আবেগ, ঔদ্ধত্য, বিনয়। এই তিনের কোনোটার ঘাটতি ছিল না।
বিশ্বের অন্যতম সেরা দল কি না তা নিয়ে অনেকের সংশয় থাকতেই পারে। তবে বাংলাদেশ তাদের ইতিহাসে সেরা ক্রিকেটা খেলছে এখন, তা নিয়ে সংশয়ের কিছু নেই। হোয়াইট ওয়াশ তো বাংলাদেশ এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে, নিউজিল্যান্ডকে করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের মতো দলকে হোয়াইট ওয়াশ করার কথা ভাবা কঠিন ছিল। সেই কঠিন কাজটা যেভাবে করলো তারা; তাকে কি বলবেন? বলা যেতে পারে ক্লিনিক্যাল পারফরম্যান্স। ক্লিনিক্যাল ফিনিশ। কিন্তু এই সব কথাবার্তা পেশাদার বলয়েই চলে। মাঠে হাজির থাকা দর্শকদের কাছে এসব বিশ্লেষণের কোনো মূল্য নেই। শেষ ওয়ানডেতে জুনায়েদ খানের বলে মুশফিক যখন বাউন্ডারি মেরে জয় নিশ্চিত করলেন, সত্তরোর্ধ্ব এক ভদ্রলোক গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলেই ফেললেন; ‘এই দৃশ্যাটা দেখার জন্যই বোধহয় বেঁচে ছিলাম!’
আবেগের ছোঁয়া কি পাওয়া গেলো ভদ্রলোকের গলায়? সত্যিই আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ‘৭১-এ হয়তো মরেই যেতে পারতাম, মরিনি। মিরপুরের মাটিতে পাকিস্তানকে যেভাবে হারালো বাংলাদেশ, তাতে এখানেই একটা গণ সংবর্ধনা দেওয়া উচিৎ বাংলাদেশ দলকে। ’ কারণ, এই মিরপুর ’৭১-এ ১৬ ডিসেম্বরেরও পরে হানাদারমুক্ত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা ভদ্রলোকের সেই আবেগকে একটু সম্মান দেখানো যেতেই পারে।
কিন্তু আবেগ নয়, মাঠে তামিম-সৌম্য সরকার-মুশফিক-মাশরাফি-সাকিব যা দেখালেন সেটা ক্রিকেটীয় ঔদ্যত্ব। আরো সোজা সাপটা বললে বলতে হবে ক্রিকেটীয় মাস্তানি। এবং এই মাস্তানি দেখানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান সেটা খুব ভালভাবে টের পেলো।
১৯৮৬ সালে শ্রীলংকায় এশিয়া কাপে বাংলাদেশ যখন তাদের প্রথম ওয়ানডে খেলতে নেমেছিল, সেই সময় পাকিস্তানের অধিনায়ক ইমরান খান, বাংলাদেশ অধিনায়ককে বলেছিলেন; ‘টস করতে আর উইকেট পর্যন্ত যাওয়ার কি দরকার! বাউন্ডারি লাইনের বাইরেই করে ফেলি। ’ এবং করেছিলেনও। কিন্তু ২৮ বছর পর সেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের জবার দিতে শুরু করলো বাংলাদেশ। গাজী আশরাফ হোসেন লিপু মাঠে বসে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করার দৃশ্যটা হয়তো দেখতে পারলেন না। কিন্তু বিদেশে থেকে নিশ্চয়ই তিনি অনেক বেশি আনন্দিত; পাকিস্তানকে গুড়িয়ে দিয়ে তাঁর উত্তরাধিকারীরা সিরিজ জিতলো। এবং সেটা ৩-০ তে!
‘তিন’ সংখ্যাটা এই সিরিজে দারুণভাবে ‘ট্যাগ’ হয়ে থাকলো বাংলাদেশের সঙ্গে। তিন ম্যাচের তিনটাতেই জয়। তিন ম্যাচেই এসেছে সেঞ্চুরি। তামিমের টানা দুই সেঞ্চুরির পর তৃতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরি করলেন আরেক ওপেনার সৌম্য সরকার। এবং সেই সেঞ্চুরিতে ঔদ্ধত্য অনেক বেশি ছিল। ১১০ বলে এক ১২৭ রানে অপরাজিত থাকলেন সৌম্য সরকার। তবে সেঞ্চুরিটা পূর্ণ করলেন তিনি পাকিস্তান অধিনায়ক আজহার আলীকে মিড উইকেটের উপর দিয়ে ছক্কা মেরে!
