ঢাকা, শনিবার, ১৮ আশ্বিন ১৪৩২, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১১ রবিউস সানি ১৪৪৭

ফিচার

“কবুতরের লাইগা জান লইবার পারুম”

মাজেদুল নয়ন; স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৫৫, মে ১৩, ২০১২
“কবুতরের লাইগা জান লইবার পারুম”

ঢাকা : “এইটা অইলো গিয়া আপনের ৯৫ (১৯৯৫) সালের কাহিনী। আমার কবুতর এক হালায় চুরি কইরা লইয়া গেছিল।

পাখনা কাইটা দিছিল। আমি মাগার বুইঝা গেছিলাম। বাট ওয় পল্টি খায় (অস্বীকার করে)। কয় কবুতর অর। পরে ঝগড়া করতে করতে গ্যাঞ্জাম বাইধা যায়। আমার পায়ে স্টেপ (ছুরিকাঘাত) মারে। কাইট্যা ব্লাড বাইর অইয়্যা আহে (রক্ত বের হয়ে আসে)। পরে আমিও আমার ইয়ার-দোস্তগো লইয়া হামলা করছি। অর জান লইয়া ফালাইতাম। ভাই এইছব কবুতর আমার সখের জিনিছ, আমি ওগো লাইগা যে কারো জান লইয়া ফালাইবার পারুম। ”

পুরান ঢাকার হাজারীবাগের খলিল সরদার কমিউনিটি সেন্টার প্রাঙ্গণে নিজের শখের কবুতরগুলো দেখিয়ে কবুতরপ্রেমিক রাশেদ মাহমুদ জুয়েল এভাবেই বর্ণনা করলেন পোষা পাকীগুলোর জন্য তার জান-কবুল করা ভালোবাসার কথা।

৪৫ বছর বয়সী জুয়েলের শখ কবুতর পোষা। প্রায় ২০ প্রজাতির কবুতর রয়েছে তার কাছে। কথা বলার সময় একটু সময়ের জন্যেও সানগ্লাস খুলছিলেন না চোখ থেকে। ‘লাল ছিলা’ কবুতর নিয়ে তিনি দাঁড়া‍ন ক্যামেরার সামনে।

একে একে পরিচয় করিয়ে দেন অন্যদের সঙ্গেও। হুমা, চুইঠাল, চুইনা, বাঘা, সবুজগোলা, লালগোলা, খাকি চুইঠাল, কাজকড়া, লালগররাসহ নানান বংম-গোত্রের নামাজাদা হরেক পদের কবুতর। এর মধ্যে একটি কালো-সবুজ মিশ্রণের সবুজগলাধারী কবুতর দেখিয়ে বললেন, “ওয় সবচাইতে বুড়া। ১৬ বচ্ছর হইয়্যা গেছে, আমার মতো বুইড়া হইয়্যা গেছে। ”

আরেকটি বিশেষ কবুতর দেখালেন জুয়েল, এর নাম মাকডাবাগা। লাল সাদা মিশ্রণের অনন্য সুন্দর কবুতর। নয়াবাজারের আকবর শেঠ মারা যাওয়ার পর সেখান থেকে তিনি কবুতরটি নিয়ে আসেন। আকবর শেঠও কবুতর পুষতেন।

বললেন, “পাঙ্খা কবুতর ভাই। আকবর শেঠতো শেঠ আছিল, বুঝেন নাই? গুণ্ডা আছিল, মাগার শখ আছিল বেটার (লোকটার)। ”

সাদা শুভ্র হুমা কবুতর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উড়ানোর জন্যে ভাড়া দেন জুয়েল। “উইড়া আবার আমার কাছে চইল্যা আসে। ৫০ মাইল দূর থেইক্যা বাসা চিনে আর কাছে ধারের থেইক্যাতো আইবই। আইজ সকালেও তিনদিন পর একটা ফিরা আইছে। ”

এসব কবুতর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরে ঘুরে জোগাড় করেছেন তিনি। সাভার, গাজীপুর, সিলেট, রংপুরসহ আরো অনেক জেলায় গিয়েছেন কবুতরের খোঁজে।

প্রতিটি কবুতরের নাম আর চেহারা মুখস্থ জুয়েলের। বলেন, “পাঁচ সো (৫০০) কবুতরের মধ্যে একখান থাকলেও বুইঝ্যা ফালামু ওইটা আমার। কবুতর খুব ভালো, বুঝলেন ভাই, কোনো গিরিঙ্গি নাই। ”

আট-নয় বছর বয়স থেকেই কবুতরের নেশা পেয়ে বসে জুয়েলকে। বলেন, “ডেঞ্জারাস নেসা ভাই। ছাড়ে না। ”

জানালেন, কবুতর পোষার কারণে বাবা-মা বকাবকি করতেন। পড়াশোনা করতে তার ভালো লাগতো না। নিজের পোষা কবুতরের দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার ভালো লাগতো। “চাইয়্যা থাকতাম ভাই, আসমানে উড়লে দেকতে ভালো লাগতো। ওইরহম মজা কোনো জায়গায় নাই। ”

