এবারের বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বার খোলার পর তিনিই সম্ভবত প্রথম ক্রেতা! তাই এগিয়ে গিয়ে কথা হয় জোয়ার সঙ্গে। প্রথম প্রহরের বইমেলার মতো নিজের শান্ত-স্নিগ্ধ চেহারায় উচ্ছ্বাস এনে বলেন ‘আমি কিন্তু বেশি কথা বলি!’
সে কথায় সাঁই দিতেই যোগ করেন, আমার বয়স যখন আট নয় মাস, আমি তখন থেকেই বইমেলা আসি।
শুধু জোয়া নয়, রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) মেলার দ্বার খোলার পর থেকেই শান্ত-স্নিগ্ধ উচ্ছ্বাস ছিলো পুরো মেলাজুড়ে। ছিলো উষ্ণতাও। সেই উষ্ণতার ঘ্রাণে চারদিকে বই-সাহিত্যপ্রেমী মানুষগুলোর নান্দনিক মেলায় ঘুরেছেন প্রাণ খুলে। বলা যায় প্রথম বিকেল থেকে সন্ধ্যা যেন বেশিই শান্ত ও স্নিগ্ধ। হবেই বা না কেন! দীর্ঘ একটি বছরের অপেক্ষা তো আর কম নয়। সঙ্গে নান্দনিক সৌন্দর্যে বেড়েছে পরিসর আর সারি সারি বইয়ের দোকানের মাঝখান দিয়ে সুপরিসর ইটবিছানো পায়ে চলা পথের প্রস্থও।
মেলা ঘুরে দেখা যায়, মেলা উদ্বোধনের পর সন্ধ্যা যতই ঘনিয়ে আসছিলো ততই যেন মেলা প্রাঙ্গণ পরিণত হচ্ছিলো অতি শান্ত ও স্নিগ্ধরূপে। নেই কোনো কোলাহল কিংবা বিরক্ত উদ্রেককারী শব্দ। বিস্তৃত পরিসরে লম্বা করে শ্বাস নেওয়ার মতো সবকিছুই। বিস্তীর্ণ মেলায় অল্প দর্শনার্থী হওয়ায় এদিন সবাই ঘুরেছেনও মনের আনন্দে।
এ প্রসঙ্গে ধানমন্ডি থেকে আগত দর্শনার্থী আমিনুল হক বলেন, এবারের মেলা অনেক নান্দনিক এবং বড় পরিসরে হচ্ছে বলে জেনেছি বিভিন্ন জায়গা থেকে। তাই মেলার প্রথমদিনই চলে এলাম। আজ বই কেনার ইচ্ছে নেই, সুন্দর পরিবেশে একটু ঘুরে ঘুরে নতুন বইয়ের মলাট উল্টে মেলাটা উদযাপন করতে চাই। কয়েকদিন পর তো ভিড় বাড়লে আর দাঁড়ানোর জায়গাও পাওয়া যাবে না।
সত্যিই তাই, এদিন তাড়াহুড়ার কোনো প্রভাব ছিলো না কারো মধ্যে। যেখানে খুশি দাঁড়ানো যায়, যতক্ষণ খুশি দেখা যায়; বলা যায়, শোনাও যায়। ঠিক একইভাবে সাহিত্য সংক্রান্ত সুতর্কে আড্ডাটাও জমিয়ে ফেলা যায় যেকোনো প্রান্তে। ক্লান্ত আড্ডাবাজরা ইচ্ছে করলে সুস্বাদু খাবারের অর্ডারটাও দিতে পারেন পাশের সুনির্দিষ্ট পরিচ্ছন্ন খাবারের স্টল থেকে। কারো কারো কাছে মনে হবে এ যেন এক বিশাল ড্রয়িংরুম।
মেলার প্রথমদিনেই মোটামুটি সাজানো গোছানো মেলা পেয়ে খুশি প্রকাশকরাও। এ প্রসঙ্গে প্রকাশনা সংস্থা অন্য প্রকাশ’র প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, পুরো মেলা এখনো ঘুরে দেখা হয়নি, তবে যতটুকু দেখেছি, মনে হয়েছে মেলার বিন্যাসটা অন্যান্যবারের তুলনায় ভালো হয়েছে। সাজানো গোছানো একটা পরিবেশ। মেলার শুরুর দিন যে পরিচ্ছন্ন মাঠ দেখতে পাচ্ছি, এটাও আমাদের প্রকাশকদের কাছে কাম্য। আশা করছি, খুব ভালো এবং সফল একটা বইমেলা হবে এবার।
শুধু সাজানো গোছানো মেলা নয়, প্রায় অধিকাংশ স্টলে চলে এসেছে নতুন বইও। এ প্রসঙ্গে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি বলেন, প্রথমদিন হিসেবে অনেক নতুন বই চলে এসেছে ইতোমধ্যেই। এখন কয়েকদিন বিক্রি হবে না, কিন্তু পাঠকরা এসে নতুন বইগুলো হাতে নিয়েই আনন্দ পাবেন। পাঠকরা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও ভালো লাগে। মেলার বিস্তার নিয়ে তিনি বলেন, এবার মেলার পরিসর বেড়েছে। তবে যদি এতো প্রকাশক থাকতো তবে স্বাগত জানাতাম। কিন্তু মৌসুমী প্রকাশক এসে মূলধারার প্রকাশকদের ব্যাহত করছে। তাই এই বিষয়ে বাংলা একাডেমির আরও সতর্কতা প্রয়োজন।
বিকেলে শীতের হিমেল হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসছিলেন পাঠক আর দর্শনার্থীরাও। প্রথমদিন; তাই যেন ঘুরে ঘুরে স্টলগুলো চিনে রাখাই ছিলো তাদের ব্যস্ততা। তরুণ কবি আর সাহিত্যিকরা এসেছিলেন প্রথম দিনেই কাঙ্ক্ষিত পাঠকের সামনে হাজির হতে। তেমনি একজন শিশু সাহিত্যিক মৌলি আজাদ এসেছিলেন তার নতুন গ্রন্থ ‘বইয়ের পাতায় স্বপ্ন বলে’ নিয়ে।
কথা হলে সে বলে, মেলার প্রথমদিন মেলায় আসা প্রাণের টানে। তার সঙ্গে নতুন বইটা যোগ করেছে আনন্দ। পুরো বইমেলাটা এমন আনন্দ নিয়েই সবার কাটবে, এমনটাই প্রত্যাশা।
সবকিছু মিলিয়ে মেলার প্রথমদিনের শুরুর ভাগটা অনেকটাই নীরব সৌন্দর্যের অধিকারী হলেও ছিলো না কোলাহলবিহীন। মৌনতাও যে কোলাহলময়, তা ধরা দিয়েছিলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর বাংলা একাডেমি চত্বরে। সেই আলিঙ্গনেই গোটা প্রাঙ্গণ মুখর হয় অন্যরকম আলোয়। তারুণ্যে ভরপুর নবীন-প্রবীণ কবি, সাহিত্যিক আর লেখকদের পাশাপাশি পায়ে পায়ে ভিড় জমান সাহিত্যপ্রেমীরা।
বাংলাদেশ সময়: ২০০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২০
এইচএমএস/এএটি