ম্যাচ শেষে পাকিস্তান অধিনায়ককেও বলতে হলো; ‘খুব ভালো স্ট্রোক খেলেছে ও। খুব ভালো একটা ইনিংস। দেখতে ভালো। কিন্তু প্রতিপক্ষ অধিনায়ক হিসেবে ওরকম আক্রমণাত্মক ইনিংস হয়তো কেউ-ই দেখতে চাইবে না। ’
হ্যাঁ, অনেক বেশি কর্তৃত্ব নিয়ে ব্যাট করেছেন সাতক্ষীরা থেকে উঠে আসা এই তরুণ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ক্যারিয়ারের দশম ওয়ানডেতেই ওরকম দুর্দান্ত সেঞ্চুরির করার পর উচ্ছ্বাস ছিল উদযাপনে। কিন্তু আতিশয্যে ভাসেননি। আর ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের সামনে এসে যেটা দেখালেন তাকে মনে হতে পারে বিনয়। তবে ওটা বিনয় না বলে বোধহয় বলা ভালো তারুণ্যদীপ্ত কিন্তু পরিমিত ব্যক্তিত্বের অন্যরকম প্রকাশ। তাই সৌম্য সরকার বলতে পারেন; ‘চার দিয়ে শুরু করেছিলাম। ১৮ রান করার পর মনে হলো ইনিংসটাকে এবার বড় করা উচিত। সেদিকেই মনোযোগ দিলাম। কারণ, আগে বেশ কয়েকটা ইনিংসে ভালো শুরু করেছি। কিন্তু শেষটা ভালো হয়নি। এই ইনিংসটা শেষ করলাম শুরুর মতো। ’ অর্থাৎ অপরাজিত থাকলেন সেই বাউন্ডারি মেরেই। কিন্তু যেভাবে সেঞ্চুরি করলেন তাকে কি বলবেন? ‘আমি ঠিক জানতাম না কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। মানে কতো রানে ব্যাট করছিলাম। কিন্তু যে বলটা পেলাম তা থেকে আমার যা করার ছিল তাই করেছিলাম!’ ছক্কা মেরে সেঞ্চুরি! ভাবা যায়? বাংলাদেশ পাল্টে গেছে সেটা বোঝানোর জন্য আরো বাড়তি শব্দ খরচ করার প্রয়োজন পড়ে কি?
কিন্তু তারপরও বলতেই হবে মাশরাফির অধিনায়কত্বেই পাল্টে যাওয়া এই বাংলাদেশ। যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য সবকিছু করতে পারে। বাংলাদেশ দল যে এখন আর কোন তারকার উপর নির্ভরশীল নয়, সেটা মাশরাফি পাকিস্তানের ইনিংসের প্রথম দশ ওভারে পাঁচ বোলার ব্যবহার করেই বুঝিয়ে দিলেন।
প্রেস কনফারেন্স শেষে বেরিয়ে যেতে যেতে দলের বোলিং নিয়ে অনেক কথাই বললেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ‘তাসকিন কয় ওভার বল করেছে দেখেছেন?’ জানতে চাইলেন। ‘মাত্র দুই ওভার। হ্যাঁ, আমার হাতে অনেক অপশন ছিল বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। অথচ ও কিন্তু আমাদের অন্যতম সেরা স্ট্রাইক বোলার। আগের ম্যাচে রুবেলকেও পুরো দশ ওভার করানোর প্রয়োজন পড়েনি আমার। এই ম্যাচে সাকিবকে মনে হচ্ছিলো সেরা বোলার। তাই ওকে দিয়ে পুরো দশ ওভারই করালাম। দল যখন ভালো একটা ইউনিট হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় তখন কিন্তু ব্যক্তি নির্ভরতা কমে যায়। এই সিরিজে আমরা সেটা প্রমাণ করেছি, আমরা একটা ইউনিট। ’
এর পেছনে অধিনায়ক মাশরাফির বড় একটা ভূমিকা আছে। সেটা না বললেও চলে। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ উঠতেই বাংলাদেশ অধিনায়ককে মনে হলো অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে অনেক বেশি নিখাদ তিনি। তাই মাশরাফি বলতে পারেন; ‘দল ভালো খেললে সব অধিনায়কই ভালো। ’ পরোক্ষভাবে মনে করিয়ে দিলেন সেই পুরনো কথাটা; ‘দলটা যতো ভালো অধিনায়কও ঠিক ততোটা ভাল। ’ এবং মাশরাফি নিজেও বললেন; ‘এই দলটা এই সময়ের সেরা দল। ’ কিন্তু অনেকের মতে; এটাই বাংলাদেশের সেরা দল। সেরা দল নিয়ে তর্কটা হয়তো চলতেই থাকবে। তবে একটা তর্কে বোধহয় দাঁড়ি টেনে দেয়া যায়; বাংলাদেশ এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সেরা দলটাকেই হোয়াইটওয়াশ করলো।
লাল-সবুজ রঙের সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে আছে। সেই লাল-সবুজ জার্সিতে মোড়ানো দলটা বাংলাদেশের মানুষের আবেগের মূল্য দিলো ক্রিকেটীয় ঔদ্ধত্য দিয়ে পাকিস্তানকে ধোলাই করে রংহীন সাদা বানিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৫
এমজেএফ