ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ আশ্বিন ১৪৩২, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১০ রবিউস সানি ১৪৪৭

ফিচার

রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র কেন শাহেদ-১৩৬ মডেলের ড্রোন বানাতে মরিয়া?

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৪০, অক্টোবর ২, ২০২৫
রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র কেন শাহেদ-১৩৬ মডেলের ড্রোন বানাতে মরিয়া?

বিশ্ব সামরিক প্রযুক্তির মানচিত্রে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের নাম শাহেদ-১৩৬। একসময় উপহাসের পাত্র হিসেবে খ্যাত এই ইরানি ড্রোন আজ বৈশ্বিক সামরিক শক্তিগুলোর প্রতিলিপি তৈরির প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলো এখন সক্রিয়ভাবে শাহেদ অনুকরণে ব্যস্ত।

পশ্চিমা অবজ্ঞা থেকে স্বীকৃতির পথে

দীর্ঘ এক দশক ধরে পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম ইরানের প্রতিরক্ষা উদ্ভাবনকে অবজ্ঞা করেছে। নতুন অস্ত্র প্রদর্শিত হলে তাকে বলা হয়েছে প্রোপাগান্ডা বা ‘ফটোশপের খেলা’। ২০১২ সালে ‘দ্য আটলান্টিক’ ইরানের ভিটিওএল ড্রোনকে বিদ্রূপ করেছিল। আর ‘দ্য রেজিস্টার’ অভিযোগ তুলেছিল জাপানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবি ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার।

কারার (Karrar) ও কাহের-৩১৩ (Qaher-313) ড্রোনের ক্ষেত্রেও একই তাচ্ছিল্য দেখা গিয়েছিল। কিন্তু শাহেদ-১৩৬ প্রমাণ করেছে, তেহরানের প্রতিরক্ষা খাতে স্বনির্ভর প্রচেষ্টা কেবল প্রতীকী নয়, কার্যকর ও কৌশলগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আজ পশ্চিমা সামরিক পরিকল্পনাকারীরাই স্বীকার করছেন, ইরানি ড্রোন নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, ইউক্রেনে ইরানি শাহেদ ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়া ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালানোর কারণে আমেরিকা ও তার মিত্ররা এখন এই সস্তা ও দূরপাল্লার ড্রোনের মতো ড্রোন তৈরি করতে চায় এবং এ ধরনের ড্রোনের অধিকারী হতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

ট্রাম্পের স্বীকারোক্তি: ‘খুব ভালো, দ্রুত ও প্রাণঘাতী’

ইরানি ড্রোনের বিষয়ে এই পরিবর্তিত মূল্যায়নের সবচেয়ে বড় প্রমাণ এসেছে রাজনৈতিক পর্যায়ে। ২০২৫ সালের মে মাসে কাতার সফরকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইরানি ড্রোনের দক্ষতা, স্বল্পমূল্য এবং বিধ্বংসী কার্যকারিতা প্রশংসা করেন।

মার্কিন-আরব সম্পর্ক ও সামরিক শক্তিকেন্দ্রিক এক বক্তৃতায় ট্রাম্প শাহেদ-১৩৬ সম্পর্কে বলেন, “খুব ভালো, দ্রুত ও প্রাণঘাতী। ”


শাহেদ-১৩৬ ড্রোন

তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র নির্মাতাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন একই ধরনের ড্রোন বানাতে। কিন্তু তাঁকে যে মূল্য কোট করা হয়, তা ছিল অবিশ্বাস্য— প্রায় ৪১ মিলিয়ন ডলার। অথচ ইরানি শাহেদ-এর মূল্য মাত্র ৩৫–৪০ হাজার ডলার।

খরচের এই বিশাল পার্থক্যকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল সামরিক-শিল্প খাতের একটি বড় ত্রুটি হিসেবে উল্লেখ করেন এবং ইরানের খরচ-সাশ্রয়ী উৎপাদন পদ্ধতি থেকে শেখার তাগিদ দেন।

শাহেদ-১৩৬ ড্রোনের প্রযুক্তি ও কনফিগারেশন

শাহেদ-১৩৬ আসলে ইরানের কৌশলগত দর্শনের প্রতিফলন। উদ্দেশ্য স্বল্প খরচে কার্যকর, ব্যাপকভাবে উৎপাদনযোগ্য অস্ত্র বানানো।

আকৃতি ও নকশা: ডেল্টা-উইং এয়ারফ্রেম, পিছনে প্রপেলার, রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ারড জার্মান ইঞ্জিন।

ওজন ও আকার:  উইংসপ্যান ২.৫ মিটার, ওজন ২০০–২৫০ কেজি।

ক্ষমতা: গতি ১৮৫–২০০ কিমি/ঘণ্টা, পাল্লা সর্বোচ্চ ২,৫০০ কিমি।

ওয়ারহেড: ৪০–৫০ কেজি উচ্চ-বিস্ফোরক, যা অবকাঠামো, কমান্ড সেন্টার ও জ্বালানি মজুদ ধ্বংসে সক্ষম।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ‘স্যাচুরেশন অ্যাটাক’ কৌশল। ডজন বা শতাধিক ড্রোন একসঙ্গে ছোড়া হলে প্রতিপক্ষের ব্যয়বহুল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। একটি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রের দাম মিলিয়ন ডলার, অথচ শাহেদ-১৩৬ এর দাম কয়েক হাজার। ফলে প্রতিরক্ষাকারী পক্ষ অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্যে পড়ে।

প্রতিলিপিতে ব্যস্ত রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র

শাহেদ-১৩৬ এর প্রভাব এতটাই প্রবল যে, এখন একে ঘিরেই গড়ে উঠছে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা।

