নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের নিবিড় মমতায় গড়ে তোলা নন্দনকানন নূহাশপল্লী। লেখক তার বহু জনপ্রিয় উপন্যাস এখানে বসেই লিখেছেন।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে গাজীপুরের হোতাপাড়ার পার্শ্ববর্তী পিরুজালী গ্রামের ৩৭ একর জমিতে নূহাশপল্লী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন হুমায়ূন আহমেদ। একেবারেই অজপাড়াগাঁয়ে শালবনের ভেতরের এই এলাকাটি আজ ২০ বছর পর সুন্দর-পরিপাটি এক নন্দনকাননে রূপান্তরিত হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের অনেক দিনের স্বপ্ন মিশে আছে নূহাশপল্লীর লালমাটির ভাঁজে ভাঁজে।
কী আছে নূহাশপল্লীতে...
আধো গ্রাম আধো শহরের খোঁয়া ওঠা পিচের রাস্তা থেকে একটি কাঁচাপথ চলে গেছে নূহাশপল্লীর সদর দরোজায়। কাঠের ফটকটি খুলে দিলে সবার আগে চোখে পড়বে সবুজে সবুজ বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠের মধ্যেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একেকটা গাছ। হুমায়ুন আহমেদের ভাষায়, এগুলো ছায়াবীথি। আম, জাম, লিচু, মেহগিনি আর কড়ই গাছগুলো একেকটা অন্যটির চেয়ে বেশ দূরে দূরে। সবুজ মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে রাজহাস, তিতির আর চিনেমুরগির দলে। মাঠের মধ্যেই আছে ছাউনি ঢাকা নামাজঘর ও দাবাঘর। চোখে পড়বে গাছের ডালে বাধা ঘর ‘বৃক্ষগৃহ’।
মাঠের একপাশে হুমায়ূন আহমেদের নিজের কটেজ। নূহাশপল্লীতে এলে সেখানে তিনি রাত্রিযাপন করেন। কটেজের সামনে আছে নীল জলের একটি ওভাল সুইমিং।
পিকনিক করতে আসা অতিথিদের জন্য আছে ‘বৃষ্টিবিলাস’ নামের একটি কটেজ। বিশাল বারান্দা আর টিনের চাল এই কটেজের বৈশিষ্ট্য। বর্ষণমুখর দিনে সবুজ মাঠে বৃষ্টি দেখা ও টিনের চালের টিপটিপ ছন্দ শোনার জন্য এখানকার খোলা বারান্দা হুমায়ূন আহমেদের বিশেষ পছন্দ।
সবুজ মাঠের অন্যপাশে আছে শুটিংয়ের জন্য মাটির ঘর, টিনের ঘর, পাতকুয়ো আর বিশাল স্টুডিও। এই স্টুডিওতে সেট ফেলে হুমায়ূন আহমেদ তার নাটকের ইনডোর শুটিং করে থাকেন।
নূহাশপল্লীর বিশাল মাঠের শেষ প্রান্ত থেকে হুমায়ূন আহমেদ নিবিড় পরিচর্যায় গড়ে তুলেছেন একটি ঔষধি গাছের বাগান। বাগানের মধ্যে আছে আকর্ষণীয় জলাধার, যার মধ্যভাগের মৎস্যকন্যার মূর্তিটি দেখা মতো। জলাধারের পাশে পাথরের তৈরি রাক্ষসের কাঠামোটিও বেশ আকর্ষণীয়। বাগানের শেষভাগে আগে কংক্রিটে তৈরি ডাইনোসারের বেশ কিছু মূর্তি। অতিথিদের কাছে ছবি তোলার জন্য জায়গাটা খুব পছন্দের।
নূহাশপল্লীর শেষ প্রান্তে আছে একটি দীঘলদিঘি। খানিকটা লম্বাকৃতি বলে এটাকে ছোট্ট একটা লেক বললেও ভুল হবে না। দীঘির দু প্রান্তে আছে দুটি ঘাট। একটি প্রাচীন আমলের ক্ষয়ে যাওয়া ঘাটের আদলে গড়ে তোলা, অন্যটি আধুনিক। মজার ব্যাপার হলো লেকে মধ্যবর্তী স্থানে ছোট্ট দ্বীপের মতো একটা বসার জায়গা রাখা হয়েছে। যেখানে বসে লেখকের সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘আমার আছে জল’ কথা মনে পড়তেই পারে।
এই নন্দনকানন দেখার মতো আরো আছে অর্কিডবাগান, ছোট্ট ছোট্ট বেশ কটি জলাধার, নানারকম মূর্তি, একটুকরো শালবন ইত্যাদি।
পিকনিক করতে চাইলে ...
নূহাশপল্লী হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত নন্দনকানন হলেও সাধারণত কোনও অতিথি যদি জায়গাটি ঘুরে-ফিরে দেখতে চান, তাহলে তাকে কিছু সময়ের জন্য ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়। নূহাশপল্লীতে পিকনিক করার জন্যও ইদানীং অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। তবে এই অনুমতি শুধু দিনব্যাপী অবস্থানের জন্য। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০০ জনের জন্য বুকিং খরচ ৩০ হাজার টাকা। পিকনিক করতে আসা অতিথিদের জন্য কটেজের ৪টি ঘর বরাদ্দ করা হয়। রান্নাবান্না বা খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। নূহাশপল্লী বুকিং দেওয়ার জন্য যোগাযোগের ফোন নম্বর ০১৭১২০৬০৯৭১ ও ০১৭১১৯৪৭৯৩১।
যাওয়ার ব্যবস্থা...
ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ডের পূর্বপাশের রাস্তা ধরে প্রায় ৮ কিমি যাওয়ার পর নূহাশপল্লীতে পৌঁছানো যাবে। নিজস্ব গাড়ি না থাকলে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ, শ্রীপুর, মাওনা বা কাপাসিয়ার যে কোনও বাসে চড়ে হোতাপাড়া নামতে হবে। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৫০ টাকা থেকে ৭০ টাকা। হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা বা বেবিট্যাক্সিতে করে নূহাশপল্লীতে যাওয়া যায়। রিকশাভাড়া পড়বে ৫০-৬০টাকা, ট্যাক্সি ভাড়া পড়বে ১০০-১২০ টাকা।
ফুটনোট...
নূহাশপল্লীতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যারা যেতে চান তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে সেখানে খাওয়া-দাওয়ার জন্য কোনও হোটেল বা রেস্টুরেন্ট নেই। আরো মনে রাখতে হবে, সূর্য ডোবার পর সেখানে বাইরের লোকদের অবস্থানের অনুমতি দেওয়া হয় না।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২৩১৫, অক্টোবর ২৮, ২০১০