বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে শিশুদের বইয়ের জন্য রয়েছে আলাদা অংশ। ১০ নম্বর এ চত্বরটিকে আয়োজক পক্ষ নাম দিয়েছে ‘আহসান হাবীব চত্বর’।
এখানে শিশুদের বইয়ের পসরা সাজিয়েছে- ফুলকি, শিশু কিশোর প্রকাশন, শিশু প্রকাশন, সিসিমপুর, ঘাসফড়িং, প্রগতি পাবলিশার্স, প্রিয় প্রকাশ, ডাক, বাংলা একাডেমি শিশু কিশোর প্রকাশনা, ওয়ার্ল্ড অব চিলড্রেনস্ বুক, লাবনী, ছোটদের মেলা, গোল্ডেন বুকস, ঢাকা কমিকস্, শৈশব, শিশুঘর প্রকাশনী, কালান্তর, ময়ূরপঙ্খী, শিশু রাজ্য, ঝিঙে ফুল, নলেজ ভিউ, হলি পাবলিকেশন, মাহি প্রকাশনী, কিশোর ভুবন, বইমেলা, শিশু সাহিত্য বইঘর, বিজয় ডিজিটাল, শব্দশিল্প প্রকাশন, আরো প্রকাশন, ছোটদের বই। টইটুম্বুর, পঙ্খিরাজ, বই পড়ি, টোনাটুনি, রাতুল গ্রন্থপ্রকাশ, মেলা, সপ্তডিঙা, দ্য পপ আপ ফ্যাক্টরি, শিশুবেলা, চলন্তিকা, ইগনাইট পাবালিকেশন্স, পাতাবাহার, পিপিএমসি ও সুপ্ত।
মেলায় হাজারো লোকের ভিড়। ছোট্ট বাচ্চারা সবাই বাবা-মায়ের হাত ধরে ঢুকছে। যেই না বটগাছতলায় সিসিমপুরের মঞ্চ চোখে পড়ছে, অমনি হাত ছাড়িয়ে ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে বইয়ের দুনিয়ায়। পেছন থেকে সতর্ক ডাক, তবু বাবা-মায়ের সস্নেহ বকুনি তাদের কানেই পৌঁছালো না।
গল্প, রূপকথা, ছড়া, কবিতা, বর্ণমালার বই, যেমন খুশি তেমন আঁকো, কমিকস্- কি নেই এই বই রাজ্যে। স্টল কর্মীদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, বই বিক্রি সন্তোষজনক। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় শুক্রবারে বিশেষ শিশু কর্নার থাকায় এদিন বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি।
এর মধ্যেই ২২ দিন পার করে ফেলেছে বইমেলা। শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) শিশু কর্নারের শেষ দিন। স্টল কর্মীরা জানান, ২১ ফেব্রুয়ারির তুলনায় গত শুক্রবারগুলোতে বই বিক্রি হয়েছে বেশি।
বাবা-মায়ের হাত ধরে মেলায় আসা শিশুদের সীমাহীন আগ্রহ, অঢেল বই বিক্রি- সবই ঠিক আছে। কিন্তু এরপরও মনে প্রশ্ন জাগে, এখনকার শিশুরা গল্পের বই পড়ে? রাশি ক্লাসের বই, অফুরান পড়াশোনার চাপ তাও আবার ইংরেজি মাধ্যম, ইংরেজি-হিন্দি ভাষার কার্টুন, ভিডিও গেমসের ভিড়ে রাক্ষস-খোক্কস, দৈত্য-দানো, শেয়াল পণ্ডিত আর বাঘমামা আদৌ ঢুকতে পারে?
উত্তর দিলেন ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ফাইয়াজের (৭) মা, কী করবো বলেন, এখন মানসম্মত পড়াশোনা মানেই ইংলিশ মিডিয়াম। ঢাকার অধিকাংশ ভালো স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামেই পড়াশোনা হয়। শুধু বেসরকারি নেয়, নামকরা সরকারি স্কুলগুলোতেও একই অবস্থা। এমনিতেই এতোগুলো বইয়ের চাপ, এরসঙ্গে স্কুলের টিচাররা বলে দেন- বাড়িতে যেনো বাচ্চাদের সঙ্গে যতো বেশি পারা যায় ইংরেজিতে কথা বলতে। তাতে স্পিকিং প্রাকটিস হবে। পড়াশোনার সিস্টেমই এরকম। এই সিস্টেমে না থাকলে বাচ্চারা পিছিয়ে পড়বে।
‘টিচাররা বেশি বেশি করে ইংরেজি গল্পের বই পড়তে বলেন। স্কুলে, ঘরে, বাইরে এতো বেশি ইংরেজির মধ্যে থাকছে যে, আমার বাচ্চারা বাংলা ভালোভাবে শিখছে না। এজন্য বইমেলা থেকে বেশি করে বাংলা গল্পের বই কিনি। এগুলোই সারাবছর পড়ে। ’
পড়ার সময় মেলে?