রাশিয়া: রাশিয়া ইরানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে দেশটিতে শাহেদ-১৩৬ উৎপাদন করছে, যেখানে এর স্থানীয় নাম ‘গেরান- ২’ (Geran-2)। রাশিয়া এর উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে এবং এটিকে আরও উন্নত করেছে, যেমন ৯০ কেজি ওজনের ওয়ারহেড সংযোজন। ধারণা করা হয়, ২০২৬ সালের মধ্যে তারা বছরে ৫০,০০০-এরও বেশি ড্রোন তৈরি করতে সক্ষম হবে। রাশিয়া ইতোমধ্যেই উন্নত সংস্করণ তৈরি করেছে— Geran-3, যা ইরানি শাহেদ-২৩৮-এর ওপর ভিত্তি করে। এটি পিস্টন ইঞ্জিনের পরিবর্তে টার্বোজেট ব্যবহার করে, ফলে গতি বেড়েছে এবং ড্রোন ও ক্রুজ মিসাইলের মধ্যে সীমারেখা ঝাপসা করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: ইউক্রেনে শাহেদ-১৩৬-এর হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পেন্টাগন এখন এর প্রতিরক্ষা কৌশল উন্নত করতে এবং নিজস্ব সস্তার দূর-পাল্লার ড্রোন তৈরিতে তাগিদ দিচ্ছে। মার্কিন কোম্পানি Griffon Aerospace বানিয়েছে MQM-172 Arrowhead— প্রায় অভিন্ন প্রতিলিপি। মার্কিন সামরিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান SpektreWorks থেকে এক ড্রোন বাজারে আসে যার নাম FLM-136—শুধু নামেই নয়, আকার, কাঠামো, ইঞ্জিন ও ফ্লাইট টাইম—সব কিছুতেই এটি শাহেদ-১৩৬-এর সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। অনেক সামরিক বিশ্লেষক একে শাহেদ-১৩৬–এর ‘কপি-পেস্ট সংস্করণ’ হিসেবে অভিহিত করছেন। একই প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে LUCAS, মাত্র ৩৫,০০০ ডলার লক্ষ্য খরচে।

ইউক্রেন ও অন্যান্য দেশ: ইউক্রেন নিজেই রাশিয়ার শক্তি অবকাঠামোতে আঘাত হানার জন্য শাহেদ-স্টাইলের ড্রোন ব্যবহার করছে। ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং চীনেও একই রকমের প্রকল্প চলমান রয়েছে। চীন তাদের সিএইচ-সিরিজে শাহেদ-এর নকশা যোগ করেছে, বিশেষ করে রপ্তানি ও অ্যান্টি-শিপ মিশনের জন্য। Sunflower-200 প্রায় অভিন্ন, শুধু উল্লম্ব টেকঅফ ও কোনো বুস্টার ছাড়াই প্রপেলার ব্যবহার করে। পোল্যান্ডের PLargonia এবং সৌদি আরবের UnmannedX X-1500-এর মতো ড্রোনগুলো শাহেদ-১৩৬-এর নকশা ও কৌশলগত ধারণার বিস্তৃত প্রভাবেরই নির্দেশ করে। এছাড়া, ভারত, তুরস্ক, উত্তর কোরিয়া- এদেরও একই ধরনের প্রকল্প চলছে।

সামরিক শক্তির ‘গণতন্ত্রায়ন’

শাহেদ-১৩৬ কেবল একটি ড্রোন নয়; এটি একটি পদ্ধতি—কম খরচে ব্যাপক ধ্বংসের কৌশল। শাহেদ-১৩৬ এর আবির্ভাব প্রমাণ করে যে, কেবল বৃহৎশক্তিগুলো নয়, মাঝারি বা ছোট রাষ্ট্রও এখন দীর্ঘ-পাল্লার আঘাত হানতে সক্ষম। ফলে সামরিক প্রযুক্তি হয়ে উঠছে আরও ‘গণতান্ত্রিক’—ব্যয়বহুল যুদ্ধবিমান আর একচ্ছত্র আধিপত্য রাখছে না; বরং সস্তা ড্রোন আঞ্চলিক সংঘাতে কৌশলগত সমীকরণ বদলে দিচ্ছে।


ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে শাহেদ-১৩৬ ড্রোন

তেহরানের স্বনির্ভরতার কৌশল থেকে জন্ম নেওয়া এই ড্রোন শুধু যুদ্ধে কার্যকারিতা প্রমাণ করেনি, বরং ভবিষ্যতের মানববিহীন যুদ্ধবিমানের জন্য এক মানদণ্ড স্থাপন করেছে।

ভবিষ্যতের যুদ্ধের নতুন সংজ্ঞা

একসময় উপহাসিত ইরানি প্রযুক্তি আজ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে। শাহেদ-১৩৬ কেবল একটি ড্রোন নয়; এটি যুদ্ধের অর্থনীতি ও কৌশল বদলে দেওয়ার প্রতীক। স্যাচুরেশন আক্রমণ, স্বল্পমূল্য এবং সহজ উৎপাদন প্রমাণ করেছে, বড় শক্তি আর নিরাপদ নয়, ছোট খেলোয়াড়রাও এখন কার্যকর আঘাত হানতে পারে। ফলে প্রশ্ন জাগতে পারে- ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে কি ব্যয়বহুল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে নাকি শাহেদ-১৩৬-এর মতো সস্তা প্রযুক্তিই নতুন নিয়ম লিখবে? উত্তর সময়ই দেবে, তবে একথা স্পষ্ট—আধুনিক যুদ্ধের সংজ্ঞা আর আগের মতো নেই।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।