ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

অজপাড়াগাঁ থেকে অক্সফোর্ডের গবেষক শাবিপ্রবির মোস্তফা কামাল

হাসান নাঈম, শাবিপ্রবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০২৩
অজপাড়াগাঁ থেকে অক্সফোর্ডের গবেষক শাবিপ্রবির মোস্তফা কামাল

শাবিপ্রবি (সিলেট): অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে সফলতার ছোঁয়া পেয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্ধী মো. মোস্তফা কামাল সরকার। বর্তমানে তিনি বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যলয়ে সিনিয়র সহযোগী গবেষক হিসেবে কর্মরত।

পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন বায়োমেডিক্যালে। যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) দিয়ে ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিল রোগ নির্ণয় করে আর্লি ডায়াগনসিসে দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে নিরাময় সম্ভব।

তিনি শাবিপ্রবির ২০০২-০৩ সেশনে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। সফলতার পেছনের গল্প নিয়ে মোস্তফা কামালের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনুভূতি জানিয়ে মোস্তফা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে সড়ক আল্পনা, গান-বাজনা, কনসার্ট ও ব্যাকস্টেজ ম্যানেজমেন্টের কাজে। পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতে (ছাত্রলীগ) সক্রিয় ছিলাম। তাতে একাডেমিক ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে স্বল্প সিজিপিএ নিয়ে ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছি। তাই পরবর্তীতে মাস্টার্স করা সম্ভব হয়নি।

উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ব্রত মোস্তফা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একগাদা হতাশা নিয়ে পাস করে বের হই। পরে টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে রেডিও ফুর্তিতে যোগ দেই। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০১১ সালে কোরিয়ার চোনবুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে কম্পিউটার ভিশন ও মেশিন লার্নিং বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। তখন থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেখানে মাস্টার্স শেষে স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব রোভিরি আই ভার্জিলিতে পিএইচডি সম্পন্ন (বেস্ট পিএইচডি অ্যাওয়ার্ডসহ) করি।

পরে স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব বার্সেলোনা থেকে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি শেষ করি। সেখান থেকে লন্ডনের কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজের সুযোগ পাই। এরইমধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে ডাক পাই।

রিসার্চ ফেলো হওয়ার অনুভূতি সম্পর্কে মোস্তফা কামাল সরকার বলেন, অক্সফোর্ডে রিসার্চ ফেলো হওয়ার আগে কখনো চিন্তা করিনি যে, এখানে আসতে পারব। আগে দুইটা ইন্টারভিউতে রিজেক্টেড হয়েছি। তবে সরাসরি সিনিয়র পজিশনে চান্স পাওয়ার অনুভূতিটা অন্যরকম, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ছোটবেলায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বইয়ে পড়েছি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হওয়া অনেক আনন্দের। এখানে অনেক প্রতিযোগিতার মধ্যদিয়ে আসতে হয়েছে। কেউ এখানে আসতে চাইলে তাদের গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, অক্সফোর্ডে রিসার্চ ফেলোশিপের জন্য প্রতিবছর তাদের ওয়েবসাইটে সার্কুলার হয়। সেখানে প্রার্থীরা যোগ্যতা অনুযায়ী অনলাইনে আবেদন করেন। আবেদনপত্র যাচাই শেষে ভাইভার জন্য ডাকা হয়। ভাইভা বোর্ডে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এবং এইচআর-রা থাকেন। সেখানে রিসার্চ সম্পর্কে দশ মিনিট উপস্থাপনা করতে হয়। এরপর বিশ মিনিটের মতো প্রশ্ন-উত্তর করা হয়। সবকিছু শেষ হলে চূড়ান্তভাবে একজনকে নির্বাচিত করা হয়। আমিও এই নিয়মের মধ্যদিয়ে নির্বাচিত হয়েছি। তবে এই জার্নিটা মোটেও সহজ ছিলো। এখানে আসতে পরিশ্রম আর গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।

বর্তমান গবেষণা সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমানে আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেল দিয়ে ইকোকার্ডিওগ্রাফিতে নবজাতকের জন্মগত হার্টের ত্রুটি শনাক্তকরণের ওপর গবেষণা করছি। যার মাধ্যমে অনেক মানুষের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা রাখছি। এর আগে ব্রেস্ট ক্যান্সার, স্কিন ক্যান্সার, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কোলন ক্যান্সার নির্ণয়, আন্ডার ওয়াটার রোবটিক্স অ্যান্ড কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করার কথা জানান তিনি। সে গবেষণাপত্র বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়।

তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আগামীর সময়টা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) কিংবা গণিত-পরিসংখ্যানের যুগ। যারা এসব আয়ত্ত করবে, তারাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। তখন শুধু অক্সফোর্ড না, এমআইটি, হাভার্ডের মতো জায়গাতেও গবেষণা করার সুযোগ পাওয়া যাবে।

উত্তরসূরীদের পরামর্শ দিয়ে তরুণ এই গবেষক বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগেন। তারা যদি নিজের সাবজেক্টের বাইরে গিয়ে নিজেদের আনন্দ খুঁজে নেয়, তখন ভালো কিছু করার সুযোগ আসবে। হয়তো সিজিপিএ কমে যাবে, তবে এ অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে তাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। ফলে আর হতাশাও কাজ করবে না। আমি পড়েছি ফিজিক্স (পদার্থ বিজ্ঞান) নিয়ে, তবে আমার ভালো লাগতো কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, যা আমাকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শিখতে সহায়তা করে।

ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে মোস্তফা কামাল বলেন, আমি যেহেতু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ক্যান্সার এবং অন্যান্য জটিল রোগ আর্লি ডায়াগনসিসে রিসার্চ করছি, তাই আমার পরবর্তী পরিকল্পনা এ গবেষণা যেন আমার দেশের কাজে লাগে। সুযোগ পেলেই তা বাস্তবায়ন করব। আমাদের হেলথ সিস্টেমকে গতিশীল করতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিকল্প নাই। সারা পৃথিবীতে এটার বিপ্লব চলছে, তাই সত্যিকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য এ পথেই হাঁটতে হবে।

মোস্তফা কামাল সরকার নাটোরের লালপুর উপজেলার কুজিপুকুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবদুল আজিজ সরকারের ছেলে। তিনি ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন চিকিৎসা পেশা, সরকারি চাকরি এবং পিএইচডি সম্পন্ন করে দেশের বাইরে কর্মরত। তার সহোদর ড. মো. ওমর ফারুক সরকার যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অ্যামাজনে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত। মোস্তফার স্বপ্ন এখন অক্সফোর্ডে অধ্যাপনা।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০২৩
এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।