ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ইমরান খানের দলের সামনে ‘অসন্তোষের গ্রীষ্ম’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৪ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০২০
ইমরান খানের দলের সামনে ‘অসন্তোষের গ্রীষ্ম’

গত সপ্তাহে পাকিস্তান সরকার খুব সহজেই অর্থবিল ২০২০-২১ পাস নিশ্চিত করেছে। তবে এটি নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে তার দলের সংসদ সদস্য এবং জোটের শরিকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা কমাতে নৈশভোজের আয়োজন করতে হয়েছে।

তবে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের লনে একটি সন্ধ্যা মানেই এমন নয় যে, সেটি কোনো রাজনৈতিক কৌশল উপস্থাপন করছে। নিজ দল এবং জোটের সঙ্গে সরকারের সমস্যাও বাজেটের মাধ্যমে বা গত সপ্তাহে দু’বার সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই সমাধান হয়ে যাবে না।

বাজেট অধিবেশন এটাই দেখিয়েছে যে, কোভিড-১৯ এর কারণে সরকার যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, তা দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারায় যে চাপে রয়েছে, সে চাপ আরও বাড়াতে চাচ্ছে একতাবদ্ধ ও অটল বিরোধী দল। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ক্রমবর্ধমান মতবিরোধ এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব ইঙ্গিত দেয় যে, দল পরিচালনা করাও এ জটিল মুহূর্তে একটি কঠিন সমস্যা হয়ে উঠেছে।

যে কোনো রাজনৈতিক দলে কিছুটা মতবিরোধ এবং অসন্তুষ্টি থাকতেই পারে এবং এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু যখন প্রায়ই তা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয় এবং বিশিষ্ট মন্ত্রীরা এবং সংসদ সদস্যরা টেলিভিশনে ভিন্নমত পোষণ করেন, তখন এটি রাজনৈতিক তাৎপর্য অর্জন করে। তবে খোলাখুলিভাবে এ ধরনের প্রকাশ্য বিভ্রান্তি যখন প্রশাসনের ত্রুটি সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণার সঙ্গে মিলে যায় বা এতে উৎসাহিত হয়, তখন তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

এসব থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? এটি ক্ষমতাসীন দল সম্পর্কে কী প্রকাশ করে? এর নেতার রাজনীতি পরিচালনার কৌশল সম্পর্কে? তার দলের এবং অসুখী জোটের অংশীদারদের অসন্তুষ্টি মোকাবিলা করার দক্ষতা সম্পর্কে?

পিটিআই (পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ) সরকারের সর্বাধিক সুস্পষ্ট দিক, যা ঘন ঘন মন্তব্য আকৃষ্ট করে, তা হলো, নির্বাচিত সদস্য এবং অনির্বাচিত উপদেষ্টা এবং বিশেষ সহকারীদের একটি বাহিনীর মধ্যে অন্তর্নিহিত উত্তেজনা। পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দলগুলোতেও এ ধরনের সংঘাত দেখা গেছে। তবে পিটিআই সরকার রেকর্ডসংখ্যক উপদেষ্টা এবং বিশেষ সহকারী নিয়োগের কৃতিত্ব অর্জন করেছে- সাম্প্রতিক ইতিহাসে যা সবচেয়ে বেশি। এটি দলের আইনপ্রণেতাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। শীর্ষে এবং উন্নয়ন তহবিলগুলো পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারাও তাদের হতাশার পেছনেও রয়েছে। অনেক আইনপ্রণেতাই মনে করেন, নেতা ক্ষমতা নিশ্চিত করতে তাদের ব্যবহার করেছেন এবং পরে তাদের এড়িয়ে গেছেন। সংসদীয় প্রস্তাবে ভোটের প্রয়োজন ছাড়া অন্য সময় এ অসন্তোষকে কোনো সমস্যা বলেই মনে না করার মাধ্যমে নেতা নিজেই এ উত্তেজনা আরও বাড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এ পদ্ধতি অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলোর সমাধান করতে খুব কমই কাজ করে।

বিশেষ করে জোট সরকারের ক্ষেত্রে মৈত্রীদের সঙ্গে কাজ করার সময় এটি ঘটে। সংসদে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে মিত্রদের প্রয়োজন রয়েছে। তবে জোটের অংশীদারদের স্বার্থ রক্ষা করতে না পারায় ইতোমধ্যে বিএনপি-এমকে (বেলুচিস্তান ন্যাশনাল পার্টি- মেঙ্গল) এ পথ বিভাজনের দিকে নিয়ে গেছে, যার নেতা আখতার মেঙ্গল এ ভাঙনের পেছনে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতাকেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আরেক মিত্র পিএমএল-কিউ প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজে অনুপস্থিত থাকার ব্যাপারটি স্পষ্টই অসম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতি নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টির ইঙ্গিত দেয়।

