কলকাতা: ভারতের লোকসভা (সংসদ) নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই চিড় ধরছে বিজেপি বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটে। এরই মধ্যে জোটের শরিক উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের মায়াবতীর দল, বহুজন সমাজ পার্টি জানিয়ে দিয়েছে, তারা এখনই জোটে শামিল হবে না।
এই দৃশ্যপটে এবার পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলায় কোনো জোট হবে না। লোকসভা ভোটে রাজ্যে তৃণমূল একাই লড়বে। তিনি এমন সময় এই কথা বললেন, যখন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার ভারতজড়ো যাত্রা চলছে।
বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) সকালে রাহুলের যাত্রা আসাম থেকে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে প্রবেশের পরই হঠাৎ বাতিল হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিয়েই নামমাত্র রোড শো করেই দিল্লি চলে গেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। যা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে।
পাশাপাশি জোটের অপর মাথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারও যেন অন্যপথে। জল্পনা চলছে, তিনি ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে বিজেপির এনডিএ জোটে শরিক হবেন।
জানা গেছে, মোদীর বিহার সফরে এক মঞ্চে দেখা যেতে পারে নীতিশকে। একইভাবে নীতিশ জানিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বিহারে যে রাহুলের ভারতজোড়ো যাত্রা হবে তাতে তিনি থাকছেন না। সব মিলিয়ে ইন্ডিয়া জোটে জট জটিল হয়ে পড়েছে।
তবে কংগ্রেসের তরফে জানানো হয়েছে, আগামী রোববার (২৮ জানুয়ারি) পশ্চিমবঙ্গে ফিরতে পারেন রাহুল গান্ধী। তবে সেক্ষেত্রে রাহুলের যাত্রা থেকে বাদ পড়তে পারে রাজ্যটির উত্তরবঙ্গের দুই জেলা; জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারের একটি অংশ। তবে রাহুল পশ্চিমবঙ্গে ফের পা রাখবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
বুধবার (২৩ জানুয়ারি) পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলায় ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তৃণমূল কংগ্রেস একাই লড়াই করবে। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কারো সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো সম্পর্ক নেই তার। ইন্ডিয়া জোটের শরিক সিপিএমের ভূমিকা নিয়ে তিনি আগেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। এবার সরাসরি তিনি নিশানা করেছেন কংগ্রেসকে। মমতার অভিযোগ, তার সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছে কংগ্রেস। তাতেই বেজায় ক্ষুব্ধ তৃণমূল প্রধান। তাই পশ্চিমবঙ্গে অন্তত জোটের পথে হাঁটছেন না তিনি।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়েই জোটের জটিলতা তৈরি হয়েছিল। মমতা দাবি, গত লোকসভা ভোটে (২০১৯ সাল) পশ্চিমবঙ্গে জেতা দুটি আসন কংগ্রেসকে ছাড়তে রাজি। কিন্তু কংগ্রেসের দাবি, যেহেতু জোট তৈরি হয়েছে। তাই আরও বেশি আসন ছাড়তে হবে তৃণমূলকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফর্মুলা, যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী সেখানে তাকেই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই সুযোগ দেওয়া হোক। সেই ফর্মুলায় বাংলায় তৃণমূল শক্তিশালী। সেই বিষয়ের কংগ্রেস, তৃণমূল নেত্রীকে কাছে টানার চেষ্টা করলেও উভয়ের জোট কিছুতেই পূর্ণতা পাচ্ছে না।
