেন’। এসব রচনার জন্য তিনি বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৭
এইচএ/