এ ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের পেছনে একটি কারণ সংসদের প্রতি নেতার মনোভাব। প্রধানমন্ত্রী নিজে সংসদের কাজে খুব কম আগ্রহ ও ধৈর্য দেখিয়েছেন। শুধু বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে উপস্থিত হওয়াই যথেষ্ট নয়। সংসদীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য ঐক্য তৈরি করা, বিরোধী মতামত শোনা, ভিন্নমত পোষণকারী কণ্ঠ সমন্বিত করা এবং নিয়মিতভাবে দলের ব্যাকবেঞ্চারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবিগুলো আদায় এবং নীতিমালার জন্য সমর্থন চাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ‘প্রথাগত রাজনীতি’ প্রত্যাখ্যান করে, ক্ষমতাসীন দল একইভাবে সংসদের ভূমিকা অবমূল্যায়ন করেছে এবং কেবল ফ্রন্টবেঞ্চাররা বিরোধী দলকে আক্রমণ করতে এটি ব্যবহার করেছে।

তবে আরেকটি আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যা নেতার সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যখন মিত্রদের এবং নিজস্ব সংসদ সদস্যদের সমর্থনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তখন বেসামরিক-সামরিক প্রতিষ্ঠান সরকারকে এ সমর্থন জোগাতে সহায়তা করেছে। অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের ওপর নির্ভরতা সংসদকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়ার এবং এর সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন কমিয়ে দিয়েছে। তদুপরি, জোটটি নিজেই প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় একত্রিত হয়েছিল, তাই দলীয় নেতারা আবার মিত্রবাহিনীকে লাইনে রাখার জন্য এর দিকেই ঝুঁকছেন।

দলের অভ্যন্তরীণ ফাটলগুলোর মাধ্যমে এটাই প্রতিফলিত হয় যে, পিটিআই বিভিন্ন স্বার্থের সমন্বয়ে গঠিত এবং দলটিতে রয়েছে বৈচিত্র্যময় মূল সমর্থকরা, অন্য দলচ্যুতরা এবং প্রতিষ্ঠানের সমর্থনে নির্বাচনের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন প্রবেশকারীরা। পাঞ্জাবের যারা দলে যোগ দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই ছিলেন পিএমএল-কিউ এবং পিপিপির সাবেক সদস্য এবং খাইবার পাখতুনখোয়ায় জামায়াতে ইসলামী, পিপিপি এবং পিএমএল-এনের দলচ্যুত সদস্যরা যোগ দিয়েছিলেন।

বৈচিত্র্যময় এ সদস্যদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে একীভূত করা সহজ ছিল না এবং এটাই ব্যাখ্যা দেয়, কেন ক্ষমতাসীন দল পরস্পরবিরোধী অবস্থানে ঘোরাফেরা করছে। ঠিক এ কারণেই দলটি কিসের পক্ষে অবস্থান করছে তা না বলে কিসের বিরোধিতা করছে, তা দিয়ে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে। এটি ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে’, ‘প্রথাগত রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে’ এবং ব্যবসায় ‘মাফিয়াদের’ বিরুদ্ধে। তাই দলটি এখনো নিজের জন্য ইতিবাচক কোনো পরিচয় তৈরি করতে পারেনি।

ক্ষমতাসীন একটি দল পরিচালনা করা আরও বড় একটি চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে যখন দলটি সুসংগঠিত নয়- বরং অনেকটা ফ্যানক্লাবের মতো। দীর্ঘদিন ধরে দল পরিচালনার দায়িত্ব পাকা রাজনীতিবিদ জাহাঙ্গীর তারিনকে দেওয়া হয়েছিল। তিনি খানের সমর্থন হারানোর আগ পর্যন্ত এটি ভালোভাবেই কাজ করেছে। পরবর্তীকালে কাউকেই এ কাজটি দেওয়া হয়নি, ফলে দলটি অবিন্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং বিবদমান কণ্ঠস্বর বাড়ছে।

তবে দলের, বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ সদস্যদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে নেতার অনীহার কারণ, এখনো ধাঁধা হিসেবে রয়ে গেলো। জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভারসাম্য নষ্ট করতে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের লড়াইয়ে রাখার কৌশল, একটি ব্যাখ্যা হতে পারে। আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হলো, তিনি তার পথ থেকে সরে এসে দলীয় রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার জন্য ‘হাত নোংরা করতে’ অনিচ্ছুক। তবে কারণ যাই হোক না কেন, তা দলটিকে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থায় ফেলে রেখেছে এবং দলীয় বিষয় থেকে নেতা দূরে রয়েছেন, এমন ধারণা তৈরি করছে। তাছাড়া এটি মন্ত্রীদের যা খুশি বলা এবং টুইটারে লেখার স্বাধীনতা দিচ্ছে, যা কখনো কখনো সরকারি নীতির বিরুদ্ধেও যাচ্ছে। এতে জনগণের এ ধারণা আরও শক্তিশালী হচ্ছে যে, একটি বিশৃঙ্খল দল সরকার পরিচালনা করছে।

এসবের কোনোটাই অবশ্য সরকারের অস্তিত্বের জন্য হুমকি নয়। তবে মিত্রদের দূরে সরিয়ে দেওয়া এবং দলীয় উত্তেজনা অমীমাংসিত রেখে দেওয়া এমন সংকেত দেয় যে, সামনের দীর্ঘ এবং রাজনৈতিকভাবে গরম গ্রীষ্মে বিপদ আসন্ন।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক দূত

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৪ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০২০
এফএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।