ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা

শিশুসাহিত্যের নামে অপরাধ হচ্ছে, তবে ভরসা তরুণেরা

অশোকেশ রায়, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৭
শিশুসাহিত্যের নামে অপরাধ হচ্ছে, তবে ভরসা তরুণেরা বইমেলায় আসা পাঠকদের একটি বড় অংশ শিশুরা। ছবি: জি এম মুজিবুর

ঢাকা: শিশু চত্বরে আছেন শুধুই ছোটদের বইয়ের প্রকাশকরা। বাংলা একাডেমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের পুরো বইমেলা জুড়ে আছে শিশুতোষ বইয়ের আরও অসংখ্য স্টল।

অমর একুশে গ্রন্থমেলার একেবারেই শেষ প্রান্তে এসে জানা যাচ্ছে, এবারও প্রকাশিত তিন হাজারের মতো বইয়ের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য।

কিন্তু এর কতোগুলো মানসম্মত বা ছোটদের মেধা-মনন বিকাশের উপযোগী? তাদের আনন্দের সঙ্গে বড় হতে সহায়ক জ্ঞান অর্জনে কতোটা সহায়তা করছে প্রাণের মেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত আমাদের শিশুসাহিত্য?  

বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক-ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের উত্তর, ‘হাতে গোণা।

অধিকাংশই মানসম্মত নয়’।

শিশুসাহিত্যকে সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর বইমেলাকে ঘিরে শিশুসাহিত্যের প্রচুর বই আসছে। বিক্রিও হচ্ছে অজস্র। কিন্তু সে তুলনায় খুব বেশি সত্যিকারের শিশু সাহিত্যিক নেই আমাদের। অল্প কয়েকজনের ওপর নির্ভরশীল শিশুসাহিত্য। আর বাকিরা শিশুসাহিত্যের নামে ভুল বানান, ভুল বাক্য, ভুল তথ্য সমৃদ্ধ লিখছেন, অখ্যাত-মৌসুমী প্রকাশকরা সেগুলো প্রকাশ করে মেলায়ও আনছেন অবলীলায়’।

‘বলা চলে, মেলায় আসা বইয়ের মধ্যে নব্বই শতাংশই মানসম্মত নয়। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ বইয়ের কোনো সম্পাদনা হয় না’।     

তবে সিদ্দিকীয়া পাবলিকেশন্সের প্রকাশক শিশু সাহিত্যিক মালেক মাহমুদের মতে, ‘আমরা তো চেষ্টা করছি। ভালো বই তো বের হচ্ছে’। আর এবারই প্রথম মেলায় আসা ‘সপ্তডিঙা’র (শুধু ছোটদের বই) প্রকাশক তরুণ শিশু সাহিত্যিক নাফে নজরুল মনে করেন, ‘কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি, সংকট ছাড়া বর্তমান বাংলা শিশুসাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ’।    

রিটনও স্বীকার করেন, ‘বিখ্যাত-দায়িত্বশীল প্রকাশকরা দায়িত্বের সঙ্গে ছোটদের হাতে ভালো বই তুলে দিচ্ছেন’।
‘তবে সারা বছর খোঁজ-খবর দেখি না, এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রকাশকরা রঙে-চঙে ভরিয়ে সম্পাদনা ছাড়া ও নীতি-আদর্শ না মেনে বাজে বই বাজারে আনছেন। বহু বইয়ের মোড়ক ও বিজ্ঞাপন বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু চকমকে মোড়কের আড়ালে ভুলে ভরা’- বলেন তিনি।

লুৎফর রহমান রিটন মনে করেন, ‘এসব বাজে ও ভুল বই প্রকাশ ও বিপণন করে শিশু সাহিত্যের নামে এক ধরনের অপরাধ করা হচ্ছে। অভিভাবকরা প্রতারিত হচ্ছেন। কেননা, তারাই তো আদরের সন্তানদের হাতে এসব বই তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। রঙ-চঙ দেখে বইগুলো পড়ে-হাতে নিয়ে ভুল শিখছে, ভুলভাবে বেড়ে উঠছে শিশুরাও। এসব দেখারও কেউ নেই’।    