রাহুলের ভারতজোড়ো যাত্রা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশের বিষয়ে মমতা বলেছেন, ওরা (কংগ্রেস) যে র্যালি করছে, আমিও ইন্ডিয়ার শরিক, সৌজন্যবশতও কি আমাকে একবার জানিয়েছে, যে দিদি আপনার রাজ্যে যাচ্ছি। না জানায়নি। সুতরাং আমার সঙ্গে বাংলার রাজনীতিতে ওদের কোনো সম্পর্ক নেই। সারা ভারতে কি করব, আর না করব, এখন নির্বাচনের পরে ভাববো। আমার ধর্ম নিরপেক্ষ দল আমরা বিজেপিকে হারানোর জন্য যা করার করব। এবার বাকিরা ঠিক করুন তারা কি করবেন।
বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) সকালে আসাম থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছিল রাহুল গান্ধীর ভারত জোড় যাত্রা। কিন্তু, কোচবিহারের বকশিরহাটে সংক্ষিপ্ত সভা এবং রোড শো করেই ‘গুরুত্বপূর্ণ কারণ’ দেখিয়ে দিল্লি চলে গেছেন রাহুল গান্ধী। যদিও তার দিল্লি যাত্রার কারণ সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়নি।
ঠিক একইভাবে ভারতের রাজনৈতিক মহলে জোর জল্পনা, ইন্ডিয়া জোট থেকেই বেরিয়ে যেতে পারেন নীতিশ। এমনকী তিনি ফের বিজেপির হাত ধরতে পারেন বলেও কোনো কোনও মহলের পক্ষে দাবি করা হচ্ছে। যদিও এ ব্যাপারে এখনও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। তবে জোটের অন্দরে বিষয়টি নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে।
এর আগে চারবার শিবির বদল করার নজির রয়েছে ৭২ বছর বয়সি নীতিশ কুমারের। বিহারে নিজের ক্ষমতা অটুট রাখলেও সর্বভারতীয়স্তরে কখনও মহাজোটে আবার কখনও বিজেপির সঙ্গে এনডিএ-তে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। সেক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তে তিনি জোট ছেড়ে বেরিয়ে বিজেপির হাত ধরলে তাতে অস্বাভাবিক কিছু হবে না বলেই মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিহারে নীতিশ বনাম সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের সঙ্গে তার 'ঠান্ডা লড়াই' আছে। তার ওপর জোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে অযথা সময় নষ্টের ঘটনায় নির্বাচনী প্রস্তুতির অভাব রয়েছে বলেও ঘনিষ্ঠমহলে জানিয়েছেন নীতিশ। অর্থাৎ জোট গঠন হলেও জোটের কার্যকলাপে খুব একটা খুশি নন প্রবীণ এ রাজনীতিক। তার ওপর জানা যাচ্ছে, ৪ ফেব্রুয়ারি বিহারের বেতিয়া জেলায় লোকসভা ভোটের প্রচারে মোদির সভায় উপস্থিত থাকতে পারেন নীতিশ কুমার।
ফলে ইন্ডিয়া জোট কার্যত ভেঙে যাওয়ার মুখে। আর তাতে রীতিমতো উৎসাহিত বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি মনে করছে, এর ফলে লোকসভা ভোটে বিজেপির ফল আরও ভালো হবে। ইন্ডিয়া জোটের দলগুলো যদি আলাদা লড়ে, সে ক্ষেত্রে বিজেপির বিরোধী ভোট বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। ফলে বিজেপি ক্ষমতায় ফেরা সময়ের ব্যাপার হবে। একই বিষয় মনে করছেন ভারতের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ এ ভারতের লোকসভা ভোটকে পাখির চোখ করে জোট বেঁধেছিল বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক শক্তিগুলো। যা নিয়ে গত বছরের ২৩ জুন বিহার রাজ্যের পাটনায় বৈঠকও হয়েছিল। সে বৈঠকে হাজির ছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার, রাহুল গান্ধীসহ মোট ১৭টি রাজনৈতিক দলের প্রধানরা। এরপর গতবছর ১৭- ১৮ জুলাই বেঙ্গালুরুতে সোনিয়া গান্ধীর ডাকা দ্বিতীয় বৈঠকে সবমিলিয়ে ২৭ দল যুক্ত হয়। সেখানেই ঠিক হয় ভারতের নামেই নতুন জোটের নাম হবে ‘ইন্ডিয়া’। পুরো নাম -ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়ান্স।
সবমিলিয়ে বিজেপিকে গদিতে সরাতে সাত মাস আগে যে ইন্ডিয়া জোট তৈরি হয়েছিল। তার এখন চিড় ধরেছে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৪
ভিএস/জেএইচ