ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

মৃৎশিল্পী হিসেবেই জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন মঙ্গলী

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২০
মৃৎশিল্পী হিসেবেই জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন মঙ্গলী

মৌলভীবাজার: বারবার থুবড়ে পড়তে চেয়েছে দারিদ্রপীড়িত জীবন। দমিয়ে দিতে চেয়েছে প্রতি মুহূর্তে। কিন্তু দমে যাননি। মধ্যজীবনের শেষভাগে পৌঁছেও থামাননি জীবন সংগ্রাম। এই বয়সেও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে একটু স্বচ্ছলতার সঙ্গে বাঁচতে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এক নারী মৃৎশিল্পী। 

জীবনযুদ্ধে হাল না ছাড়া এই স্বামীহারা এই নারী শিল্পীর নাম মঙ্গলী পাল। পেশায় কুমার মঙ্গলীর বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কুমড়াকাপন গ্রামে।

মাটির হাঁড়ি-পাতিল বানানোই তার নিত্যকর্ম। কিন্তু পরিবেশবিরোধী প্লাস্টিকপণ্যের যুগে দিন দিন কমে যাচ্ছে মাটির তৈজসপত্রের ব্যবহার। ফলে হুমকির মুখে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। বিপন্ন কুমার সম্প্রদায়ের জীবন। তার আঁচ লেগেছে মঙ্গলী পালের জীবনেও। একে উপেক্ষিত কুমার সম্প্রদায়ের মানুষ, তার ওপরে নারী, সব মিলিয়ে চলমান সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে নাভিশ্বাস উঠছে এ মৃৎশিল্পীর।

কিন্তু তারপরও মঙ্গলী ছাড়তে চান না বাপ-দাদার এ পেশা। মৃৎশিল্পের কাজ করেই বেঁচে থাকতে চান বাকিটা জীবন। এই কাজ করেই যাতে জীবন চালানো যায় দিনরাত সেই প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।  
 
রোববার (২৬ জানুয়ারি) দুপুরে কুমড়াকাপন গ্রামে মঙ্গলী পালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জলকাচা এঁটেলমাটি দিয়ে কলসের প্রাথমিক ছাঁচ তৈরি করছেন তিনি। আগে থেকেই বানানো আরও প্রায় আধ ডজন কলসের ছাঁচ তার সামনে। এভাবে ধাপে ধাপে একটি কলস বা যে কোনো তৈজস বানাতেও প্রচুর পরিশ্রম করতে হয় কুমারদের।

দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে মঙ্গলীর সংসার। বয়োবৃদ্ধা বিধবা মাকে নিয়ে যৌথভাবে থাকেন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে। বড় মেয়ে শম্পা উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ও ছোট মেয়ে সুবর্ণা এসএসসি পরীক্ষার্থী। একমাত্র ছেলে নয়ন এবারে ৭ম শ্রেণিতে উঠেছে। তবে টাকার অভাবে এখনো স্কুলে ভর্তি হতে পারেনি সে।
 
বর্তমান জীবন নিয়ে জানতে চাইলে বাংলানিউজকে মঙ্গলী জানান, ৫ বছর আগে হৃদরোগে হঠাৎ মারা যান তার স্বামী। ছোট ছোট তিন বাচ্চা নিয়ে সে সময় অকূল পাথারে পড়েন তিনি। কীভাবে মানুষ করবেন সন্তানদের, কীভাবেই বা ভরণপোষণ করবেন তাদের। এক পর্যায়ে স্বামীর পেশাকেই নিজের পেশ হিসেবে বেছে নিয়ে নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে।

মঙ্গলী বলেন, স্বামীর কাছ থেকেই যেহেতু মাটির কাজটা শিখেছি, সেটা দিয়েই সামান্য কিছু আয়-রোজগার করার চেষ্টায় নামি। তাই করেই কোনো মতে চলছে জীবন। মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতে অনেক পরিশ্রম, সে তুলনায় রোজগার খুবই কম।
 
‘সারা মাস মাটির ঘট, কলস, গ্লাস, দইয়ের পাতিল, প্রদীপ, থালা, চাটা, ব্যাংক এসব বানিয়ে পাইকারিতে বেচে মাত্র ৩-৪ হাজার টাকা আয় করি। তা দিয়েই কোনোমতে সংসার চালাই। ’ 

এই সামান্য টাকায় সংসার চালানোই দায়। ফলে ভালোভাবে মেটানো যায় না সন্তানদের পড়াশোনার খরচটাও।  

এ প্রসঙ্গে মঙ্গলী বলেন, মাত্র সাড়ে ১১শ’ টাকার জন্য কমলগঞ্জ সরকারি মডেল স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না আমার ছেলে নয়ন। কেউ যদি আমাদের জন্য সামান্য আর্থিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতো খুব ভালো হতো।  

জীবনযাত্রার মান যদি একটু ভালো করা যায় সেই আশায় কিছুদিন হলো শহরগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চলমান মৃৎশিল্প বাজারের হাবভাব বুঝতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মঙ্গলী। এ গ্রামের আরও কিছু নারীর সঙ্গে তাকেও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন মৃৎশিল্প সংশ্লিষ্ট ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান ‘রঙ্গন ক্রেপস’র সত্ত্বাধিকারী ইসরাত শারমিন।  

এ ব্যাপারে মঙ্গলী বলেন, মাটির জিনিসপত্র বানানোর আধুনিক কারিগরী ব্যবস্থা আমার নেই। দ্রুত ঘোরা চাকতি না থাকায় কোনো কিছু বানাতে আমার অনেক সময় লাগে। শারমীন আপা কথা দিয়েছেন আমাদের এ যন্ত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণও দেবেন। নতুন নতুন মাটির জিনিস তৈরিতে আমাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি।  
 
এ প্রসঙ্গে প্রশিক্ষক ইসরাত শারমিন বাংলানিউজকে বলেন, মঙ্গলীদের জীবন সংগ্রাম আর কষ্টের কথা যখন শুনেছি চিন্তা করলাম কীভাবে গ্রামের এই নারীদের আরো একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখানো যায়। সেই ভাবনা থেকেই আরও দৃষ্টিনন্দন আর নতুন নতুন মাটির তৈজসপত্র বানানো শেখাতে অনেক দূর থেকে হলেও তাদের বাড়িতে গিয়ে আমি প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।
 
‘টেরাকোটা, মাটির গহনা, ঘরের দেয়াল সাজানোর বিভিন্ন সামগ্রী, ফুলের টব, শো-পিসসহ আরো কিছু জিসিনপত্র তৈরির ব্যাপারে আমি মঙ্গলী ও তার মেয়ে শম্পাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই তারা এসব শিখে ফেলবে। এতে করে তাদের কর্মসংস্থানে নতুন মাত্রা যোগ হবে। এটা হয়তো তাদের টিকে থাকার লড়াইয়ে কিছুটা হলেও গতি সঞ্চার করবে। ’
 
শারমীন আরও বলেন, মাটির তৈরি জিসিনপত্রের ব্যবহার আজ হারিয়ে যাচ্ছে। বেড়ে চলেছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার। কিন্তু এর বিপরীতে আমরা যদি মাটির জিনিসপত্র ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিই বা মাটির একটি শো-পিস কিনে নিজেদের ঘরে রাখি তাহলে আমাদের দেশজ লোজসংস্কৃতি ও গৌরবকে যেমন তুলে ধরা হয়। তেমনি পরিবেশবান্ধবও হয়ে উঠবো আমরা।  

বাংলাদেশ সময়: ০০০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০২০
বিবিবি/এইচজে 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।