এ পর্যন্ত ৫ শতাধিক বই প্রকাশ করেছেন মালেক মাহমুদ, যার একটি বড় অংশ ছোটদের বই। এবার আসা তিনটিসহ তার নিজের লেখা বইয়ের সংখ্যা ৪২টি, যা মধ্যে আছে দু’টি ছড়া সমগ্র। আর প্রথমবারেই ক্লাসিকসহ বরেণ্য এবং তরুণ ও মেধাবী প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের ২৫টি শিশুসাহিত্যের বই এনেছেন নাফে নজরুল। নিজের বইও রয়েছে সাতটি।

নাফে নজরুল বলেন, ‘মৌলিক সৃজনশীল বইতো ঠিকই বিক্রি হচ্ছে। শওকত ওসমানের মতো বরেণ্য লেখকের ক্লাসিক আর আলী ইমাম, ফারুক নওয়াজ, আমীরুল ইসলামের মতো সফল লেখকদের ভালো লেখা প্রকাশ করে দেখলাম, আশার চেয়েও বেশি সাড়া পাচ্ছি’।

‘মেলায় বলেন, আর সারা বছর বলেন, শিশুতোষ বইই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। ছোটরা এসব বই পছন্দও করে। শুধু পরিকল্পনা করে কার্টুন-কমিকসের বদলে এসব ভালো বই করতে হবে’।

এ ধরনের চেতনা-আদর্শবাহী তরুণ লেখক-প্রকাশকদের দিয়ে বরাবরই আশাবাদী রিটন বলেন, ‘প্রবীণ শিশু সাহিত্যিকরা তো সক্রিয় আছেনই, প্রতি বছর অজস্র বই লিখছেন তারা। আর তরুণ যারা লিখতে এসেছেন, বই ছাপছেন- তাদের নিয়ে অনেক আশাবাদী আমি। তাদের হাতে আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে শিশুসাহিত্য’।

‘তবে বাজে বইয়ের ওই লেখক-প্রকাশকদের নিয়ন্ত্রণ বলবো না, সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে। ভালো সম্পাদনা পরিষদকে দিয়ে সুসম্পাদনার পর বই আনতে হবে’।    

নবীন-প্রবীণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমৃদ্ধ হবে শিশুসাহিত্যআরও দুই তরুণ শিশু সাহিত্যিক-প্রকাশক ‘জলছাপ প্রকাশনী’র লোকমান আহম্মদ আপন এবং বাবুই’র কাদের বাবু শিশুসাহিত্য লেখা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে চান সহায়তা, উৎসাহ ও প্রণোদনা।

‘বাবুই’র বই তালিকায় রয়েছে আসাদ চৌধুরী, আখতার হুসেন, ফারুক নওয়াজ, আমীরুল ইসলাম, জাকির তালুকদার, তুষার আব্দুল্লাহসহ খ্যাতিমানদের পাশাপাশি মেধাবী সম্ভাবনাময় তরুণদের লেখা নানা স্বাদের মানসম্মত বই’ বলে জানান কাদের বাবু। তার মতে, ‘নতুনদের প্রণোদনা দিতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে, আরও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তাহলেই নতুনদের পদভারে আরও সমৃদ্ধ হবে শিশুসাহিত্য তথা প্রকাশনাশিল্প’।    

এবারের মেলায় আসা ৪টিসহ মোট ২৬টি শিশুতোষ বইয়ের লেখক ও বাংলা সাহিত্যের প্রধান ছড়া কাগজ ‘ছড়াকর্ম’ এর সম্পাদক আপন মনে করেন, ‘প্রবীণদের কাছে শিখে শিখেই তো নবীনেরা হাল ধরছেন, এগিয়ে নিচ্ছেন শিশুসাহিত্যকে। মৌলিক-সৃজনশীল বই তো আমরা আনতেই চাই। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও অনেকদূর এগোবো সবাই মিলে’।

এবারই প্রথম মেলায় আসা ‘কিশোর কলম’ এর প্রকাশক বশীরুজ্জামান বশীর বলেন, ‘পাইরেসি বই প্রকাশ-বিক্রি এখনও হচ্ছে। এ কারণে মৌলিক-সৃজনশীল ভালো বই বের করেও আমরা মার খাচ্ছি। পাইরেসির বিরুদ্ধে তাই বাংলা একাডেমি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকা জোরালো হতে হবে’।
 
বাংলাদেশ সময়: ২০১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৭
এএসআর

** এসেই হারিয়ে যাচ্ছেন নতুন লেখক-প্রকাশকরা!
** ইস, শিশু চত্বরটা যদি আরও বড় করা হতো!
** সোহরাওয়ার্দীতে স্বস্তি, তবে...

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।