এটির নামের সঙ্গে নারী নামের মধুরতা সেই নাটকীয়তায় জাগিয়ে তোলে রোমাঞ্চ। নাটকীয়তা এবং বিস্ময় ---একইসঙ্গে দুটোই জাগিয়ে তোলে এই নাম।
বইয়ের নামের সঙ্গে নারী-নামের সংযোগ নতুন নয়। কিন্তু তানিম গতানুগতিকতার পথে হাঁটেননি। তিনি নারী-নামকে ব্যবহার করেছেন চমক ও বিস্ময়সহ---‘মালিহা জেরিন’-এর সঙ্গে ‘কেটে যাওয়া’ ক্রিয়াপদ জুড়ে দিয়ে।
প্রচল ভাষা কাঠামোতে মেঘ, কুয়াশা, আঁধার-এর মতো প্রাকৃতিক প্রপঞ্চে বা নানান মানসিক আবহাওয়ার গুমোটের মধ্যে এমন ক্রিয়াপদের যোগসূত্র মেলে। যেমন, মেঘ কেটে যাচ্ছে, আঁধার কেটে যাচ্ছে বা ভয় কেটে যাচ্ছে। এভাবে বলাই প্রচল রীতি। কিন্তু ‘মালিহা জেরিন’ নামের একটি নারী-নামের সঙ্গে ‘কেটে যাওয়া’ ক্রিয়াপদটির ব্যবহার পাঠককে ধাক্কা দেয়। চমক দেয়। সেইসঙ্গে কৌতূহল জাগায়। হয়তো আড়ালে রয়েছে কোনো কৌতুক, যা কেবল কবিই জানেন।
চতুর্থ বইটি তানিম কবিরের নতুন বই আবার একইসঙ্গে পুরনোও বটে। কেননা, এ বইয়ের বেশিরভাগ কবিতাবলি, সম্ভবত, আগের তিন বই থেকে নেয়া। স্মৃতি প্রতারণা না করে থাকলে বলা যায়, নতুন বা আগের বই তিনটির বাইরের গোটাকয় কবিতাও হয়তো স্থান পেয়েছে এতে।
‘ওই অর্থে’ বলা যেতেই পারে ‘কেটে যাচ্ছে মালিহা জেরিন’ অনেকাংশে ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’! তানিমের নিজের পছন্দের বাছাই করা কবিতা দিয়েই সাজানো হয়েছে এ-বই। ৫৩টি কবিতা আছে বইয়ে।
বইটি সম্পর্কে তানিম কবিরের ব্যক্তিগত উপলব্ধি হচ্ছে, এক দশকের বেশি সময় ধরে লেখা প্রায় পাঁচশো কবিতার মধ্য থেকে ‘কেটে যাচ্ছে মালিহা জেরিন’ বইয়ে স্থান পাওয়া ৫৩টি কবিতার বৈশিষ্ট্য হলো—এ কবিতাগুলোকে কোনো বিবেচনাতেই আর বাদ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এ ধরনের নির্ভারতা, স্বেচ্ছা-বিশৃঙ্খলা, কৌতুকপ্রিয়তা, সিরিয়াসনেসকে দূরে সরিয়ে ভাষার মজা আহরণ, আলস্য উপভোগের আনন্দ, ভ্রামণিকতা, আর শ্লেষের যুগপৎ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় কবিতাগুলোতে। তবে কবিতার এমন চপলগতি ও অধীর স্বভাব কখনো কখনো গিমিকের বিপদও তৈরি করে। আলোর বদলে মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গ জ্বালায়।
তানিম সেটা বলেছেনও অকপটে :‘এখানে সেখানে মূল্য আরোপ করে যাওয়ার সাংস্কৃতিক দায়মুক্ত এ সকল কবিতারা ছন্দাশ্রয়ী। ’
তবে তানিমের কবিতা যতোটা না ছন্দাশ্রয়ী, তারও চেয়ে বেশি ছন্দস্বভাবী। এমনকি এলানো ভঙ্গির ভেতরেও। সাবলীলতাই এর চলার ছন্দ। চোখ কান কোথাও আটকায়ও না।
তানিমের কবিতারা সদা চঞ্চলস্বভাবী, গোল্লাছুট খেলায় মেতে থাকার মতো উচ্ছল। বিষাদ বা গম্ভীরতার মতো ভারী বিষয়কে একদমই দূরে ঠেলে লেখা। চা-খানায় বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দেবার মতো, ট্রেনে উঠে য়েখানে খুশি চলে যাওয়া, যে কোনো নদীর তীরে ডাংগুটি খেলতে নেমে যাওয়ার মতো নির্ভার কবিতা তানিমের। আর হ্যাঁ, এসব ছদ্ম চপলতার ভেতর থেকে নারী-মানুষের দিকে একটা যুবা-চোখ তাক করা থাকে। লিবিডোর আধা-গোপন, আধা-প্রকাশ্য উপস্থিতির চোরাস্রোত টের পাওয়া যায়। এসবের প্রয়োগে বেশ মুন্সিয়ানা আছে তানিমের।
তানিমের কবিতা পড়লে বোঝা যায় তার নিজস্ব ম্যানারজিম ও তার নিজস্ব চলার ভঙ্গি।
এটা তানিমেরই কবিতা। এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। নাম কবিতা এবং বইয়ের প্রথম কবিতা ‘কেটে যাচ্ছে মালিহা জেরিন’-র প্রথম দুটি স্তবক:
কেটে যাচ্ছে মালিহা জেরিন
ফর্সা হচ্ছে আলো—
মধ্যনদীতে গাড়া ব্রিজের পিলার
ছায়া তার বসে আছে কূলে
চলন্ত ট্রেনের ছায়ায়
দ্বিখণ্ডিত রোদের ফিনকি ওঠা
বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে
দ্রুতগামী ঘ্রাণ, স্লিপারে পাথরে
এত এত স্তুতিগান
স্বরবৃত্তে দুলে ওঠা লোহার বাগান
সরে যাচ্ছে ক্রমশ...
তানিমের স্বভাব চপলতার বাইরে বইয়ের বেশ কিছু কবিতা মগ্নপাঠের আনন্দ দ্যায়। ‘সম্ভাব্য মৃত্যুদৃশ্য’ তেমনই একটা কবিতা।
ধ্রুব এষ’র করা প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির দাম রাখা হয়েছে ১২০ টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৮
জেএম