‘অন্যদের ক্ষেত্রে জানি না, আমার ফাইয়াজ তো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে। রঙিন ছবি দিয়ে সাজানো বলে সহজেই বাচ্চারা আকৃষ্ট হয়। ’
শিশু চত্বরের বটগাছতলায় সিসিমপুরের মঞ্চ। শোলা দিয়ে বানানো টুকটুকি আর হালুমের সঙ্গে ছবি তুলছে রৈতি (৮)। একটু দূরে ক্যামেরা তাক করে বাবা।
যাদের সঙ্গে ছবি তুললে তাদের চেনো? রৈতি বড্ড লাজুক। বই বুকে জড়িয়ে বাবার হাতে মুখ লুকায়। বাবাই ঠেলে ঠেলে তাকে উত্তর দেওয়ালেন। গল্পের বই পড়ে টুকটুকি-হালুমদের সম্পর্কে জেনেছে সে। এবারও অনেকগুলো বই কিনেছে। এর মধ্যে কমিকস্ রয়েছে বেশি।
রৈতির বাবা আলিম হোসাইন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ইংলিশ মিডিয়াম বনাম বাংলা বই নিয়ে তার মতামত, আমাদের হাতে তো কোনো অপশন নেই। শুধু ঢাকা কেন আপনি দেখবেন, জেলা শহরগুলোতেও এখন একই অবস্থা। ইংলিশ মিডিয়াম আর প্রি-ক্যাডেটের ছড়াছড়ি। ভালোভাবে ইংরেজি না শিখলে বাচ্চা স্কুলে গিয়ে হেনস্থা হচ্ছে। আবার শিখলে বাংলা ভুলে যাচ্ছে। এরপরও আমি আর ওর মা যতোটা পারি বাংলা গল্প, ছড়া, কার্টুনের বই পড়তে দেই। সেও আগ্রহ নিয়ে পড়ে।
এমনটি জানালেন সিসিমপুরের স্টলকর্মী মাহবুব হাসান স্বদেশও, রোজ অসংখ্য বাবা-মা এসে বলছেন- আমার বাচ্চা বাংলা শিখছে না, ভালো বাংলা গল্পের বই দেন।
আমরা এসব বিষয় মাথায় রেখেই বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন স্বাদের বই তৈরি করি। বাংলা শেখার পাশাপাশি তারা যেনো নীতি-নৈতিকতাও শেখে এজন্য শিক্ষামুলক গল্প থাকে, যোগ করেন স্বদেশ।
চারদিকে শিশুদের হুটোপুটি। শিশু চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে স্টলগুলো থেকে ‘আতা গাছে তোতা পাখি’, ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা’, ‘ভোর হলো দোর খোলো’ ছড়া কানে আসে। টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টারের সামনে এই ছড়াগুলোর কী হাল?
স্টলকর্মীরা জানান, ছড়ার বই অনেক বিক্রি হয়। পাশাপাশি ছড়ার সিডি-ডিভিডিও। গোপাল ভাড়, শেয়াল পণ্ডিত, রূপকথার কার্টুনও ভালো বিক্রি হচ্ছে।
বইমেলায় শিশু একাডেমির স্টল বাংলা একাডেমি অংশে। স্টলে থাকা শিশু একাডেমির উচ্চমান সহকারী আবদুল মোতালেব বলেন, এবার মেলায় শিশু একাডেমি ৪৮টি নতুন বই এনেছে। নতুন বইগুলো গত বছরের ডিসেম্বরের পরে প্রকাশিত।
শিশু চত্বরে একাডেমির স্টল না থাকলেও সবাই এই স্টল ঘুরে যাচ্ছেন। শিশুদের বই সবসময়ই বেশি বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
বই প্রচুর বিক্রি হচ্ছে কিন্তু বিভিন্ন মহলের অসন্তোষ আছে শিশু সাহিত্য তথা শিশুদের জন্য বইয়ের গুণগত মান নিয়ে।
এ নিয়ে ভাবনা চাইলে চাকরিজীবী এক মা বলেন, মানের বিষয়টি লেখকদের বেশি ভাবা উচিত। এটা তাদের দায়িত্ব। এখনও শিক্ষণীয় গল্পের ক্ষেত্রে আমার পছন্দ ঈশপ, সুকুমার রায়, দেশি-বিদেশি রূপকথা। আমাদের তো যাচাই-বাছাই করার অতো সময় থাকে না। মেলায় আসি, দেখে যেটা ভালো লাগে কিনি।
কথা হয় বেশ কয়েকজন শিশু সাহিত্যিকের সঙ্গে। তারা বলেন, শিশু সাহিত্য বরাবরই অবহেলিত। এখনও অনেকের ধারণা, শিশুরা লিখলে সেটি শিশু সাহিত্য। এটি সাহিত্যে অতো গুরুত্ব বহন করে না। কিন্তু বিষয়টি ঠিক এর উল্টো। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, টলস্টয়ের মতো মহারথীরাও শিশু সাহিত্য লিখেছেন। বড়দের তো যাচাই-বাছাই করার ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু শিশুরা যা পাচ্ছে বা তাদের পড়তে দেওয়া হচ্ছে তাই পড়ছে। তাদের হাতে ভালোমানের বই তুলে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
ইংরেজি মাধ্যমকেন্দ্রিক পড়াশুনায় শিশুরা বাংলা শিখছে না, এ নিয়ে তাদের মতামত, শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা, বাকি ১১ মাস খোঁজ না থাকলে এরকমটি হবেই। এ বিষয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭
এসএনএস/জেডএম