‘পড়াশুনা করতাম না, বাপে খালি বকত, মারতো, ১৪ বছর বয়স থাকতে বাপে একবার আমার শখের একটা কবুতর জবাই কইরা দিছিল। আমারতো মাতা নষ্ট। ডেঞ্জার (কীটনাশক) খাইলাম শোকে। পরেতো অবস্থা খারাপ, মেডিকেলে লইয়া গেল। কল্লার (মাথা অর্থাৎ মুখ) মইধ্যে পাইপ দিয়া ওয়াস করাইলো। এরপর থেইক্যা কান ধরছি আর বিষ খামু না। ”

৯৬ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত মাঝখানে ১১ বছর সৌদি আরব ছিলেন জুয়েল। সেখানেও কবুতর পালেন (পোষেন) তিনি। “ভাই সৌদির যে জায়গায় গেছি, ওই খানেই পালছি। ওই জিনিছ আমার নেসা অইয়া গেছে। ”

গত শনিবার হাজারীবাগে ঢাকাবাসী সংঠ আয়োজিত একদিনের উৎসবে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৪০টি কবুতর নিয়ে আসেন জুয়েল। তার বাসায় নানা প্রজাতির আরো একশো কবুতর রয়েছে বলে জানান তিনি।

হাজারীবাগের মনেশ্বর এলাকার নিজ ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে শুধু কবুতরের জন্যে বাসা বানিয়েছেন জুয়েল। “ওই রুমের মাঝখানে বইস্যা টাইম কাটাই। অরা চাইরদিকে ঘুরে। ওগরে খাওয়াই। ভালো লাগে। ”

বর্তমানে চামড়ার ব্যবসা করছেন জুয়েল। কবুতর বিক্রি করেও মোটামুটি আয় হচ্ছে। উৎসবে দু’টি ময়ুরপঙ্খী কবুতর নিয়ে এসেছেন রাব্বি। কবুতর দু’টি দেখিয়ে জুয়েল বললেন, “ওর কাছে এগুলা আমি বেচছি। জোড়া একলাখ টাকা। এগুলান শখের কবুতর। ওড়ে না, পাখনা মেইল্যা রাখে। ”

এছাড়া বাজি ধরেও টাকা আয় করেন মাঝে মাঝে। সৌদি যাওয়ার আগে ১ লাখ টাকার বাজি জিতেছিলেন তিনি। বাড়ি থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে জুয়েল ও তার প্রতিপক্ষ তাদের বিশটি করে কবুতর রেখে আসেন দুপুরে। নিজেদের কবুতরের গায়ে বিশেষ চিহ্ন দেওয়া হয়।

বাজি জেতার শর্ত হচ্ছে মাগরিবের আগেই কার বেশি সংখ্যক কবুতর বাড়ি ফিরে আসে। জুয়েল এবং প্রতিবেশী প্রতিযোগী গোফরান পাশাপাশি নিজনিজ ছাদে বিকেল থেকে অপেক্ষা করতে থাকেন। পাড়ার সব মানুষ আসে দেখতে। “বিকাল শেষ হইয়্যা যাইবার লাগছে। আমারতো মাথা নষ্ট, আমার আইছে মাত্র ৮টা আর গোফরানের ১৪টা। আমি বাবছি (ভাবছি) এই ঠেলায় বুজি ১ লাক ট্যাকা গেলোগা। আল্লার রহমত! সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে ঝাক ধইরা আমার ১০ খান কবুতর উইড়্যা ছাদে নামে। গোফরানের আর একটাও আসে নাই। আমারগুলান রেসের কবুতর, বুঝছেন ভাই। ”

শনিবার বিকালে ‘ঢাকাবাসী সংগঠনের উদ্যেগে হাজারীবাগে আয়োজন করা হয় কবুতর উৎসবের। উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। উৎসবে যারা কবুতর নিয়ে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্রময় ছিল জুয়েলের কবুতরগুলো।

১ ছেলে ও ১ মেয়ের বাবা জুয়েল। ১০ম শ্রেণিতে পড়ে মেয়ে লাবণ্য আর ২য় শ্রেণিতে ছেলে লিমন। তবে ছেলেমেয়েদের কারো এ শখ থাকুক তা চান না তিনি।

“খুব খারাপ নেছা ভাই, জিন্দিগি বরবাদ কইরা দেয়। কবুতরের লাইগ্যা আমি ইন্টারমিডিয়েট পাছ করতেই পারি নাইক্যা। আর এডি করে পোংটা (বাজে) পোলাপাইনে। আমি ভি সয়তান আছিলাম। আমার পোলাপাইনের মধ্যে অক্ষন আর তেমন সখ দেখি না এগুলান নিয়া। তয় পোলাডারে সাবধানে রাখবার লাগব। ”

বাংলাদেশ সময়: ২০৫১ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১২

এমএন/সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।